দেশের বহুতল ভবন, প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনার অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা অত্যন্ত নাজুক অবস্থায় রয়েছে। ফলে ছোট অগ্নিকাণ্ডের ঘটনাগুলোও সময়মতো নিয়ন্ত্রণ করা যাচ্ছে না। এতে বড় বিপর্যয় ঘটছে। অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধারকারী সংস্থা ফায়ার সার্ভিসের জরিপ বিশ্লেষণ করে পাওয়া গেছে এমন তথ্য। সেখানে বলা হয়েছে, ৯০ দশমিক ৩৫ শতাংশ স্থাপনা অগ্নিঝুঁকিতে রয়েছে। এর মধ্যে অতি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে ২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
উল্লিখিত পরিসংখ্যান দেশের ভঙ্গুর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার একটি উদাহরণ বলে মত দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিয়মিত তদারকির অভাবে এই অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। কলকারখানায় নিয়মিত মেজার টেস্ট ও ফায়ার ড্রিল না হওয়া এবং স্প্রিংকলার সিস্টেম না থাকার ফলে ঘটছে দুর্ঘটনা, যাচ্ছে প্রাণ।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স বলছে, অগ্নিনিরাপত্তা ও অগ্নিঝুঁকি মোকাবিলার লক্ষ্যে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনায় নিয়মিত জরিপ কার্যক্রম পরিচালনা করা হয়। অতি ঝুঁকিপূর্ণ, ঝুঁকিপূর্ণ ও সন্তোষজনক-এই তিন ক্যাটাগরিতে তারা প্রতিষ্ঠানগুলোকে চিহ্নিত করেন। এক্ষেত্রে অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ব্যবস্থাদির ২২ ধরনের তথ্য নেওয়া হয়। ২০১৯-২০২০ অর্থবছরে ৫ হাজার ২৫০টি প্রতিষ্ঠান ও স্থাপনাকে এ জরিপ কার্যক্রমের আওতায় এনেছেন তারা। যেখানে মাত্র ৫০২টি স্থাপনকে ‘সন্তোষজনক’ বলা হয়েছে। যা মোটের ৯ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ঝুঁকিপূর্ণ হিসাবে চিহ্নিত করা হয়েছে ৩ হাজার ৫১৮ স্থাপনাকে। জরিপে আসা মোট ভবনের মধ্যে যা ৬৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। এই জরিপে অতি ঝুঁকিপূর্ণ স্থাপনা রয়েছে ১ হাজার ১৮৭টি। শতকরা হিসাবে যা ২২ দশমিক ৭৯ শতাংশ।
জানতে চাইলে ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদপ্তরের মহাপরিচালক ব্রিগেডিয়ার জেনারেল মো. সাজ্জাদ হোসাইন বলেন, ফায়ার সেফটি ও আশপাশের নিরাপত্তা ব্যবস্থা দেখে আমরা স্থাপনাগুলো তিন ক্যাটাগরিতে চিহ্নিত করি। এক্ষেত্রে আমাদের একটি চেকলিস্ট রয়েছে সেগুলো দেখে এটি নিশ্চিত করা হয়। যারা অতি ঝুঁকিপূর্ণ বা ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় আছে তাদের বিরুদ্ধে বিধি অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া হয়। একটি ঘটনার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, কিছুদিন আগে আমরা গুলশান শপিং কমপ্লেক্সকে ব্যবহারের অনুপযোগী ঘোষণা করে সিটি করপোরেশন ও পুলিশকে ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য জানিয়ে দিয়েছি। যেহেতু সিটি করপোরেশনের মধ্যে এটি তাই তাদের সুপারিশ করা হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ৬টি ক্যাটাগরির মোট ৫ হাজার ২০৭টি স্থাপনার জরিপ করে। এর মধ্যে রয়েছে-শপিংমল-মার্কেট, স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়, ব্যাংক, হাসপাতাল-ক্লিনিক, আবাসিক হোটেল ও মিডিয়া সেন্টার। এই জরিপে দেখা যায়, ১ হাজার ৫৯৫টি শপিংমল ও মার্কেটের মধ্যে মাত্র ২৪টির অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থা সন্তোষজনক। আর ঝুঁকিপূর্ণ ৮৯৭টি ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ ৬৭৪। ১ হাজার ৫২৭টি স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ১১৯টি সন্তোষজনক, ১ হাজার ৭২টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩৩৬টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ৮০৫টি ব্যাংকের মধ্যে ২০১টি সন্তোষজনক, ৫৯৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ১১টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ৬৯৯টি হাসপাতাল-ক্লিনিকের মধ্যে ৬৩টি সন্তোষজনক, ৫০২টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ১৩৪টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ৫৩৩টি আবাসিক হোটেলের মধ্যে ৭১টি সন্তোষজনক, ৪৩৩টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ২৯টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ। ৪৮টি মিডিয়া সেন্টারের মধ্যে ২৪টি সন্তোষজনক ২১টি ঝুঁকিপূর্ণ ও ৩টি অতি ঝুঁকিপূর্ণ।
জানতে চাইলে ঢাকা দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা বিশেষজ্ঞ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক ড. এএসএম মাকসুদ কামাল বলেন, ফায়ার সার্ভিসের উল্লিখিত জরিপে দেশের ভঙ্গুর অগ্নিনিরাপত্তা ব্যবস্থার এক ভয়াবহ চিত্র উঠে এসেছে। এটি আশঙ্কাজনক। নিয়ম অনুযায়ী প্রতি ৩ মাসে বহুতল ভবনে ‘ফায়ার ড্রিল’ (অগ্নিনির্বাপণ ও সচেতনতা মহড়া) হওয়ার কথা। কিন্তু তা নিয়মিত হচ্ছে না। ইন্ডাস্ট্রিতে স্প্রিংকলার সিস্টেম থাকার কথা, তাও অধিকাংশের নেই। এই ব্যবস্থায় পানির পাইপগুলো নির্দিষ্ট তাপমাত্রার পর ফেটে গিয়ে পানি বের হতে থাকে এবং ফায়ার অ্যালার্ম বাজে। এটি একটি স্বয়ংক্রিয় অগ্নিনির্বাপণ ব্যবস্থা। উন্নত বিশ্বে অধিকাংশ অগ্নিদুর্ঘটনা এই ব্যবস্থায় নিয়ন্ত্রণে আসে। এছাড়া অন্তত ৫ বছর পর পর মেজার টেস্ট করার কথা। যার মাধ্যমে ওই ভবনের বৈদ্যুতিক তারগুলোর অগ্নিপ্রতিরোধক সক্ষমতা দেখা হয়। এছাড়া অগ্নিনিরাপত্তা নিশ্চিতে ফায়ার হাইড্রেন্ট রাখার কথা। যা থেকে জরুরি পানি সরবরাহ করা যায়। যখন ফায়ার সার্ভিস থেকে লাইসেন্স দেওয়া হয় তখনও এই বিষয়গুলো নিশ্চিতের কথা বলা থাকে। কিন্তু পরে দেখা যায়, এগুলো সঠিকভাবে তদারকি হচ্ছে না। ফলে ভবনের অগ্নিঝুঁকি বাড়ছে।
জরিপ নিয়ে কথা হয় ফায়ার সার্ভিসের ওয়্যার হাউজ অ্যান্ড ফায়ার প্রিভেনশনের সহকারী পরিচালক মনির হোসেনের সঙ্গে। তিনি বলেন, অগ্নিঝুঁকি নিরূপণের ক্ষেত্রে অগ্নিপ্রতিরোধ ব্যবস্থাকে আমরা বিবেচনাই নেই। অতি ঝুঁকিপূর্ণ চিহ্নিত করার ক্ষেত্রে যেখানে কেমিক্যাল বেশি থাকে, মানুষ বেশি থাকে, দাহ্য বস্তু বেশি থাকে, মুহূর্তে আগুন ছড়িয়ে যেতে পারে এবং পর্যান্ত অগ্নিনিরোধক ব্যবস্থা নেই-এমন অবস্থা যদি থাকে সেটাকে চিহ্নিত করি। নারায়ণগঞ্জের যে হাসেম ফুড ফ্যাক্টরি সেটি অতি ঝুঁকিপূর্ণ ছিল। আর সন্তোষজনক বলা হয়, যদি সেখানে স্প্রিংকলার সিস্টেম থাকে, ফায়ার এক্সটিংগুইশার, ২৩ মিটার পর পর সিঁড়ি, ফায়ার হাইড্রেন্ট থাকে, ওয়েল ট্রেইনড জনবলসহ পর্যাপ্ত অগ্নিনির্বাপক ব্যবস্থা থাকে তাহলে সেটাকেই আমরা সন্তোষজনক অবস্থা বলি। বাংলাদেশে যমুনা ফিউচার পার্ক এর উৎকৃষ্ট উদাহরণ।
ফায়ার সার্ভিসের এই কর্মকর্তা আরও বলেন, নারায়ণগঞ্জের কারখানায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় স্প্রিংকলার থাকলে সেখানে শুধু দরকার ছিল পানি। এটি এমন একটি ব্যবস্থাপনা যেখানে প্রতি ১০ মিটার পর পর একটি ছোট চিকন একটি নজল থাকবে। আগুন লাগলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটি নিভে যাবে। ফায়ার সার্ভিসও লাগবে না, মালিকও লাগবে না। জাপান, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া, কাতারসহ উন্নত বিশ্বে সাধারণ হোটেলেও তারা স্প্রিংকলার সিস্টেম স্থাপন করে রাখে। কারণ যাতে মানুষও মারা না যায়, সম্পদও রক্ষা হয়। ডিটেক্টর সিস্টেম স্থাপন। যার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে অ্যালার্ম বা সাইরেন বাজবে। তিনি বলেন, ফায়ার সার্ভিসের আইনে ছয়তলার উপরে হলে কোনো ভবনে আমরা বহুতল ভবন বলি। এখন সেটা আবাসিক হোক বা ইন্ডাস্ট্রি হোক। এসব ভবনে ফায়ার সেফটি প্ল্যান লাগবে, ইক্যুইপমেন্টগুলো স্থাপন করতে হবে।
২২ ধরনের তথ্য : বহুতল বাণ্যিজ্যিক ভবন পরিদর্শনে ফায়ার সার্ভিস অগ্নিনিরাপত্তা বিষয়ক ২২ ধরনের তথ্য নেয়। সেগুলো হলো-ভবন সংশ্লিষ্ট রাস্তা, ভূগর্ভস্থ জলাধারের আয়তন ও ধারণক্ষমতা (স্প্রিংকলার ও রাইজার উভয়ই থাকলে শুধু স্প্রিংকলারের পানি প্রবাহ নিশ্চিত করতে হবে), ভূগর্ভস্থ জলাধার ব্যতীত নিকটস্থ পানির উৎসের (পুকুর/নদী-নালা/খাল), ফায়ার ব্রিগেড কানেকশন ও ইন্টারনাল হাইড্রেন্ট সংক্রান্ত তথ্য, পাম্প, রাইজার ও স্প্রিংকলার সংক্রান্ত তথ্য, সিঁড়ি সংক্রান্ত তথ্য, লিফট সংক্রান্ত তথ্য, ডিটেকশন ব্যবস্থার বিবরণ, বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন সংক্রান্ত তথ্য, জেনারেটর সংক্রান্ত তথ্য, বয়লার ও জেনারেটর সংক্রান্ত তথ্য, ভবনের ছাদে লাইটনিং প্রটেকশন সিস্টেম স্থাপন বিষয়ক তথ্য, রেজিস্টারসমূহ সংরক্ষণ বিষয়ক তথ্য। আরও রয়েছে অভ্যন্তরীণ সাজসরঞ্জামাদি, ফ্লোর সংযোজন সংক্রান্ত, ভবনের উচ্চতা ২৬ মিটার বা ৮ম তলার উর্ধ্বে হলে জরুরি নির্গমন সিঁড়ি এলাকায় তাপ, ধোঁয়া ও আগুনমুক্ত রিফিউজ এরিয়া তথ্য, ভবনের ছাদ নিয়ে বিস্তারিত, বহনযোগ্য অগ্নিনির্বাপণ যন্ত্র স্থাপন বিষয়ক তথ্য, অগ্নিনির্বাপণ, উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা সম্পর্কে প্রশিক্ষিত জনবল ও ভবন ব্যবহারকারীদের সমন্বয়ে অগ্নিনির্বাপণ ও উদ্ধার সম্পর্কীয় ব্যবস্থাপনা কমিটি।