বিনোদন

অভিনেতা ফারুকের অজানা অধ্যায়

১৫ মে পৃথিবীর মায়া ছিন্ন করে পরপারে চলে যান বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিংবদন্তি অভিনেতা ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। চিকিৎসাধীন অবস্থায় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে মারা যান তিনি। জীবদ্দশায় ফারুককে নিয়ে ছিল অনেক আলোচনা। তার জীবনের কিছু অজানা অধ্যায় পাঠকদের জন্য তুলে ধরা হলো-

দুলু থেকে ফারুক, এরপর মিয়াভাই

বীর মুক্তিযোদ্ধা, অভিনেতা ও সংসদ সদস্য ফারুকের পুরো নাম আকবর হোসেন পাঠান। তার ডাক নাম ছিল দুলু। নায়ক ফারুক হিসাবেই সিনেমায় পরিচিত ছিলেন। মিয়াভাই নামেও তিনি চিত্রপুরিতে পরিচিত ছিলেন। এক সাক্ষাৎকারে জানিয়েছিলেন কীভাবে দুলু থেকে ফারুক হয়েছিলেন। তিনি বলেছিলেন, অভিনেতা এটিএম শামসুজ্জামান, চলচ্চিত্র পরিচালক এইচ আকবর ও ফারুক নামের এক বন্ধুর পরামর্শে তিনি ‘ফারুক’ নামটি ধারণ করেছিলেন। তিনি বলেন, ‘ছয় দফা আন্দোলনের পর আমি ওয়ান্টেড ছিলাম, যে কারণে নাম দিয়ে দিল ফারুক। ওরা বলল, এ নামে তোমাকে প্রথমে কেউ ধরবে না। দ্বিতীয়ত চলচ্চিত্রের নামগুলো ছোট হলে ভালো হয়, সুন্দর হয়, যেমন রাজ্জাক, উজ্জল, আলমগীর, শাবানা; নাম ছোট হলে ক্যাচি হয়।’ এরপর ফারুক নামেই অভিনয় জগতে তার পথচলা শুরু হয়। তার অভিনীত ‘মিয়াভাই’ নামে একটি সিনেমা বেশ দর্শকপ্রিয়তা পায়। ব্যবসাসফলও হয়। সেই সিনেমার নাম ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ফারুক। তারপর থেকে বাস্তবে তাকে কেউ কেউ ‘মিয়াভাই’ নামে ডাকতে শুরু করেন।

মামলা থেকে বাঁচতে অভিনয়ে

৬৯-এর গণ-অভ্যুত্থানের পর ৩৭টি মামলা হয় ফারুকের বিরুদ্ধে। এক পর্যায় ফারুক শুনতে পান তাকে মেরে ফেলা হবে। মামলা থেকে রেহাই পেতে ও বেঁচে থাকার জন্য সিদ্ধান্ত নেন তিনি অভিনয়ে যোগ দেবেন। তার ধারণা ছিল অভিনয় করলে মানুষ চিনবে জানবে, এতে তার জনপ্রিয়তা বাড়বে। যার ফলে তার বিরুদ্ধে কিছু করতে গেলে সেটা সহজেই করা যাবে না। সে থেকেই তার অভিনয়ে আসা। এখানেই শেষ নয়। ‘জলছবি’ সিনেমায় অভিনয় করতে গিয়ে পড়েন আরেক বিপাকে। এ সিনেমার নায়িকা প্রয়াত কবরীকে কেউ জানায়, ফারুক একজন মাস্তান। ভালো ছেলে না। সে জন্য তার সঙ্গে অভিনয় করতে রাজি ছিলেন না কবরী। তবে ফারুক অনেকটা জোর করে বুঝিয়ে শুনিয়ে কবরীকে অভিনয় করতে বাধ্য করেন।

প্রখ্যাতদের সঙ্গে আড্ডা

ফারুকের জন্ম মানিকগঞ্জের ঘিওরের এক গ্রামে হলেও সেখানে বেশি দিন থাকেননি। তিনি বেড়ে উঠেছেন পুরান ঢাকায়। এখানেই তিনি পেয়েছেন পরিচালক এইচ আকবর, এ টি এম শামসুজ্জামান, প্রবীর মিত্রর মতো নির্মাতা-শিল্পীদের। তাদের সঙ্গেই ছিল তাদের চলাফেরা, আড্ডা। সে সময় লালকুঠিতে নাটক প্রদর্শিত হতো। নাটক শেষে শিল্পী, নির্মাতাদের সেখানেই আড্ডা দিতেন ফারুক।

শিল্পীদের জন্য ছিলেন দায়িত্বশীল

অসুস্থ হয়ে সিঙ্গাপুরে যাওয়ার আগ পর্যন্ত চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বায়ক হিসাবে দায়িত্ব পালন করেছেন ফারুক। তার নেতৃত্বগুণ ছিল চোখে পড়ার মতো। সেটা তিনি রাজনীতির মাঠেও দেখিয়েছেন। অভিনেত্রী রোজিনার বয়ানে জানা যায়, ঢাকার বারিধারা নামে নতুন একটি আবাসন হলো। সেখানে শিল্পীদের জন্য প্লট বরাদ্দ চলছিল। ফারুক রোজিনাকে ফোন করে বললেন, ‘২৫ হাজার টাকা পাঠা। বারিধারায় প্লট কিনব তোর জন্য।’ রোজিনা বললেন, ‘টাকা তো প্রযোজকদের কাছ থেকে নিতে হবে।’ এরপর ফারুক নিজ উদ্যোগেই প্রযোজকদের সঙ্গে যোগাযোগ করে টাকা নিয়ে রোজিনার জন্য প্লটের আবেদন করে দিলেন। কিন্তু সে প্লট পাননি। পরে রোজিনার জন্য উত্তরায় প্লটের ব্যবস্থা করেন। বর্তমানে সেখানেই থাকছেন রোজিনা।

রাজ্জাক-ফারুক দ্বন্দ্ব

সিনেমাপাড়ায় কথিত ছিল নায়করাজ রাজ্জাক ও নায়ক ফারুকে মধ্যে দ্বন্দ্ব ছিল। একবার নাকি রাজ্জাক ফারুকের গায়েও হাত তুলেছিলেন। ‘সখী তুমি কার’ সিনেমার মাধ্যমে তাদের মধ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয়। তখন নাকি রাজ্জাক এ সিনেমায় ফারুকের অনেক দৃশ্য ফেলে দিতে পরিচালককে চাপ দিয়েছিলেন। যদিও জীবদ্দশায় এক সাক্ষাৎকারে রাজ্জাক বিষয়টি অস্বীকার করেছিলেন। তিনি বলেছেন, ‘পরিচালক যেটা ভালো মনে করেছেন সেটা করেছেন। আর ফারুকের সঙ্গে আমার বিশেষ কোনো দ্বন্দ্ব ছিল না। প্রফেশনালি যেটা ছিল সেটা সবার মধ্যেই থাকে।’ তবে রাজ্জাক-ফারুক দ্বন্দ্বের অবসান ঘটে ‘পৃথিবী তোমার আমার সিনেমার মাধ্যমে। দ্বন্দ্ব কেটে যাওয়ার পর দুজনার মধ্যে এমন বন্ধুত্ব হয় যে, ফারুক রাজ্জাকের বাসার কাছাকাছি বাসা নেয় এবং রাজ্জাকও প্রায়ই ভোরে ফারুককে ঘুম থেকে ডেকে ফজর নামাজ পড়ার জন্য মসজিদে নিয়ে যেতেন।

চিকিৎসা খরচ বহন করতে গিয়ে নিঃস্ব ফারুকের পরিবার

ফারুকের দীর্ঘমেয়াদি চিকিৎসার খরচ বহনের জন্য বিক্রি করতে হয়েছিল প্রায় পনেরো কোটি টাকা মূল্যের দুটি ফ্ল্যাট। রাজধানীর বারিধারায় এ দুটি ফ্ল্যাট কেনার পর একদিনও থাকার সৌভাগ্য হয়নি তার পরিবারের। পাশাপাশি স্বজনদের কাছ থেকেও ধার-দেনা করতে হয়েছিল। ফারুকের স্ত্রী ফারহানা পাঠান গত বছরই এমন তথ্য জানিয়েছিলেন। তিনি জানান, সিঙ্গাপুর মাউন্ট এলিজাবেথে চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল, সে জন্য সম্পত্তি বিক্রি করতে হয়েছে আমাদের। চিকিৎসকরা যখন ফারুককে আইসিইউতে রাখার পরামর্শ দেন ওই সময় আমাদের হাত ছিল একেবারে খালি। করোনার কারণে ফ্ল্যাটও বিক্রি করতে পারছিলাম না। তখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। তার দেওয়া টাকা দিয়েই আইসিইউর প্রথম মাসের বিল পরিশোধ করেছি।

সিনেমার চরিত্র নিয়ে ফারুকের ক্ষোভ

অভিনয় ক্যারিয়ারে বেশিরভাগ সিনেমায় গ্রামীণ চরিত্রে দেখা গেছে ফারুককে। গ্রামীণ চরিত্রে অনবদ্য হলেও এ ধরনের চরিত্রের প্রতি তার ক্ষোভও ছিল। সেটাও তিনি আরেক সাক্ষাৎকারে বলেছিছেন। তিনি বলেন, ‘যখন দেখা গেল কোনো একটি সিনেমায় আমি গ্রামীণ চরিত্রে ভালো করেছি, সিনেমাটি হিট হয়েছে তখন সবাই আমাকে দিয়ে এ ধরনের চরিত্রে অভিনয়ের জন্য উঠেপড়ে লাগত। হয়েছেও তাই। বিষয়টি নিয়ে আমি খুব বিরক্ত হতাম। চেষ্টা করতাম খোলস ছেড়ে বেরিয়ে আসতে। কিন্তু দিনশেষে প্রযোজক পরিচালকদের ইচ্ছার পাশাপাশি দর্শকদের পছন্দটাকেও প্রাধান্য দিতে হতো।’

শাকিবের নিষেধাজ্ঞা মিটিয়েছিলেন ফারুক

২০১৭ সালে যখন শাকিবকে চলচ্চিত্রের সব সংগঠন কর্তৃক বহিষ্কার করা হয়, তখন এ দ্বন্দ্ব মিটিয়েছিলেন ফারুক। তিনি চলচ্চিত্র পরিবারের আহ্বাহক হিসাবে দায়িত্ব নিয়েছিলেন শাকিবের। এক সাংবাদিক ও এক প্রযোজকের ডাকে সাড়া দিয়ে শাকিবকে ক্ষমা করে দেন ফারুকসহ চলচ্চিত্রের সব সংগঠনের নেতা। তারপর শাকিব আবারও তার কাজ স্বাভাবিকভাবে শুরু করার সুযোগ পান।

কালীগঞ্জে চিরনিদ্রায় শায়িত অভিনেতা ফারুক

========================================

অবশেষে ৮০৩ দিন পর দেশের মাটিতে এলেন বীর মুক্তিযোদ্ধা, কিংবদন্তি অভিনেতা ও সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক। তবে জীবিত নয়, মৃত।

২০২১ সালের ৪ মার্চ সিঙ্গাপুর গিয়েছিলেন উন্নত চিকিৎসার জন্য। দুই বছরেরও বেশি সময় ধরে সেখানে চিকিৎসা করিয়েছেন। কিন্তু শেষ রক্ষা হয়নি। তার মৃতদেহ নিয়েই দেশের মাটিতে ফিরেছেন স্বজনরা। ১৫ মে বাংলাদেশ সময় সকাল ১০টায় সিঙ্গাপুরের একটি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান তিনি।

মঙ্গলবার সকাল ৭টা ৫০ মিনিটে সিঙ্গাপুর থেকে একটি ফ্লাইটে শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে তার মরদেহ আসে। সেখান থেকে নেওয়া হয় তার উত্তরার বাসভবনে। এরপর সকাল ১১টা ৫০ মিনিটে নেওয়া হয় কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে।

এ সময় সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের আয়োজনে ফারুককে রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও স্পিকারের প্রতিনিধি, রাজনৈতিক নেতা, বিভিন্ন সংগঠনের কর্মীসহ নানা পেশার মানুষ ফুলেল শ্রদ্ধা জানান।

শহীদ মিনারে শুরুতে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনের পক্ষে লে. কর্নেল সৈয়দ মুহাম্মদ জাহাঙ্গীর আলম ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান। এরপর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে শ্রদ্ধা জানান তার সামরিক সচিব মেজর জেনারেল কবীর আহাম্মদ। স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর পক্ষে শ্রদ্ধা জানান সংসদ সচিবালয়ের সার্জেন্ট অ্যাট আর্মস এম এম নাঈম রহমান।

আওয়ামী লীগের পক্ষে দলটির সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের নেতৃত্বে দলের নেতারা ফারুকের মরদেহে শ্রদ্ধা জানান।

এছাড়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য মো. আখতারুজ্জামান, মহানগর আওয়ামী লীগ, ছাত্রলীগ, বঙ্গবন্ধু সাংস্কৃতিক জোট, গ্রুপ থিয়েটার ফেডারেশনসহ নানা রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে ফারুককে শ্রদ্ধা জানানো হয়।

অভিনয়শিল্পীদের মধ্যে শ্রদ্ধা জানাতে শহীদ মিনারে উপস্থিত ছিলেন ইলিয়াস কাঞ্চন, ফেরদৌস, মিশা সওদাগর, নিপুণ, জায়েদ খানসহ আরও অনেকে।

শহীদ মিনারের আনুষ্ঠানিকতা শেষে ফারুকের মরদেহ নেওয়া হয় তার দীর্ঘদিনের কর্মস্থল এফডিসিতে। সেখানে দ্বিতীয় জানাজা (সিঙ্গাপুরে প্রথম জানাজা অনুষ্ঠিত হয়) শেষে তাকে শেষবারের মতো বিদায় জানান সহকর্মী শিল্পী, নির্মাতা, প্রযোজক ও কলাকুশলীরা। এরপর চ্যানেল আই প্রাঙ্গনে ফারুকের তৃতীয় নামাজে জানাজা অনুষ্ঠিত হয়।

বিকালে গুলশানের আজাদ মসজিদে তার আরও একটি জানাজা শেষে মরদেহ নিয়ে যাওয়া হয় ফারুকের গ্রামের বাড়ি গাজীপুরের কালীগঞ্জে। রাত ৯টার পর সেখানকার পারিবারিক কবরস্থানে চিরনিদ্রায় শায়িত হন এই কিংবদন্তি।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *