বৈশ্বিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশীয় সামষ্টিক অর্থনীতিতে চলমান সংকটের নেতিবাচক প্রভাব আরও দীর্ঘায়িত হচ্ছে। এর মধ্যে মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভে চাপ ও বিনিময় হারে অস্থিতিশীলতার প্রভাব বাড়ছে। উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের প্রকৃত সুদের হার ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। যা আমানতকারীদের ব্যাংকে টাকা রাখতে নিরুৎসাহিত করে। ত্বরিতগতিতে এসব সমস্যার সমাধান না করলে দীর্ঘমেয়াদে সামষ্টিক অর্থনৈতিক কার্যক্রম ব্যাহত হবে বলে আশঙ্কা করা যাচ্ছে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ‘মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত ত্রৈমাসিক এক প্রতিবেদনে এ আশঙ্কার কথা বলা হয়েছে। অক্টোবর-ডিসেম্বর-২০২৩ প্রান্তিকের প্রতিবেদনটি বৃহস্পতিবার প্রকাশিত হয়েছে। অন্য সময়ের চেয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে অনেক বেশি নেতিবাচক কথাবার্তা যেমন বলেছে, তেমনি আশার বাণীও শুনিয়েছে। আগে শুধু আশাবাদই প্রকাশ করা হতো, নেতিবাচক দিকগুলো আড়াল করা হতো। আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিলের (আইএমএফ) সঙ্গে সরকারের ঋণচুক্তির শর্ত হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক এখন দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি আগের চেয়ে বেশি নিখুঁতভাবে উপস্থাপন করছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বিদ্যমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের দ্বিতীয়ার্ধের জন্যও সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ করা হচ্ছে। এতে মূল্যস্ফীতির হার কমে আসছে। বর্তমানে সামষ্টিক অর্থনৈতিক অবস্থার প্রেক্ষাপটে দেশজ প্রবৃদ্ধির গতিশীলতা বজায় রাখার পাশাপাশি দ্রব্যমূল্যের স্থিতিশীলতা আনয়নের জন্য সরকারের নীতি পদক্ষেপ অনুসরণ ও প্রয়োজনীয় সমন্বয় সাধনের মাধ্যমে কেন্দ্রীয় ব্যাংক কার্যকর ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে। সাম্প্রতিক বৈশ্বিক সংকটময় পরিস্থিতিতে অর্থনীতির অগ্রাধিকার খাত যেমন- কৃষি, রপ্তানিমুখী শিল্প, আমদানি বিকল্প শিল্প ও কুটির, ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পে (সিএমএসএমই) খাতে অবাধ ঋণ প্রবাহ নিশ্চিত করার পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণের মাত্রা কমানো, তারল্য সংকট হ্রাস, ব্যাংকিং খাতে দায় সম্পদের ভারসাম্যহীনতা রোধ এবং কাক্সিক্ষত অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জনের লক্ষ্যে পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশ ব্যাংক ও সরকারের সমন্বিত প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে।
প্রতিবেদন থেকে পাওয়া তথ্যে দেখা যায়, চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত অর্থনীতির প্রধান সূচকগুলোতে অস্থিরতার প্রভাব দীর্ঘায়িত হচ্ছে। একই সঙ্গে অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করতে যেসব লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে সেগুলোর বেশিরভাগই অর্জিত হয়নি। এমন কী গত বছরের তুলনায়ও অগ্রগতি কম হয়েছে। টাকার প্রবাহ, অভ্যন্তরীণ ঋণ, বেসরকারি ঋণ, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ বাড়ানো, মূল্যস্ফীতির হার কমানোর মতো অর্থনীতির প্রধান সূচকের কোনো খাতেই লক্ষ্যমাত্রা অর্জিত হয়নি।
চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর পর্যন্ত বাজারে টাকার প্রবাহ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৯ দশমিক ৫০ শতাংশ। এর বিপরীতে বেড়েছে ৮ দশমিক ৬০ শতাংশ। যা লক্ষ্যমাত্রার তুলনায় দশমিক ৯০ শতাংশ কম। গত অর্থবছরের একই সময়ে টাকার প্রবাহ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৪৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের তুলনায়ও টাকার প্রবাহ বেশি হলেও ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়ন ও মূল্যস্ফীতি বাদ দিলে প্রবৃদ্ধির হার ঋণাত্মক হচ্ছে।
এর কারণ হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক বলেছে, ডলারের আয় কমে যাওয়ায় নিট বৈদেশিক সম্পদ হ্রাস পেয়েছে। ডলার সাশ্রয় করতে আমদানি ব্যয় কমানো হয়েছে। এ কারণে টাকার প্রবাহ বেড়েছে কম।
চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বরে পর্যন্ত অভ্যন্তরীণ ঋণ বাড়ানোর লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১৬ দশমিক ৯০ শতাংশ। এর বিপরীতে বেড়েছে ১১ দশমিক ৮৯ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে বেড়েছিল ১৪ দশমিক ৯৮ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা এবং গত বছরের তুলনায় এ খাতের প্রকৃত প্রবৃদ্ধি কম হয়েছে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি কম হওয়ায় মোট অভ্যন্তরীণ ঋণের প্রবৃদ্ধি কমছে।
ডিসেম্বর শেষে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ দশমিক ৯০ শতাংশ। ওই সময়ে অর্জিত হয়েছে ১০ দশমিক ১৩ শতাংশ। গত বছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ১২ দশমিক ৮৯ শতাংশ। লক্ষ্যমাত্রা ও গত বছরের তুলনায় এ খাতের ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি প্রতিরোধে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি গ্রহণ করার ফলে ঋণের প্রবৃদ্ধি কমেছে বলে প্রতিবেদনে মন্তব্য করা হয়েছে। তবে অধিকতর উৎপাদনমুখী খাত যেমন- কৃষি, সিএমএসএমই ও আমদানি বিকল্প খাতে প্রয়োজনীয় ঋণ সরবরাহ অব্যাহত রাখার কারণে বেসরকারি খাতে ঋণের প্রবৃদ্ধি লক্ষ্যমাত্রার প্রায় কাছাকাছি রয়েছে।
ডিসেম্বর শেষে ব্যাংক ব্যবস্থা থেকে গৃহীত সরকারের পুঞ্জীভূত নিট ঋণের স্থিতি ১৯ দশমিক ৭৭ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। যা আগের বছরের একই সময় শেষে ২৫ দশমিক ১৯ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছিল। চলমান সামষ্টিক অর্থনৈতিক সংকটাবস্থা বিবেচনায় সরকারের গৃহীত কৃচ্ছ্রসাধন নীতির ফলে আলোচ্য সময়ে ব্যাংক ব্যবস্থা হতে সরকারি খাতে প্রদত্ত ঋণের পরিমাণ কিছুটা হ্রাস পেয়েছে।
সাম্প্রতিক সময়ে খাদ্য মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমলেও খাদ্যবহির্ভূত খাতের বিশেষ করে পোশাক ও স্বাস্থ্যসেবা পণ্যের মূল্য বাড়ায় সার্বিক মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। মূলত পরিবহণ খরচ বৃদ্ধি, অভ্যন্তরীণ পণ্য মূল্য সমন্বয়হীনতা এবং ডলারের বিপরীতে টাকার অবমূল্যায়নের কারণে মূল্যস্ফীতির হার বাড়ার ক্ষেত্রে মূল ভূমিকা রেখেছে।
এদিকে বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্যে দেখা যাচ্ছে, ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড় মূল্যস্ফীতির হার বেড়েই চলেছে। তবে পয়েন্ট ভিত্তিতে মূল্যস্ফীতির হার ডিসেম্বরে কিছুটা কমার পর জানুয়ারিতে আবার বেড়েছে। ফেব্রুয়ারিতে এসে সামান্য কমেছে। ২০২১ সালের জুনে মূল্যস্ফীতির হার ছিল ৫ দশমিক ৬৪ শতাংশ। ২০২২ সালের জুনে তা বেড়ে দাঁড়ায় ৭ দশমিক ৫৬ শতাংশ। ওই বছরের সেপ্টেম্বরেই মূল্যস্ফীতির হার ৯ শতাংশ অতিক্রম করে। যা এখনও অব্যাহত। ফেব্রুয়ারিতে এ হার ছিল ৯ দশমিক ৬৭ শতাংশ।
এদিকে ব্যাংকে আমানতের গড় সুদহার ৫ শতাংশের নিচে। যা মূল্যস্ফীতির হারের তুলনায় অর্ধেক কম। ফলে মূল্যস্ফীতির কারণে আমানতের সুদ হার ঋণাত্মক হয়ে পড়েছে। এ পরিস্থিতি ব্যাংকে আমানত রাখতে আমানতকারীদের নিরুৎসাহিত করে।
সূত্র জানায়, বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ গড় হিসাবে এখনও নিæমুখী রয়েছে। বড় কোনো দেনা পরিশোধ করলেই রিজার্ভ কমে যাচ্ছে। রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স বাড়লেও রিজার্ভ বাড়ছে না। চলতি অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত রেমিট্যান্স বেড়েছে ৭ দশমিক ৬১ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে যা বেড়েছিল ৪ দশমিক ২৭ শতাংশ। একই সময়ে রপ্তানি আয়ের প্রবৃদ্ধি কমেছে। গত অর্থবছরের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত প্রবৃদ্ধি হয়েছিল ৯ দশমিক ৫৬ শতাংশ। চলতি অর্থবছরের একই সময়ে প্রবৃদ্ধি হয়েছে ৩ দশমিক ৭১ শতাংশ। তবে গত ৩ মাস ধরে রপ্তানি আয় প্রতি মাসে ৫০০ কোটি ডলারের বেশি আসছে।
এদিকে ব্যয়ে কঠোর লাগাম টানার ফলে চলতি অর্থবছরের জানুয়ারি পর্যন্ত ব্যয় কমেছে ১৮ দশমিক ১৭ শতাংশ। গত অর্থবছরের একই সময়ে কমেছিল ৫ দশমিক ৬৭ শতাংশ। সাম্প্রতিক সময়ে স্বল্প ও মধ্যমেয়াদি বৈদেশিক ঋণের প্রবাহ বাড়ছে। এতে ডলারের প্রবাহ কিছুটা বেড়েছে। তবে বাজারের চাহিদা অনুযায়ী ডলার মিলছে না। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের চাপ বাড়ায় এমনটি হচ্ছে। এতে রিজার্ভ কমে ১ হাজার ৯৪৫ কোটি ডলারে নেমেছে। রিজার্ভ কমায় ডলারের ওপর চাপ বাড়ছে। এতে টাকার মান কমে যাচ্ছে। যা মূল্যস্ফীতির হার উসকে দিচ্ছে।