অর্থনীতি

আজ বিশ্ব মান দিবস, বাজার সয়লাব ভেজাল পণ্যে

তদারকি প্রতিষ্ঠানগুলোর তদারকি কে করবে ?

ভেজাল ও মানহীন পণ্যে সয়লাব বাজার। প্রক্রিয়াজাত খাবার, ফলমূল, কসমেটিকসসহ মানুষের জীবন ধারণে ব্যবহৃত অধিকাংশ পণ্য ভেজালে ভরা। মানহীন তো বটেই। এমনকি বিষাক্ত কেমিক্যাল থাকা যেন সাধারণ বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। কিন্তু এসব যাদের দেখার কথা তাদের দায় ও দায়িত্ব নিয়েই রয়েছে এন্তার প্রশ্ন। যদিও এসব নিয়ে প্রশ্ন তুললে সংশ্লিষ্ট দায়িত্বশীল প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে দেওয়া হয় দায়সারা জবাব। গৎবাঁধা অজুহাত থাকে-জনবল সংকট। অনেক সময় পর্যাপ্ত আইন না থাকার বিষয়টিও সামনে আনা হয়।

এদিকে এত্তসব প্রশ্নের বোঝা মাথায় নিয়ে আজ পালিত হচ্ছে ৫৬তম বিশ্বমান দিবস। দিনটি পালনে নানা কর্মসূচির আয়োজন করেছে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্ডস অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশন (বিএসটিআই)। দিবসটির এবারের প্রতিপাদ্য : ‘সমন্বিত উদ্যোগে টেকসই উন্নত বিশ্ব বিনির্মাণে মান।’ বাস্তবতা হলো-এগুলো কাগুজে ভাষা। কাজের কাজ তেমন কিছুই হয় না। দিবস আসলে বক্তৃতা-বিবৃতি দিয়ে ফাঁকা আওয়াজ তোলা হয়। ব্যর্থতার কথা স্বীকার না করলেও কাছে বিএসটিআই তাদের সাফল্য সম্পর্কে দাবি জানিয়ে বলেছে, গত এক বছরে প্রতিষ্ঠানটি ১ হাজার ১০২টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এসব অভিযানে ২ কোটি ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকার জরিমানা করা হয়েছে।

জানতে চাইলে বিএসইটিআইর পরিচালক (সিএম) মো. সাইফুল ইসলাম রোববার বলেন, পণ্য ও সেবার মান নিয়ন্ত্রণে বিএসটিআই কাজ করছে। কিন্তু অসৎ ব্যবসায়ীদের নিত্যনতুন কৌশলের কাছে তাদের হার মানতে হচ্ছে। এ অবস্থা উত্তরণে সবাইকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন, বর্তমানে সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো বিদেশি ভেজাল স্ক্রিন কেয়ার পণ্য অবৈধভাবে দেদার দেশে আসছে। এগুলো ঠেকানো কঠিন হয়ে যাচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বিদেশি অন্যান্য কসমেটিকসজাতীয় পণ্যও বেশি আসে। এসব পণ্যে অতিরিক্ত পরিমাণ হাইডোকুনান ও মার্কারিজাতীয় কেমিক্যাল থাকে, যা ত্বকের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সাইফুল ইসলাম বলেন, বৈধভাবে এসব পণ্য এলে তা পরীক্ষা করে মান নিশ্চিতের মাধ্যমে বিএসটিআইর লোগো ব্যবহারের অনুমোদন দেওয়া হয়। কিন্তু বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই এগুলো পাচার হয়ে অবৈধভাবে দেশে আসে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি জানান, বিএসটিআইর লোগো ব্যবহারের জন্য আবেদন করতে হয়। এরপর পণ্যের মান যাচাই-বাছাই করে আমরা অনুমোদন দিয়ে থাকি।

বিএসটিআই আইন-২০১৮ এর ইনস্টিটিউশনের কার‌্যাবলিতে বলা আছে, স্থানীয় ব্যবহার, রপ্তানি বা আমদানি, যাহোক না কেন, পণ্যসামগ্রী, মালামাল, উৎপাদিত পণ্য এবং খাদ্যসামগ্রীসহ অন্যান্য দ্রব্যের গুণগত মান প্রত্যয়ন করা বিএসটিআইয়ের অন্যতম কাজ। প্রয়োজনের তুলনায় এই আইনের প্রয়োগ অত্যন্ত কম। এক্ষেত্রে বিএসটিআইর নানা সীমাবদ্ধতা রয়েছে। বিদ্যমান আইন অনুসারে দেশে কোনো পণ্য বাজারজাত করার আগে বিএসটিআইর অনুমোদন নেওয়া বাধ্যতামূলক। সংস্থাটির প্রধান কাজ হলো-বিভিন্ন পণ্য, সেবা, প্রক্রিয়া, ওজন এবং পরিমাপের মান নিয়ন্ত্রণ করা। এর মধ্যে রয়েছে-শিল্পপণ্য, খাদ্যদ্রব্য, বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম এবং কৃষিজাত পণ্যের জন্য জাতীয় মান তৈরি করা। দ্বিতীয়ত, প্রণীত মান অনুযায়ী পণ্যের গুণগত মান পরীক্ষা করা। মানসম্মত পণ্যকে গুণগত মান সনদ এবং লাইসেন্স প্রদান করা। এছাড়া উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠানগুলোকে গুণগত মান বজায় রাখতে সহায়তা করা এবং তাদের কার্যক্রম তদারকি করে এ প্রতিষ্ঠান।

খাদ্য : দেশে বিভিন্ন ধরনের বিপুল পরিমাণ খাদ্যপণ্যে ভেজাল পাওয়া যাচ্ছে। ভেজাল খাদ্য তৈরিতে রাসায়নিক থেকে শুরু করে ভারী ধাতব পদার্থের মতো এমন উপাদান মেশানো হচ্ছে, যা মানবস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর। সরকারি তিনটি প্রতিষ্ঠান বিএসটিআই, নিরাপদ খাদ্য কর্তৃপক্ষ এবং ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের অভিযান-পরবর্তী খাদ্যমান ও বিশুদ্ধতা যাচাই পরীক্ষায় এসব তথ্য উঠে এসেছে। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, মাঠ পর্যায়ে সঠিক ও নিয়মিত তদারকির অভাবে একশ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী উৎপাদন থেকে শুরু করে বাজারজাত করা পর্যন্ত ক্ষতিকর উপাদান মিশিয়ে ভেজাল খাদ্য তৈরি করছে, যার একমাত্র লক্ষ্য অতিমুনাফা। জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ভেজাল খাদ্যে থাকা রাসায়নিক ও ধাতব পদার্থের প্রভাবে কিডনি-লিভারসহ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে ক্যানসারের মতো জটিল রোগ। সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর তথ্য অনুযায়ী খাদ্যে প্রচুর পরিমাণে ভেজাল মেশানো হচ্ছে। ভোক্তা অধিকার নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষে বলা হচ্ছে, খাদ্যে ভেজাল মেশানো ব্যক্তিদের কঠোর শাস্তির আওতায় নিয়ে আসতে হবে। তারা বিচার ও শাস্তির ঊর্ধ্বে থেকে যাচ্ছে বলে ভেজাল রোধ করা সম্ভব হচ্ছে না।

কসমেটিকস : দেশে কিছু অসাধু চক্রের সমন্বয়ে নকল, ভেজাল ও মানহীন কসমেটিকস পণ্য উৎপাদন হচ্ছে। রাজধানী ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজার, কেরানীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, গাজীপুর ও মানিকগঞ্জসহ দেশের বিভিন্ন এলাকায় রয়েছে নকল কসমেটিকস তৈরির কারখানা। চরম গোপনীয়তার সঙ্গে এসব কারখানায় চলে নকল পণ্য উৎপাদনের মহোৎসব। এরপর তা ছড়িয়ে দেওয়া হয় ঢাকাসহ সারা দেশে। পুরান ঢাকার চকবাজার, মৌলভীবাজারসহ বিভিন্ন মার্কেটে প্রকাশ্যেই বিক্রি হয় বিভিন্ন নামিদামি ব্র্যান্ডের নকল প্রসাধনী। ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে প্রায়ই এসব স্থানে অভিযান পরিচালনা করে জরিমানাও করা হয়। কিন্তু বন্ধ হয় না। অপরদিকে বিদেশ থেকে চোরাইপথে দেশে বিপুল পরিমাণ মানহীন প্রসাধনী প্রবেশ করছে। অবৈধভাবে কিংবা লাগেজে যেসব পণ্য আসছে, তাতে কোথাও আমদানিকারকের কোনো তথ্য থাকে না, থাকে না বিএসটিআইর লোগো। বিএসটিআই জানায়, গত এক বছরে সারা দেশে ১ হাজার ১০২টি অভিযান পরিচালনা করেছে। এ সময় ২ কোটি ৫৩ লাখ ৭৬ হাজার টাকা জরিমানা করা হয়। ঢাকায় শুধু প্রধান কার্যালয় থেকে ২২৩টি মামলা পরিচালনা করা হয়েছে। জরিমানা আদায় করা হয় ৭৬ লাখ ৩৭ হাজার টাকা।

বিশ্বমান দিবস : বিশ্বমান দিবসকে সামনে রেখে অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও বিভিন্ন কর্মসূচির মধ্য দিয়ে দিবসটি পালন করা হচ্ছে। এ বছর জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) ১৭-কে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ উপলক্ষ্যে বিএসটিআই বিভিন্ন কর্মসূচি নিয়েছে। এসব কর্মসূচির মধ্যে রয়েছে-আলোচনা সভা, প্রচার-প্রচারণা এবং মোবাইল ফোনে খুদে বার্তার মাধ্যমে মানুষকে সচেতন করা। রাজধানীর বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে ব্যানার, ফেস্টুন ও প্ল্যাকার্ড লাগানো হয়েছে। রাজধানীর কৃষিবিদ ইনস্টিটিউটে আজ সেমিনার করবে বিএসটিআই। সেখানে শিল্পসচিব ও ব্যবসায়ী নেতাসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট দপ্তরের কর্মকর্তারা উপস্থিত থাকবেন।

বিএসটিআইর প্রধান কার্যালয়ের পাশাপাশি বিভাগীয় ও জেলা পর্যায়েও পালিত হবে নানা কর্মসূচি। বিএসটিআই থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, বিশ্বব্যাপী টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যকে (এসডিজি) প্রাধান্য দিয়ে ২০৩০ সাল পর্যন্ত একই প্রতিপাদ্যে মান দিবস পালিত হবে। বিশ্বায়নের যুগে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মূলে রয়েছে স্বয়ংক্রিয় যন্ত্র ব্যবস্থা, রোবোটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। এ ধরনের প্রযুক্তি মানুষের জীবনব্যবস্থাকে করেছে আরও উন্নত, সহজতর, নিরাপদ ও সুরক্ষিত। এই পরিবর্তনের সঙ্গে নিজেদের টিকিয়ে রাখতে আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন পণ্য ও সেবা নিশ্চিতের কোনো বিকল্প নেই।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *