ইউক্রেইন যুদ্ধ বাধিয়ে গোটা বিশ্বের মনযোগ নিজের দিকে টেনে নেওয়া ভ্লাদিমির পুতিনকে নিয়ে ধন্দে পড়ে গেছেন পশ্চিমা গোয়েন্দারা।
পুতিন নিজের বানানো বদ্ধ জগতে নিজেই আটকা পড়েছেন কিংবা নিজেই নিজেকে উন্মাদ হিসাবে তুলে ধরে তা নিয়ে খেলতে পারেন, উন্মাদের মতো ব্যবহার করে বসতে পারেন হাতে থাকা পারমাণবিক অস্ত্র- এমন সব ধারণা আর তা নিয়ে উদ্বেগে গোয়েন্দারা হচ্ছেন গলদঘর্ম।
পুতিনের মাথায় আসলেই কী চলছে? তিনি কী করতে চাইছেন? পশ্চিমা গোয়েন্দারা তা মরিয়া হয়ে বোঝার চেষ্টা করছেন। তারা পুতিনের মাথার ভেতর ঢুকতে চাইছেন, বুঝতে চাইছেন তার পরবর্তী পদক্ষেপ কী হতে পারে। বর্তমান সংকট যেন আরও বিপজ্জনক মোড় না নেয় সেজন্য পুতিনের মনের অবস্থা বুঝতে পারাটা তাদের কাছে এখন ভীষণ জরুরি।
এরই মধ্যে ইউক্রেইন যুদ্ধের নেতিবাচক প্রভাব বিশ্বজুড়ে পড়তে শুরু করেছে। পুতিনকে থামাতে রাশিয়ার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে পশ্চিমাবিশ্ব নিজেরাই এখন দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতির চাপে পড়েছে। বলা হচ্ছে, পুতিন হয়ত ভবিষ্যত পৃথিবীর নকশাই বদলে দেবেন।
রাশিয়া যখন ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরু করেছিল তখন অধিকাংশের ধারণা ছিল, বিশ্বের সবচেয়ে শক্তিধর সেনাবাহিনীর অন্যতম রুশ বাহিনীর সামনে ইউক্রেইনীয় বাহিনী খুব বেশি প্রতিরোধ গড়তে পারবে না।
কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে, রুশ বাহিনীর গতি ধারণার থেকে অনেক ধীর। যুদ্ধের প্রায় এক মাস হতে চলেছে এবং এখন পর্যন্ত ইউক্রেইন নিজেদের স্বল্প সক্ষমতা নিয়েও রুশ বাহিনীকে খুব ভালোভাবে প্রতিরোধ করে যাচ্ছে।
বরং ইউক্রেইন যুদ্ধে গিয়ে রুশ সেনাদের খাদ্য, জ্বালানি এবং গোলাবারুদের সংকটে পড়তে হচ্ছে। সেখানে তাদের হতাহতের সংখ্যাও নেহাত কম নয়।
এই যে ইউক্রেইনে গিয়ে রাশিয়ার সেনাবাহিনীর ফাঁদে আটকা পড়ে যাওয়ার মত অবস্থা তৈরি হয়েছে, তা পুতিনের উপর চাপ বাড়াচ্ছে। চাপে পড়ে তিনি কী ধরনের সিদ্ধান্ত নিতে পারেন সেটা জানতেও তাকে বুঝতে পারাটা জরুরি।
কয়েক দিন আগে ব্রিটিশ মিডিয়ায় পুতিনের অসুস্থতা নিয়ে বেশ মাতামাতি হয়েছিল। হয়ত সেটি অপপ্রচার, ক্রেমলিন থেকে এখন পর্যন্ত এসব নিয়ে কোনও মন্তব্য করা হয়নি। বিশেষজ্ঞদের বিশ্বাস, পুতিন আসলে নিজেকে অন্যদের থেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। এর মাধ্যমে তিনি বিকল্প মত তার কাছে পৌঁছানোর রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছেন।
সম্প্রতি পুতিনের বেশকিছু ছবি অনলাইনে ভাইরাল হয়। যেগুলোতে তাকে লম্বা টেবিলের একপ্রান্তে বসে অন্যদের সঙ্গে বৈঠক করতে দেখা যায়। শুধু ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁর সঙ্গেই নয় বরং ইউক্রেইনে আগ্রাসন শুরুর আগের দিন তিনি নিজের জাতীয় নিরাপত্তা দলের সঙ্গে যে বৈঠক করেছেন সেখানেও একই চিত্র দেখা গেছে।
পশ্চিম এক গোয়েন্দা কর্মকর্তা বিবিসি-কে এর ব্যাখ্যায় বলেন, পুতিনের প্রাথমিক সামরিক পরিকল্পনা দেখে মনে হচ্ছে, একজন কেজিবি কর্মকর্তা যা করতেন, তিনিও তাই করছেন। পুতিন নিজে কেজিবি এজেন্ট ছিলেন।
তিনি বলেন, ‘‘ইউক্রেইনে আগ্রাসনের বেলায় পুতিন কেজিবি’র মতো গোপনীয়তার ওপর জোর দিয়ে একটি ফাঁকফোরহীন ‘ষড়যন্ত্রমূলক’ পরিকল্পনা করেছিলেন।
কিন্তু তার ফল হলো চরম বিশৃঙ্খল। রাশিয়ার সামরিক কমান্ডাররা যার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না। এমনকী রাশিয়ার অনেক সেনা তাদেরকে ঠিক কী করতে হবে সেটা না জেনেই ইউক্রেইন সীমান্তে গিয়েছেন।”
একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী
ইউক্রেইন যুদ্ধের বিষয়ে পুতিন একাই সিদ্ধান্ত গ্রহণ করছেন। তাই তার পরবর্তী পদক্ষেপ কি হতে পারে তা জানা গোয়েন্দাদের জন্য ভীষণ কঠিন কাজ।
একসময় রাশিয়ায় সিআইএ’র কর্মকাণ্ড পরিচালনা করতেন জন সিফার। তিনি বলেন, ‘‘ক্রেমলিনের পদক্ষেপ বুঝতে পারা খুবই কঠিন। কারণ, মস্কোয় পুতিন একক সিদ্ধান্ত গ্রহণকারী।”
যুক্তরাজ্যের এমআই৬ এর সাবেক প্রধান জন সাওয়ারস বলেন, ‘‘রাশিয়ার মতো একটি সুরক্ষিত ব্যবস্থায় তাদের নেতার মাথায় কি চলছে সেটা বের করা গোয়েন্দাদের জন্য অত্যন্ত কঠিন কাজ। বিশেষ করে যখন তার কাছের বেশিরভাগ লোকজনও জানেন না কি ঘটতে চলেছে।”
গোয়েন্দা কর্মকর্তারা বলেন, পুতিন তার নিজের তৈরি বাবলের ভেতর নিজেকে বিচ্ছিন্ন করে ফেলেছেন। যেখানে বাইরের খুব কম তথ্যই প্রবেশ করতে পারে। বিশেষ করে ওইসব তথ্য যা তার সিদ্ধান্তকে চ্যালেঞ্জ জানাতে পারে।
মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আড্রিয়ান ফার্নহ্যাম বলেন, ‘‘তিনি (পুতিন) তার নিজের তৈরি প্রপাগান্ডার শিকার। কারণ, তিনি হাতেগোনা কয়েকজনের কথা শোনেন এবং বাকি আর কিছুই তার কাছে পৌঁছাতে পারে না। যে কারণে পৃথিবী সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি খানিকটা অদ্ভুত।”
এখানে একটি ঝুঁকির বিষয় হল, পুতিন এমন একটি দলকে নিয়ে কোনওকিছু চিন্তা-ভাবনা করেন বা সিদ্ধান্ত নেন, যেখানে প্রত্যেকে কেবল তার দৃষ্টিভঙ্গিকেই আরও শক্তিশালী করে। আর “এমন ক্ষেত্রে পুতিনকে বোঝার জন্য তার এই ঘনিষ্ঠ সহচরদের বোঝা জরুরি”, বলেন ফার্নহ্যাম।
পশ্চিমা গোয়েন্দাদের বিশ্বাস, পুতিন যাদের সঙ্গে কথা বলেন, তাদের সংখ্যা কখনওই খুব বেশি ছিল না। ইউক্রেইনে আগ্রাসনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সেই সংখ্যা আরও কমেছে। মুষ্টিমেয় কয়েকজনের মধ্যেই যুদ্ধ-সংক্রান্ত আলোচনা সীমাবদ্ধ ছিল। এই কয়েকজন পুতিনের ‘একান্ত ও ঘনিষ্ঠজন’, যাদের চিন্তাধারাও পুতিনের মতোই।
পুতিনকে যারা পর্যবেক্ষণ করেছেন তারা বলছেন, রুশ নেতা ১৯৯০-এর দশকে সোভিয়েত ইউনিয়ন ভাঙার অপমান ভুলতে পারেননি। তিনি মনে করেন, পশ্চিমারা রাশিয়াকে দাবিয়ে রাখতে চায় এবং তাকে ক্ষমতাচ্যুত করতে চায়।
পুতিনের মানসিক অবস্থা মূল্যায়ন করতে বলা হলে সিআইএ-র পরিচালক উইলিয়াম বার্নস বলেন, ‘পুতিন অনেক বছর ধরেই ধিকি ধিকি জ্বলতে থাকা ক্ষোভ আর উচ্চাকাঙ্ক্ষার সংমিশ্রণে ডুবে আছেন। তাকে বোঝা কঠিন।”
উন্মাদ তত্ত্ব
পুতিন নিজেই তার শৈশবের একটি গল্প শুনিয়েছেন। বালক পুতিন একটি ইঁদুরকে তাড়া করছিলেন। তাড়াতে তাড়াতে ইঁদুরটিকে যখন তিনি কোণঠাসা করে ফেলেন তখন দিশেহারা ইঁদুরটি নিজেকে বাঁচাতে হঠাৎ করেই বালক পুতিনকে উল্টো আক্রমণ করে বসে। ইঁদুরের রুদ্রমূর্তি দেখে সেখান থেকে দৌড়ে পালান তিনি।
পশ্চিমা নীতিনির্ধারকরা বলছেন, চাপের মুখে এখন যদি পুতিন নিজে কোণঠাসা অনুভব করেন তবে তিনি কী করবেন?
এক পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, ‘‘প্রশ্ন হচ্ছে, সেক্ষেত্রে তিনি কী আরও নিষ্ঠুর হয়ে উঠবেন এবং দ্বিগুণ বেগে আক্রমণ করবেন? তিনি তার বাহিনীকে যেসব অস্ত্র প্রস্তুত রাখতে বলেছেন সেগুলো ব্যবহার করে বসবেন কী?”
উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে পুতিনের হাতে পরমাণু অস্ত্র এবং রাসায়নিক অস্ত্র দুটোই আছে। মনোবিজ্ঞানের অধ্যাপক আড্রিয়ান ফার্নহ্যাম বলেন, ‘‘দুঃশ্চিন্তার বিষয় হচ্ছে, তিনি অবিশ্বাস্য কিছু করে বসতে পারেন।”
এমনও হতে পারে, পুতিন নিজেই নিজকে বিশ্বের কাছে একজন বিপজ্জনক অথবা যুক্তিবুদ্ধিহীন মানুষ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন। এটি খুবই পরিচিত কৌশল, যেটি ‘উন্মাদ তত্ত্ব’ (ম্যাডম্যান থিওরি) নামে পরিচিত।
এটা অনেকটা এমন- কেউ যার হাতে পরমাণু অস্ত্র আছে, যিনি তার প্রতিপক্ষকে হারাতে চেষ্টা করছেন; তিনি অন্যদের সামনে নিজেকে অনেকটাই উন্মাদ হিসেবে উপস্থাপন করতে পারেন, এতটাই উন্মাদ যে, তিনি তার হাতে থাকে পরমাণু অস্ত্র ব্যবহার করে সবাইকে ধ্বংস করে দিতেও পিছ পা হবেন না।
তাই পশ্চিমা গোয়েন্দা এবং নীতিনির্ধারকদের জন্য অতীতে আর কখনও পুতিনের মনে কী চলছে বা তার মাথায় কী ঘুরছে- সেটা বুঝতে পারাটা এখনকার মতো এতটা জরুরি ছিল না। তাদেরকে এখন বুঝতে হবে, পুতিনকে ঠিক কতটা চাপে ফেলে কার্য উদ্ধার করা সম্ভব হবে, অথবা কতটা চাপে রাখলে পুতিন আরও ভয়ঙ্কর হয়ে উঠে তার জবাব দেবেন না।
মনোবিদ কেন ডেকলেভা বলেন, ‘‘পুতিনের নিজস্ব বিশ্বাসের জায়গায় ব্যর্থতা বা দুর্বলতার কোনও স্থান নেই। তিনি ওই ধরনের সব কিছুকেই অগ্রাহ্য করেন। তাই পুতিন কোণঠাসা এবং দুর্বল হওয়া মানেই আরও বিপজ্জনক হয়ে ওঠা। কখনও কখনও ভালুককে খাঁচা থেকে বেরিয়ে বনে ফিরে যেতে দেওয়া ভাল।”