আন্তর্জাতিক

ওমিক্রনের সংক্রমণ ঠেকায় না ‘বেশিরভাগ টিকা’

মানুষের হাতে এখন যে কোভিড টিকাগুলো আছে, করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ ঠেকাতে সেগুলোর অধিকাংশই তেমন কোনো কাজে আসবে না বলে তথ্য আসছে সাম্প্রতিক গবেষণার প্রাথমিক ফলাফলে।

এসব গবেষণার তথ্য তুলে ধরে নিউ ইয়র্ক টাইমসের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, কেবল যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি ফাইজার এবং মডার্নার টিকার বুস্টার বা তৃতীয় ডোজেই সংক্রমণ ঠেকাতে প্রাথমিক সফলতা দেখাতে পেরেছে। যদিও বিশ্বের বেশিরভাগ দেশে এই টিকা পাওয়া যায় না।

অবশ্য সংক্রমণ ঠেকাতে না পারলেও ‘ওমিক্রন’ আক্রান্তদের গুরুতর অসুস্থতা থেকে সুরক্ষা দিতে এখনকার টিকাগুলো উল্লেখযোগ্য মাত্রায় কার্যকর বলে দেখা গেছে গবেষণায়।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, অ্যাস্ট্রাজেনেকা, জনসন অ্যান্ড জনসন এবং চীন বা রাশিয়ায় তৈরি অন্য টিকাগুলো ‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ ঠেকাতে বিশেষ কোনো কাজ করে না বলে প্রাথমিক গবেষণার ফলে দেখা গেছে।

বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ যেহেতু প্রচলিত এসব ডোজ দিয়েই তাদের টিকাদান কর্মসূচি চালিয়েছে, তাই মহামারীর সময়ে এর একটি বড় ধরনের প্রভাব পড়তে পারে বলেও গবেষকরা মনে করছেন।

অবশ্য এর বেশিরভাগ গবেষণাই হয়েছে পরীক্ষাগারে, যেখানে শরীরের পূর্ণ রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা এবং বিশ্বের জনসংখ্যার ওপর এর প্রভাব যাচাই করা সম্ভব হয়নি।

নিউ ইয়র্ক টাইমস লিখেছে, এমআরএনএ প্রযুক্তির ফাইজার এবং মডার্নার টিকা করোনাভাইরাসের সব কটি ধরনের বিরুদ্ধে ভালো কাজ করেছে। অন্যান্য টিকায় রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা তৈরির পুরনো পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়েছে।

সারা বিশ্বে সরবরাহ করা কোভিড টিকার অর্ধেকই চীনা কোম্পানি সিনোফার্ম এবং সিনোভ্যাকের হলেও এসব টিকা ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে প্রায় কোনো সুরক্ষাই দেয়নি বলে প্রতিবেদনে জানানো হয়।

চীনের বেশিরভাগ মানুষই নিজ দেশের এ দুই কোম্পানির টিকা নিয়েছেন। এছাড়া মেক্সিকো এবং ব্রাজিলের মত অন্যান্য নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশেও ব্যাপকভাবে এসব টিকা ব্যবহার করা হয়েছে।

যুক্তরাজ্যে প্রাথমিক এক গবেষণায় দেখা গেছে, অক্সফোর্ড-অ্যাস্ট্রাজেনেকার টিকা নেওয়ার ছয় মাস পর ‘ওমিক্রন’ এর সংক্রমণ ঠেকাতে এর কোনো কার্যকারিতাই ছিল না।

ভারতের ৯০ শতাংশ মানুষ ‘কোভিশিল্ড’ নামে এই টিকা নিয়েছেন। এছাড়া আফ্রিকার সাব সাহারা অঞ্চলের ৪৪ দেশে এই টিকার ছয় কোটি ৭০ লাখ ডোজ সরবরাহ করেছে বিশ্বব্যাপী টিকা সরবরাহের আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্ম কোভ্যাক্স।

গবেষকরা পূর্বাভাস দিয়েছেন, রাশিয়ার তৈরি ‘স্পুৎনিক’ টিকার ডোজ ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে একই ধরনের হতাশাব্যঞ্জক ফল দিতে পারে। আফ্রিকা এবং লাতিন আমেরিকার দেশুগুলোতেও এই টিকা দেওয়া হয়েছে।

টিকা দেওয়ার সরঞ্জাম কম থাকায় আফ্রিকার দেশগুলোতে জনসন অ্যান্ড জনসনের এক ডোজের টিকার চাহিদা বাড়লেও এই টিকার ক্ষেত্রেও ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে খুব সামান্যই প্রতিরোধ দেখা গেছে।

কোভিড টিকা নেওয়ার ফলে শরীরে তৈরি হওয়া প্রতিরোধ ক্ষমতা বা ‘অ্যান্টিবডি’ ভাইরাসের বিরুদ্ধে প্রথমে বাধা তৈরি করে এবং ভাইরাসকে শনাক্ত করতে সক্ষম ‘টি সেল’ তৈরি করে।

শরীরের ‘টি সেল’ করোনাভাইরাসের নতুন ধরন ‘ওমিক্রন’কে শনাক্ত করতে পারছে যা গুরুতর অসুস্থ হয়ে পড়া ঠেকানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে।

নভেম্বরের শেষ দিকে দক্ষিণ আফ্রিকার বিজ্ঞানীরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ধরন বা ভ্যারিয়েন্টটি শনাক্ত করার কথা জানান। গবেষকরা করোনাভাইরাসের এই নতুন ভ্যারিয়েন্টকে চিহ্নিত করছেন বি.১.১.৫২৯ নামে।

তবে আলোচনার সুবিধার জন্য বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এর নাম দিয়েছে ‘ওমিক্রন’। জাতিসংঘের এই সংস্থা ওমিক্রনকে তালিকাভুক্ত করেছে ‘ভ্যারিয়েন্ট অব কনসার্ন’ বা ‘উদ্বেগজনক ধরন’ হিসেবে।

নিউ ইয়র্কের শিক্ষা ও চিকিৎসা গবেষণা প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েইল কর্নেল মেডিসিন’ এর ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জন মুর প্রচলিত টিকার কার্যকারিতা সম্পর্কে বলেন, “আপনি যা হারিয়েছেন সেটা হল, উপসর্গহীন সংক্রমণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ। কিন্তু আপনার জন্য এর চেয়ে ভাল কিছু রয়েছে, সেটা হলো গুরুতর অসুস্থতা এব মৃত্যুর হাত থেকে সুরক্ষা।”

তবে এই প্রতিরোধ সারা বিশ্বে ‘ওমিক্রন’ এর বিপর্যয় ঠেকানোর জন্য যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছেন গ্লোবাল হেলথ পলিসি সেন্টার ফর ইন্টারন্যাশনাল অ্যান্ড স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ এর পরিচালক জে. স্টিফেন মরিসন।

তিনি জানান, এমআরএনএ ভিত্তিক টিকা ছাড়া অন্যান্য টিকা ‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে বিশেষ কোনো সুরক্ষা না দেওয়ার খবরে বিশ্বের যে সব দেশ মানুষের মাঝে টিকার চাহিদা তৈরি করতে চাচ্ছে তাদের গুরুত্ব আরও কমে যাবে।

মরিসন বলেন, “এটা টিকার গুরত্বকেই চ্যালঞ্জের মুখে ফেলেছে। এটা টিকাবিরোধী আবেগকে উস্কে দেবে এবং মনোবলকেও দুর্বল করে ফেলবে।”

‘ওমিক্রন’ এর বিরুদ্ধে টিকার কার্যকারিতার বিষয়ে উপসংহার টানতে আরও তথ্য প্রয়োজন এবং টিকাদান কর্মসূচির গতি অব্যাহত রাখা উচিত বলে মনে করেন টিকার বৈশ্বিক জোট ‘গাভি’ এর সিইও ড. সেথ বার্কলে।

এই ভাইরাস বিশেষজ্ঞ জানান, দেশগুলো যদি টিকাদান কর্মসূচি শিথিল করে এবং যদি মনে করে কেবল এমআরএনএ টিকার ডোজ সরবরাহ করা উচিত, তবে সেটা হবে গুরুতর একটি ভুল সিদ্ধান্ত ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *