অর্থনীতি

করযোগ্য আয় হিসাব করবেন যেভাবে

করযোগ্য আয় থাকলে সব শ্রেণি-পেশার মানুষের আয়কর দেওয়া নাগরিক দায়িত্ব। এ জন্য এনবিআরের কাছে আয়কর রিটার্ন (আয় ও সম্পদের তথ্য বিবরণী) জমা দিতে হয়। তবে একেক পেশার মানুষের করযোগ্য আয় নিরূপণের হিসাব একেক রকম। আসুন দেখে নেওয়া যাক একজন শিক্ষক, চিকিৎসক, শিল্পী, ব্যবসায়ী ও কৃষক কীভাবে করের হিসাব করবেন।

শিক্ষকের আয় ও করের হিসাব: ধরুন বিশাল আহমেদ বেসরকারি একটি ইংরেজি মিডিয়ামের শিক্ষক। তার একজন প্রতিবন্ধী সন্তান আছে। স্ত্রী করদাতা নন। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে গত জুন পর্যন্ত তিনি প্রতি মাসে ৩০ হাজার টাকা মূল বেতন পেয়েছেন। চিকিৎসা ভাতা পেয়েছেন এক হাজার করে। বাড়ি ভাড়া পেয়েছেন মাসে ১৫ হাজার টাকা। মূল বেতনের সমান দুটি উৎসব বোনাস পেয়েছেন। তিনি টিউশনি থেকেও উপার্জন করেন। নিজের বাসায় ছয়টি ব্যাচে ছয়জন করে শিক্ষার্থী। প্রতিজনের কাছ থেকে চার হাজার টাকা করে সম্মানী নেন।

২০১৯-২০ আয় বছরে বিশাল দুই লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ৩০ জুন তারিখে তার নিট সম্পদের পরিমাণ ছিল তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা। তাহলে তার ২০২০-২১ অর্থবছরে মোট আয় ও করের হিসাব হবে এভাবে- মোট বেতন ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা। মোট বাড়ি ভাড়া এক লাখ ৮০ হাজার টাকা। বাড়ি ভাড়া থেকে মোট বেতনের অর্ধেক বাদ দিয়ে যা থাকে সেটির ওপর কর ধার্য হয়। বাড়ি ভাড়া ও মোট বেতনের অর্ধেক যেহেতু সমান, ফলে বাড়ি ভাড়া খাতে করযোগ্য আয় শূন্য। তিনি চিকিৎসা ভাতা পান ১২ হাজার টাকা। মূল বেতনের ১০ শতাংশ বা এক লাখ ২০ হাজার টাকার মধ্যে যেটি কম তা চিকিৎসা ভাতা থেকে বাদ দেওয়ার পরে অবশিষ্ট টাকার ওপর কর ধরা হয়। মূল বেতনের ১০ শতাংশ ৩৬ হাজার টাকা। চিকিৎসা ভাতা ১২ হাজার টাকা। ফলে এ ক্ষেত্রেও করযোগ্য আয় শূন্য।

অন্যদিকে, দুটি উৎসব বোনাস পেয়েছেন ৬০ হাজার টাকা। ফলে বেতন খাতে তার করযোগ্য আয় চার লাখ ২০ হাজার টাকা। টিউশনি থেকে তার আয় ১৭ লাখ ২৮ হাজার টাকা। তাহলে বিশাল আহমেদের মোট আয় দাঁড়াল ২১ লাখ ৪৮ হাজার টাকা। প্রতিবন্ধী সন্তানের পিতা হিসেবে তার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ টাকা। ফলে প্রথম সাড়ে তিন লাখ টাকার ওপর কর শূন্য। পরের এক লাখে ৫ শতাংশ, তার পরের তিন লাখ টাকা পর্যন্ত ১০ শতাংশ, পরের চার লাখ টাকা পর্যন্ত ১৫ শতাংশ, পরের পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত ২০ শতাংশ এবং তার পরের ১০ লাখ টাকা পর্যন্ত ২৫ শতাংশ হিসাবে কর দিতে হবে।

এ হিসাবে তার করমুক্ত আয়সীমা বাদ দেওয়ার পরে কর দাঁড়ায় তিন লাখ ১৯ হাজার ৫০০ টাকা। করদাতার অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগ দুই লাখ টাকা। মোট আয় ১৫ লাখ টাকার বেশি হওয়ায় তিনি দুই লাখ টাকার ১০ শতাংশ বা ২০ হাজার টাকা কর রেয়াত পাবেন। ফলে তার কর দাঁড়াল দুই লাখ ৯৯ হাজার ৫০০ টাকা। এদিকে তার তিন কোটি ৩০ লাখ টাকা নিট সম্পদ রয়েছে। তিন কোটি টাকা পর্যন্ত নিট সম্পদের ক্ষেত্রে করের ওপর কোনো সারচার্জ নেই। তার নিট সম্পদ তিন কোটি টাকার বেশি হওয়ায় করের ওপর ১০ শতাংশ সারচার্জ আরোপ করা হবে। এতে আসবে ২৯ হাজার ৯৫০ টাকা। ফলে তার মোট কর দিতে হবে তিন লাখ ২৯ হাজার ৪৫০ টাকা। তবে যার সম্পদ তিন কোটি টাকার কম এবং পরিবারে কোনো প্রতিবন্ধী সন্তান নেই তার হিসাবে করমুক্ত আয়সীমা তিন লাখ ও সারচার্জ শূন্য হবে।

শিল্পীর কর: নাজিয়া নাজরিন একজন কণ্ঠশিল্পী। তার একটি গানের দল রয়েছে। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে গান পরিবেশনের মাধ্যমে আয় করেন। ২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত তার দল ১০ লাখ টাকা আয় করেছে। এ আয় থেকে দলের তিন সহশিল্পী, তিন যন্ত্রশিল্পী ও একজন তবলাবাদকের বেতন, যাতায়াত খরচ ও পোশাক-পরিচ্ছদ বাবদ চার লাখ ৮৫ হাজার টাকা ব্যয় হয়েছে। এসব ব্যয় বাদ দিয়ে নাজিয়ার নিজের আয় হয়েছে পাঁচ লাখ ১৫ হাজার টাকা। তিনি নারী হওয়ায় তার করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে তিন লাখ। বাকি এক লাখ ৬৫ হাজার টাকার ওপর তাকে কর দিতে হবে। প্রথম এক লাখ টাকায় ৫ শতাংশ এবং পরবর্তী ৬৫ হাজারে ১০ শতাংশ হারে মোট কর দিতে হবে ১১ হাজার ৫০০ টাকা।

চিকিৎসকের কর: একজন চিকিৎসক চাকরি ও প্রাইভেট প্র্যাকটিস থেকে যে আয় করেন সেটির পুরোটাই করযোগ্য। ধরুন ফাহাদ আল করিম একটি বেসরকারি হাসপাতালের চিকিৎসক। ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জুন পর্যন্ত তিনি মাসিক ৫০ হাজার টাকা করে বেতন পেয়েছেন। বছরে বাড়ি ভাড়া ভাতা পান তিন লাখ ও চিকিৎসা ভাতা পান ২৪ হাজার টাকা। উৎসব ভাতা পান এক লাখ টাকা। মাসে পাঁচ হাজার টাকা করে ভবিষ্যতহবিলে জমা দেন, তার নিয়োগকর্তা প্রতিষ্ঠানও সমপরিমাণ টাকা জমা দেয়।

ডা. ফাহাদ প্রাইভেট প্র্যাকটিসও করেন। প্রতিদিন ১০ নতুন রোগী ও ৩০ পুরোনো রোগী দেখেন। নতুন রোগীর ফি ৫০০ টাকা এবং পুরোনো রোগীর ফি ৩০০ টাকা নেন। বছরে ৩০০ দিন রোগী দেখেন। তবে এ বিষয়ে কোনো খাতাপত্র সংরক্ষণ করেন না। তিনি মাসিক ছয় হাজার টাকার একটি সঞ্চয় স্কিমে টাকা জমান। শেয়ারবাজারে ১০ লাখ টাকা বিনিয়োগ করেছেন এবং পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন। ২০২০-২১ আয় বছরে মূল বেতন থেকে তার মোট আয় ছয় লাখ টাকা। বাড়ি ভাড়া তিন লাখ টাকা।

মূল বেতনের অর্ধেক বাড়ি ভাড়া থেকে বাদ দিলে এ খাতে করযোগ্য আয় শূন্য। উৎসব ভাতা এক লাখ টাকা। চিকিৎসা ভাতা ২৪ হাজার টাকা। মূল বেতনের ১০ শতাংশ বাদ দিয়ে চিকিৎসা ভাতা হিসাব করা হয়। এতে এ খাতেও করযোগ্য আয় শূন্য। তাহলে বেতন খাতে তার করযোগ্য আয় দাঁড়াল সাত লাখ ৬০ হাজার টাকা। অন্যদিকে, প্রাইভেট প্র্যাকটিসের মাধ্যমে নতুন রোগী থেকে ১৫ লাখ এবং পুরোনো রোগী থেকে ২৭ লাখ অর্থাৎ, মোট ৪২ লাখ টাকা আয়। এর মধ্যে তার খরচ হয়েছে ১৪ লাখ টাকা। নিট আয় দাঁড়াল ২৮ লাখ টাকা।

এ হিসাবে ফাহাদ আল করিমের গত অর্থবছরে সব মিলিয়ে করযোগ্য আয়ের পরিমাণ দাঁড়াবে ৩৫ লাখ ৬০ হাজার টাকা। এই আয়ের প্রথম তিন লাখ টাকার ওপর কোনো কর বসবে না। পরবর্তী এক লাখ টাকার জন্য ৫ শতাংশ হারে পাঁচ হাজার টাকা কর বসবে। পরের তিন লাখ টাকার জন্য ১০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার টাকা, পরের চার লাখ টাকার জন্য ১৫ শতাংশ হারে ৬০ হাজার টাকা এবং পরের পাঁচ লাখ টাকার ওপর ২০ শতাংশ হারে এক লাখ টাকা কর বসবে। বাকি ১৯ লাখ ৬০ হাজার টাকার জন্য ২৫ শতাংশ হারে চার লাখ ৯০ হাজার টাকা কর হবে। সব মিলিয়ে তার করের পরিমাণ ছয় লাখ ৮৫ হাজার টাকা।

তবে এত টাকা তাকে কর দিতে হবে না। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের জন্য কর ছাড়া পাবেন। মোট করযোগ্য আয়ের ২৫ শতাংশ পর্যন্ত অনুমোদনযোগ্য বিনিয়োগ। অর্থাৎ, তিনি আট লাখ ৯০ হাজার টাকার বিনিয়োগে ছাড় পাবেন। কিন্তু ফাহাদ আল করিম পাঁচ লাখ টাকার সঞ্চয়পত্র কিনেছেন, শেয়ারবাজারে বিনিয়োগ করেছেন ১০ লাখ টাকা, ডিপিএস করেছেন ৭২ হাজার টাকা (ডিপিএসে সর্বোচ্চ ৬০ হাজার টাকার বিনিয়োগে ছাড় আছে) এবং ভবিষ্যতহবিলে জমা করেছেন ৬০ হাজার টাকা। সব মিলে তিনি ১৬ লাখ ৮০ হাজার টাকা বিনিয়োগ করেছেন। কিন্তু তিনি আট লাখ ৯০ হাজার টাকার ওপর ছাড় ১০ শতাংশ হিসাবে ৮৯ হাজার টাকা ছাড় পাবেন। ফলে তাকে কর দিতে হবে পাঁচ লাখ ৯৬ হাজার টাকা।

ব্যবসায়ীর কর: ছোট-বড় সব ব্যবসায়ীকে কর দিতে হয়। ধরুন ফুয়াদ হাসান একজন ব্যবসায়ী। তার একটি ডিপার্টমেন্টাল স্টোর রয়েছে। তিনি ২০১৯-২০ অর্থবছরে এক কোটি ২০ লাখ টাকার পণ্য বিক্রি করেছেন। এ থেকে পরিচালন মুনাফা হয়েছে ১৮ লাখ টাকা। তার খরচ হয়েছে ১০ লাখ টাকা। ফলে নিট লাভ ৮ লাখ টাকা। এই সময়ে তিনি ৩০ হাজার টাকা অগ্রিম কর পরিশোধ করেছেন। মুনাফা থেকে সঞ্চয়পত্র কিনেছেন এক লাখ ২০ হাজার টাকা। তাহলে তার কর হিসাব অনুযায়ী, নিট আয় বা লাভের প্রথম তিন লাখে কোনো কর দিতে হবে না। পরের এক লাখে ৫ শতাংশ হিসাবে পাঁচ হাজার টাকা। পরের তিন লাখ পর্যন্ত ১০ শতাংশ হারে ৩০ হাজার টাকা। এর পরের এক লাখে ১৫ শতাংশ হিসাবে কর আসে ১৫ হাজার টাকা। এ হিসাবে তার মোট ৫০ হাজার টাকা কর আসে। সঞ্চয়পত্রে বিনিয়োগের জন্য ১৮ হাজার টাকা কর ছাড়া পাবেন। অন্যদিকে, তার প্রতিষ্ঠানের দেওয়া অগ্রিম কর ৩০ হাজার টাকা বাদ যাবে। ফলে তাকে দুই হাজার টাকা কর পরিশোধ করতে হবে।

কৃষকের কর: ধরুন, ইব্রাহীম খলীল একজন কৃষক। তিনি দুই একর জমিতে ধান চাষ করেন। মোট ৯০ মণ ধান পেয়েছেন। প্রতি মণের দাম ৮০০ টাকা। ধান বিক্রি থেকে আয় হয়েছে ৭২ হাজার টাকা। উৎপাদন ব্যয় ৬০ শতাংশ ধরে তা হিসাব থেকে বাদ দেওয়া হয়। ফলে ইব্রাহীমের দুই একর জমি চাষের খরচ বাবদ বাদ যাবে ৪৩ হাজার ২০০ টাকা। তাহলে তার আয় দাঁড়াল ২৮ হাজার ৮০০ টাকা। কৃষি ছাড়া অন্য কোনো উৎস থেকে আয় না থাকলে ৬৫ বছরের কম বয়সী একজন কৃষকের মোট পাঁচ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করমুক্ত। ৬৫ বছরের ঊর্ধ্বে পুরুষ ও যে কোনো বয়সের নারী কৃষকের করমুক্ত আয়সীমা সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। ফলে ২৮ হাজার ৮০০ টাকা আয় করার জন্য ইব্রাহীমকে কোনো কর পরিশোধ করতে হবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *