কুষ্টিয়ায় কৃষিভিত্তিক ভারী শিল্পের একমাত্র চিনিকলটি ক্রমাগত লোকসানে চলছে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে। ভরা মৌসুমে আখ যোগান কম ও কারখানা ব্রেক ডাউনের কারণে চিনি উৎপাদনে লক্ষ্যমাত্রা অর্জন হচ্ছে না। ফলে প্রতি মৌসুমে কোটি কোটি টাকা লোকসানের বোঝা ও নানা সংকটে চিনিকলটি পরিণত হয়েছে অতি রুগ্ন শিল্পে। শুধুমাত্র ২০০১-০২ থেকে ২০১৯-২০ অর্থ বছর পর্যন্ত গত ১৯ বছরে দেশের বৃহত্তম এই চিনিকলটিতে লোকসান হয়েছে ৪১৫ কোটি টাকা।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ১৯৬১ সালে কুষ্টিয়া শহরে অদূরে জগতি নামক স্থানে ২২১.৪৬ একর জায়গার ওপর প্রতিষ্ঠিত কুষ্টিয়া চিনিকল। ১৯৬৫-৬৬ সালে পরীক্ষামূলকভাবে এ মিলে চিনি উৎপাদন শুরু হয়। পরবর্তীতে ১৯৬৬-৬৭ সালে বাণিজ্যিকভাবে শুরু হয় চিনি উৎপাদন।
মিলের অর্থ বিভাগের তথ্যমতে, প্রতি মৌসুমে চিনি উৎপাদন অব্যাহত থাকলেও এ মিলে লাভের চেয়ে লোকসানই হচ্ছে বেশি। তবে ১৯৯৪-৯৫ অর্থ বছরে ২ কোটি ৬১ লাখ ও ৯৫-৯৬ অর্থ বছরে ১ কোটি ২৬ লাখ টাকা মিলে লাভ হয়। এছাড়া বিগত ২০০১-২০০২ থেকে ২০১৯-২০২০ অর্থ বছর পর্যন্ত গত ১৯ বছরের হিসাবমতে লোকাসন হয়েছে ৪১৫ কোটি টাকা। মিলের ব্যবস্থাপক (অর্থ) মো. খোরশেদ আলম খন্দকার গত ১৯ বছরে ক্রমাগত লোকসানের এ তথ্য নিশ্চিত করেন। চালুর প্রথমদিকে মিলটি লাভজনক হলেও পরবর্তীতে ব্যবস্থাপনায় ত্রুটি, অনিয়ম-দুর্নীতি ও মাথাভারী প্রশাসনসহ নানা কারণে ক্রমাগত লোকসানের ঊর্ধ্বগতিতে মিলটি এখন অতি রুগ্ন প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়েছে। ফলে লোকসানের বিশাল বোঝা মাথায় নিয়ে কৃষিভিত্তিক একমাত্র এ প্রতিষ্ঠানটি পড়েছে চরম হুমকিতে। এ দৈন্যদশায় মিলটি ঝিমিয়ে পড়ার পাশাপাশি ৩০ কর্মকর্তাসহ ৮৯০ জন কর্মচারীর চাকরি এখন হুমকিতে। শ্রমিক-কর্মচারীরা বেতন-ভাতা পাচ্ছেন না ৫-৬ মাস।
আরো পড়ুন: এবার শত শত ইমাম-মুসলিম নেতাদের বন্দি করেছে চীন
কলটির প্রতিদিনের চিনি উৎপাদন ক্ষমতা ১৫’শ মেট্রিক টন এবং বার্ষিক মাড়াই ক্ষমতা ১৫ হাজার মেট্রিক টন। মিল জোনের আওতায় আখ চাষ হচ্ছে ৪০ একর জমিতে। এছাড়া বৃহত্তর কুষ্টিয়ায় চাষি পর্যায়ে আখ চাষ হয়েছে ৭ হাজার ৯শ’ ৯৩ একর জমিতে। প্রতিমন ১৪০ টাকা দরে চাষিরা মিলে চাষ সরবরাহ করেন। কিন্তু বিক্রিত আখের দাম পরিশোধে দীর্ঘসূত্রিতাসহ হয়রানি ও নানা জটিলতায় চাষি মিলে আখ সরবরাহে আগ্রহ হারাচ্ছে। প্রতিষ্ঠার পর এ পর্যন্ত মিলটি আধুনিকীকরণ (বিএমআরই) করা হয়নি। ফলে বহু পুরাতন যন্ত্রাংশে সজ্জিত কারখানা প্রতি মৌসুমেই যান্ত্রিক ত্রুটিসহ ব্রেক ডাউনে চিনি উৎপাদন ব্যাহত হয়। এছাড়া প্রতি মৌসুমে মিলে উৎপাদিত হাজার হাজার টন চিনি থাকে অবিক্রীত। আমদানিকৃত চিনির বাজার মূল্য কম হওয়ায় ডিলার ও ভোক্তারা দেশি চিনির পরিবর্তে কেমিক্যাল মিশ্রিত রিফাইন চিনির দিকেই বেশী ঝুঁকছেন। ফলে নানা সংকটে সম্ভাবনাময় এ মিলটি ঘুর দাঁড়াতে পারছে না। মিলটির আধুনিকরণসহ মিলটিকে রক্ষায় সরকার ও সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ের আশু হস্তক্ষেপ দাবি করেন এলাকাবাসী।
মিলের আখ জোনের চাষি আব্দুস সাত্তার জানান, বিক্রিত আখের মূল্য পরিশোধে বিলম্বসহ নানা অনিয়মে লাভজনক এ প্রতিষ্ঠানটি চরমভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ফলে চাষিরা আখের পরিবর্তে অন্যান্য অর্থকরী ফসল চাষে ঝুঁকছে।
কুষ্টিয়া চিনিকলের ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক মো. রাকিবুর রহমান খান লোকসানের সত্যতা স্বীকার করে জানান, মাড়াই মৌসুমে কাঁচামাল হিসাবে আখের সরবরাহ কম হওয়ায় মিলে চিনি উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন ব্যাহত হচ্ছে। তবে এসব সংকট কাটিয়ে মিলটিকে এগিয়ে নিতে সর্বাত্মক চেষ্টা করা হচ্ছে বলে তিনি জানান।