খেলাপিতে জর্জরিত ব্যাংকবহির্ভূত আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো। এছাড়া নানা অনিয়মের বৃত্তে আটকে আছে এ খাতের বেশিরভাগ প্রতিষ্ঠান। বিভিন্ন গোষ্ঠীর কাছে জিম্মি হয়ে আছে কোনো কোনো প্রতিষ্ঠান।
এ কারণে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে ঋণ বিতরণ কার্যক্রম। সুশাসনের অভাবেই এমনটা হচ্ছে। তাই নন-ব্যাংক আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে চাঙা করতে উদ্যোগ নিয়েছে বাংলাদেশ ব্যাংক। নীতি সহায়তার পাশাপাশি প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে ত্রৈমাসিক ভিত্তিতে বৈঠক করবেন গভর্নর।
সমস্যা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধানের উদ্যোগ নেওয়ার পাশাপাশি আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণ কমাতে কঠোর নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। এক্ষেত্রে সহায়তা করবে বাংলাদেশ ব্যাংক।
রোববার বাংলাদেশ ব্যাংকে আয়োজিত এক বৈঠকে এই নির্দেশনা ও সহায়তার আশ্বাস দেওয়া হয়। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন গভর্নর আবদুর রউফ তালুকদার। উপস্থিত ছিলেন সব আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সংশ্লিষ্ট বিভাগের কর্মকর্তারা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, গভর্নর আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জোর দিয়েছেন। এ ক্ষেত্রে পূর্ণ সহায়তা দেবে বাংলাদেশ ব্যাংক। প্রতিষ্ঠানগুলোর ওপরে প্রভাবশালী মহলের চাপ নিরসনে সহায়তা দেওয়া হবে।
এছাড়া খেলাপি ঋণ কমাতে বিশেষ নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। খেলাপি ঋণ আদায়ে সার্বিক সহায়তার আশ্বাসও দিয়েছেন গভর্নর।
বৈঠকে অংশ নেওয়া একটি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ব্যবস্থাপনা পরিচালক জানান, এটি রুটিন বৈঠক ছিল। বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর সবার কাছ থেকে সমস্যার কথা শুনেছেন। প্রতিষ্ঠানগুলো কিভাবে চলছে, কিভাগে ভালোভাবে আগানো যায় এসব বিষয় জানতে চেয়েছেন। পাশাপাশি তিনি সার্বিক সহায়তার আশ্বাস দিয়েছেন। এখন থেকে গভর্নর আর্থিক প্রতিষ্ঠানের এমডিদের সঙ্গে প্রতি তিন মাস পর বসবেন।
বৈঠকে অংশ নেওয়া আরেক কর্মকর্তা জানান, আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর পক্ষ থেকে কিছু নীতিগত সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অর্থঋণ আদালতের মামলা জটিলতা নিরসনে সহায়তা চাওয়া হয়েছে। অন্যদিকে রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষের (রাজউক) সঙ্গে কিছু সমস্যা রয়েছে, বর্তমানে রাজউকের অধীনে সম্পত্তি মর্টগেজ (জামানত) রাখা যাচ্ছে না। এতে ঋণ বিতরণ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে এসব সমস্যা সমাধানে পদক্ষেপ নেওয়া হবে।
এর আগে বছরের পর বছর আটকে থাকা খেলাপি ঋণ গ্রাহকদের সঙ্গে সম্পর্কের ভিত্তিতে আদায়ে জোর দিয়ে নির্দেশনা দিয়েছিল বাংলাদেশ ব্যাংক।
বাংলাদেশ ব্যাংক মনে করে, প্রতিষ্ঠানগুলো ইচ্ছা করলে মামলাধীন ঋণ আদায় করতে পারবে না, কারণ কোর্টের বিভিন্ন ধাপ রয়েছে। এ ধাপ বা প্রক্রিয়াগুলোকে কীভাবে মনিটরিং করা যায়, সে বিষয়ে তাদের বলা হয়েছে। কোর্টে মামলা চলছে, কিন্তু গ্রাহকদের সম্পর্কের ভিত্তিতে আদায় হয়ে যায়, তাহলে সে মামলাগুলো নিষ্পত্তি হয়ে যাবে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, ঋণ আদায়ের জন্য মামলা করা হলেও অর্থঋণ আদালতে বিচার প্রক্রিয়ার মধ্যেই সময়ক্ষেপণের সুযোগ রয়েছে। এ আদালতে রায় হওয়ার পরও খেলাপি গ্রাহকরা উচ্চ আদালতে আপিল করেন। বছরের পর বছর পার হলেও সেই প্রক্রিয়া শেষ হয় না। এজন্য দ্রুত মামলা নিষ্পত্তির জন্য আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, ২০২২ সালে ৩৫টি আর্থিক প্রতিষ্ঠানের ৪ হাজার ৭০২টি মামলার বিপরীতে ১১ হাজার ৫৫২ কোটি টাকা আটকে রয়েছে। যা ২০২১ সালে ছিল ৩ হাজার ৯১৯টি মামলার বিপরীতে ৮ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। অর্থাৎ এক বছরের ব্যবধানে মামলা বেড়েছে ৭৮৩টি। এসব মামলার বিপরীতে গত এক বছরে ৩ হাজার ৩৪ কোটি টাকার দাবি বেড়েছে।
অন্যদিকে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোর খেলাপি ঋণের চিত্রও উদ্বেগজনক। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চ পর্যন্ত আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ঋণস্থিতি ছিল ৭১ হাজার ২৬৫ কোটি টাকা। যা গত ডিসেম্বরে ছিল ৭০ হাজার ৪৩৬ কোটি টাকা। অর্থাৎ শেষ তিন মাসে ঋণ বেড়েছে ৮২৯ কোটি টাকা। এ সময়ে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ১ হাজার ৩৩ কোটি টাকা।
মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১৭ হাজার ৮৫৫ কোটি টাকা। যা গত বছরের ডিসেম্বরে ছিল ১৬ হাজার ৮২১ কোটি টাকা। এক বছর আগে অর্থাৎ ২০২২ সালের মার্চে খেলাপি ঋণ ছিল ১৪ হাজার ২৩২ কোটি টাকা। সে হিসাবে এক বছরের ব্যবধানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে ৩ হাজার ৬২২ কোটি টাকা।