মেগা প্রকল্প শেষ করার পাশাপাশি আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে ছোট ছোট প্রকল্প অনুমোদনে গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। বিশেষ করে ব্যয় ৫০ কোটি টাকার নিচে এমন প্রকল্পে উৎসাহ দেখাচ্ছে মন্ত্রণালয় ও বিভাগগুলো। কেননা এখন নিয়মিত একনেক বৈঠক হচ্ছে না। এরই মধ্যে বিভিন্ন এলাকার মন্ত্রী, এমপি ও জনপ্রতিনিধিদের চাহিদার পরিপ্রেক্ষিতে ছোট প্রকল্প প্রস্তাব আসছে পরিকল্পনা কমিশনে।
এগুলো পরিকল্পনামন্ত্রীর অনুমোদন এখতিয়ার থাকায় ঝক্কি কম হচ্ছে বলে উৎসাহও বেশি। সেই সঙ্গে জনতুষ্টির জন্য দ্রুত দৃশ্যমান কার্যক্রম দেখানো সম্ভব হয় সাধারণত ছোট প্রকল্পের মাধ্যমেই। তবে বিশেষজ্ঞদের মতে, এমন ছোট ছোট প্রকল্প ভবিষ্যতে এডিপিতে বাড়তি চাপ সৃষ্টি করতে পারে। পাশাপাশি নির্বাচনি চিন্তা থেকে হাতে নেওয়া হলে অপচয়েরও আশঙ্কা আছে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনামন্ত্রী এমএ মান্নান সম্প্রতি বলেন, এখন নির্বাচনি বছর। মন্ত্রী-এমপিদের এলাকার চাহিদা থাকে। তারা চাইবেন এর মধ্যেই যতটা প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেওয়া যায়। কিন্তু আমরা বড় প্রকল্পে আগ্রহ দেখাচ্ছি না। চেষ্টা করছি ছোট প্রকল্পের অনুমোদন বেশি করতে। তবে নিয়মের বাইরে গিয়ে নয়। এক্ষেত্রেও প্রচলিত আইনকানুন ও নিয়মনীতি মেনেই করা হচ্ছে।
বিশ্বব্যাংক ঢাকা অফিসের সাবেক লিড ইকোনমিস্ট ড. জাহিদ হোসেন বৃহস্পতিবার বলেন, যাদের বা যে এলাকায় সত্যিকার অর্থে প্রয়োজন সেখানে ছোট প্রকল্প নিলে সমস্যা নেই। এক্ষেত্রে যেসব মন্ত্রণালয় বা সংস্থা এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন করবে তাদের সক্ষমতাও বিবেচনায় নিতে হবে। কিন্তু যদি নির্বাচনের বিষয় মাথায় রেখে ছোট প্রকল্প নেওয়া হয় তাহলে উদ্বেগের বিষয় আছে। কেননা এসব প্রকল্প এখন নেওয়া হলেও পরে কী হবে? চলমান থাকবে নাকি মাঝ পথে বন্ধ হয়ে যাবে? এসব প্রশ্নের জবাব এখনই নিশ্চিত হওয়া দরকার। সেটি করা না গেলে পরে এডিপিতে বোঝা তৈরি বা অপচয়ের আশঙ্কা থেকে যায়।
সূত্র জানায়, বর্তমান সরকারের শেষ সময় হওয়ায় এলাকার মানুষদের সন্তুষ্ট করতে জনপ্রতিনিধিরা নানাভাবে প্রকল্প অনুমোদন করিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করছেন। তদবিরের জন্য এমপিদের পরিকল্পনা কমিশনে আসাটাও বেড়ে গেছে। গত দুতিনটি একনেক বৈঠকের মাঝামাঝি সময়ে প্রায় ১০-১৫টি ছোট প্রকল্প অনুমোদন দিয়েছেন পরিকল্পনামন্ত্রী। পরে একনেক বৈঠকে সেগুলো প্রধানমন্ত্রী ও একনেক চেয়ারপারসনকে অবহিত করা হয়েছে। এছাড়া বর্তমানে বেশ কয়েটি ছোট প্রকল্প প্রস্তাব আছে পরিকল্পনা কমিশনে।
জানা যায়, বাংলাদেশের প্রান্তিক পেশাজীবীর জীবনমান উন্নয়ন (দ্বিতীয় পর্যায়) শীর্ষক একটি প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে পরিকল্পনা কমিশনে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪৯ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। অনুমোদন পেলে দেশের সব জেলার ১৫১টি শহর বা উপজেলায় এটি বাস্তবায়ন করবে সমাজ সেবা অধিদপ্তর। ১৬ আগষ্ট অনুষ্ঠিত হবে প্রকল্পটির পিইসি সভা। প্রকল্পের আওতায় কামার, কুমার, নাপিতসহ বিভিন্ন প্রান্তিক পেশার মানুষদের প্রশিক্ষণ ও সুদবিহীন ঋণ দেওয়া হবে।
এছাড়া ‘ফিশারিজ লাইভলিহুড ইনহ্যান্সমেন্ট প্রজেক্ট ইন দ্য কোস্টাল এরিয়া অব দ্য বে অব বেঙ্গল (এফআইএলইপি)’ শীর্ষক একটি প্রকল্প প্রস্তাব করেছে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ মন্ত্রণালয়। এটির মোট ব্যয় ধরা হয়েছে ৪২ কোটি ৪৫ লাখ টাকা। এর মধ্যে সরকারি তহবিল থেকে এক কোটি তিন লাখ টাকা এবং জাইকার অনুদান থেকে ব্যয় হবে ৪১ কোটি ৪২ লাখ টাকা। প্রকল্পটি কক্সবাজারের সদর, টেকনাফ, উখিয়া, মহেশখালী ও কুতুবদিয়ায় বাস্তবায়ন করা হবে। এসব এলাকার ছোট আকারের উপকূলীয় মৎস্য চাষের উপর নির্ভরশীল পরিবারগুলোর জীবনমানের উন্নয়ন করা হবে।
এ প্রসঙ্গে পরিকল্পনা কমিশনের কৃষি, পানিসম্পদ ও পল্লী প্রতিষ্ঠান বিভাগের সদস্য (সচিব) একেএম ফজলুল হক বলেন, প্রকল্পটি নিয়ে পিইসি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। এখন অনুমোদনের পরবর্তী ধাপে আছে। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় থেকে প্রস্তাব করা হয়েছে বোটানিক্যাল গার্ডেন ও ইকোপার্ক চট্টগ্রামের প্রতিবেশ পুনরুদ্ধার ও জীববৈচিত্র সংরক্ষণ প্রকল্প। এটির ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৬৭ লাখ টাকা। আরও আছে, বৈশ্বিক মহামারি প্রেক্ষাপটে জয়পুরহাট, নওগাঁ ও দিনাজপুর জেলার অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত এবং বিধবা ও স্বামী নিগৃহীতা মহিলাদের সচেতনতা ও সক্ষমতার মধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্প। এটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি ৪২ লাখ টাকা। প্রায় একই ধরনের আর একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা হয়েছে কুড়িগ্রাম ও নিলফামারীর জন্য। এটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ১৪ লাখ টাকা।
এছাড়া দিনাজপুর জেলার হতদরিদ্র, সুবিধা বঞ্চিত প্রতিবন্ধী ও এতিম যুব ও যুব মহিলাদের জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবন মান উন্নয়ন শীর্ষক আরও একটি প্রকল্প প্রস্তাব করা রয়েছে। এটির জন্য ব্যয় হবে ২৪ কোটি ৬৮ লাখ টাকা। বরিশাল জেলার বাবুগঞ্জে বরিশাল বিমানবন্দর এলাকা সুগন্ধা নদীর ভাঙ্গন হতে রক্ষা প্রকল্পের প্রস্তাব করা হয়েছে। এটি বাস্তবায়নে ব্যয় হবে ৪৯ কোটি ৯২ লাখ টাকা। ময়মনসিংহ অঞ্চলের প্রত্নস্থানগুলোর সংস্কার-সংরক্ষণ ও উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ৩৩ কোটি ৩০ লাখ টাকা।
কিশোরগঞ্জের বেকার ও সুবিধাবঞ্চিত জনগোষ্ঠীর জীবনমান উন্নয়নে আত্মকর্মসংস্থানমূলক কাজের মাধ্যমে আর্থসামাজিক উন্নয়ন, এটির ব্যয় হবে ১৯ কোটি ৮৪ লাখ টাকা। আরও একটি প্রকল্প হচ্ছে দক্ষতা বৃদ্ধির মাধ্যমে জীবনমান উন্নয়ন। এটির ব্যয় ধরা হয়েছে ২০ কোটি ৯৪ লাখ টাকা। সুনামগঞ্জের এতিম, সুবিধাবঞ্চিত, ছিন্নমূল ও অনগ্রসর জনগোষ্ঠীর সামাজিক ক্ষমতায়ন প্রকল্পে ব্যয় হবে ২০ কোটি ৯৫ লাখ টাকা। এছাড়া বৈশ্বিক মহামারীর প্রেক্ষাপটে অবহেলিত, সুবিধাবঞ্চিত ও কর্মহীন জনগোষ্ঠীর পুনবৃাসন ও জীবনমান উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয়েছে ২৪ কোটি ৩৯ লাখ টাকা। এরকম আরও অনেক প্রকল্প প্রস্তাব আসছে পরিকল্পনা কমিশনে।