অর্থনীতি

চাহিদার চেয়ে পণ্যের মজুত বেশি,বাড়ছে দাম কারসাজিতে

পেঁয়াজ, মসুর ডাল, চিনি ও ভোজ্যতেলের মজুত চাহিদার চেয়ে অনেক বেশি। চলতি অর্থবছরের প্রথম ৩ মাসে (জুলাই-সেপ্টেম্বর) বেশি আমদানি হওয়ায় মজুত বেড়েছে। যা দিয়ে আগামী ৩ মাস নির্বিঘ্নে চলবে দেশ।

এছাড়া নভেম্বর-ডিসেম্বরে বাজারে আসবে নতুন পেঁয়াজ ও ডাল। সরবরাহ ঠিক রাখতে কাস্টমস বিভাগ ও স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষ কাজ করছে। সীমান্তবর্তী এলাকায় পণ্যের পরিবহণ নির্বিঘ্ন রাখার ব্যবস্থাও করা হয়েছে। এরপরও নিত্যপণ্যের দাম বাগে আনতে পারছে না সরকার। কিছু ব্যবসায়ী আন্তর্জাতিক বাজারের অজুহাত দিয়ে অযৌক্তিকভাবে বাড়াচ্ছে পণ্যের মূল্য। সংশ্লিষ্টরা মনে করছেন অসাধু ব্যবসায়ীরা নানা কারসাজির মাধ্যমে এসব পণ্যের মূল্য বাড়চ্ছে।

জানা গেছে, দেশে প্রতিমাসে পেঁয়াজের চাহিদা দুই লাখ টনের কিছু বেশি। বর্তমানে মজুত আছে ছয় লাখ পাঁচ হাজার ১২৪ টন। চিনির চাহিদা মাসে প্রায় দেড় লাখ টন। মজুত আছে সাড়ে পাঁচ লাখ টন। প্রতিমাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা এক লাখ ৬৬ হাজার টন, আছে ছয় লাখ পাঁচ হাজার টন। তিন মাসে মসুর ডাল প্রয়োজন এক লাখ ২৫ হাজার টন, হাতে আছে তিন লাখ টনের বেশি। এরপর বাজারে পণ্যমূল্যের দাপটে অস্থির মানুষ।

বাংলাদেশ দোকান মালিক সমিতির সভাপতি হেলাল উদ্দিন বলেন, করোনা-পরবর্তী বিশ্বব্যাপী সবকিছু চালু হয়েছে। এ জন্য ডলারের মূল্য বেড়েছে। জ্বালানি তেলের দাম বেড়েছে। অনেক দেশ নতুন করে টাকা ছাপিয়েছে। এসব কারণে বিশ্বের অনেক দেশে মূল্যস্ফীতি ও নিত্যপণ্যের দাম বাড়ছে। সে তুলনায় আমাদের দেশে বাড়লেও তা তুলনামূলক কম। আমরা বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশিকে বলেছি এ ধরনের পরিস্থিতি আরও এক বছর চলবে। এরপর পরিত্রাণ পাওয়া যাবে। ক্যাবের সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, পণ্যের মূল্য বৃদ্ধির কারণে সব শ্রেণির ক্রেতা ভোগান্তিতে পড়ছেন।

মজুত ও সরবরাহ থাকার পরও অসাধু ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে ভোক্তার পকেট কাটছে। যে সব পণ্য আমদানি করা দরকার সেগুলো দ্রুত এনে পর্যাপ্ত মজুত গড়ে তুলতে হবে। সে জন্য শুল্ক পরিহার ব্যবস্থা করা যেতে পারে। মো. আলী নামের এক ক্রেতা কারওয়ান বাজারে এসেছেন পণ্য কিনতে। তিনি বলেন, সব ধরনের পণ্যের দাম লাগাম ছাড়া। কোনো পণ্যের দাম স্বাভাবিক অবস্থায় নেই। কিন্তু বাজারে কোনো সংকট নেই।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে পেঁয়াজ আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৮৪ হাজার ৫৭০ টন। পাশাপাশি স্থানীয়ভাবে উৎপাদিত পেঁয়াজ ৯টি জেলায় মজুত আছে ৪ লাখ ২১ হাজার ৪২৪ টন। সব মিলে সরকারের হাতে এখনও ৬ লাখ ৫১২৪ টন মজুত আছে। যা দিয়ে আগামী তিন মাস চলবে। পাশাপাশি নভেম্বরে কৃষকের নতুন পেঁয়াজ আসবে বাজারে। এছাড়া আর্ন্তজাতিক বাজার থেকে টিসিবির মাধ্যমে পেঁয়াজ আমদানির জন্য দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। পেঁয়াজের বাজারে সরবরাহ ও আমদানি স্বাভাবিক আছে। এরপরও দাম বাড়ছে।

বাণিজ্য সচিব তপনকান্তি ঘোষ গণমাধ্যমকে বলেন, ভারতের বেঙ্গালুরুতে অতিবৃষ্টির কারণে সেখানে পেঁয়াজের দাম বেড়েছে। এটা শুনেই দেশে ব্যবসায়ীরা দাম বাড়িয়ে দিয়েছেন। ভবিষ্যতে পেঁয়াজের সংকট হতে পারে এমন শঙ্কা থেকে তারা এটা করেছে। আমরা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে ইতোমধ্যে চিঠি দিয়েছি। ব্যবসায়ীদের বলা হয়েছে বিশ্ববাজারের দাম বৃদ্ধির প্রভাবে দেশের বাজারে যাতে বেশি না পড়ে সেদিকে খেয়াল রাখতে।

কারণ মন্ত্রণালয় থেকে প্রতিটি পণ্যের মনিটরিং করা হচ্ছে। সূত্র আরও জানায়, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে চিনি আমদানির এলসি নিষ্পত্তি হয়েছে ৫ লাখ ৫৩ হাজার ২০৭ টন। একই সময়ে চাহিদা হচ্ছে সাড়ে ৪ লাখ টন। চাহিদা পূরণ করেও ১ লাখ টনের বেশি মজুত আছে। কিন্তু এরপরও বাজারে চিনির সংকট। দাম বেড়ে ক্রেতার নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার অবস্থা তৈরি হয়েছে।

জানা গেছে, প্রতিমাসে ভোজ্যতেলের চাহিদা হচ্ছে ১ লাখ ৬৬ হাজার টন। ওই হিসাবে ৩ মাসে প্রয়োজন ৫ লাখ টন। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে দেখা গেছে, জুলাই থেকে সেপ্টেম্বর এ তিন মাসে আমদানি হয়েছে ৬ লাখ ৫ হাজার টন। অর্থাৎ চাহিদার চেয়ে বেশি আমদানি হয়েছে ১ লাখ ৫ হাজার টন। এছাড়া সারা বছর মসুর ডালের চাহিদা ৫ লাখ টন। ওই হিসাবে তিন মাসের চাহিদা হচ্ছে ১ লাখ ২৫ হাজার টন। এই সময়ে আমদানি হয়েছে ৬২ হাজার ১১৫ টন। দেশীয়ভাবে উৎপাদন হয়েছে ২ লাখ ৫৮ হাজার টন।

বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হিসাবে অতি গুরুত্বপূর্ণ এই চারটি পণ্যের মজুত ও সরবরাহ ব্যবস্থা ভালো। কিন্তু এরপরও গত এক মাস ধরে এসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে। মন্ত্রণালয়ের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বলেন, নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের সরবরাহ পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সীমান্ত এলাকায় ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সেখানে যাতে আমদানিকৃত পেঁয়াজের ট্রাকের জটলা সৃষ্টি না হয় এ জন্য স্থলবন্দর কর্তৃপক্ষকে চিঠি দেওয়া হয়েছে। এছাড়া কক্সবাজার, সাতক্ষীরা, যশোর, রাজশাহী, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, দিনাজপুর, পঞ্চগড় ও লালমনিরহাটের জেলা প্রশাসকদের চিঠি দেওয়া হয়েছে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় থেকে। সংশ্লিষ্ট জেলা প্রশাসকদের নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্য বিশেষ করে পেঁয়াজের ট্রাক যাতে নির্বিঘ্নে চলাচল করতে পারে ওই চিঠিতে সে ব্যবস্থা নিতে বলা হয়েছে।

পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি প্রসঙ্গে বাংলাদেশ জাতীয় ভোক্তা অধিকার অধিদপ্তরের সাবেক মহাপরিচালক মো. আবুল হোসেন মিয়ার সঙ্গে মঙ্গলবার কথা হয়। তিনি বলেন খাদ্য ও সেবা পণ্য দুটোর দামই বাড়ছে। এক্ষেত্রে গোয়েন্দা সংস্থাসহ বাজার মনিটরিং এজেন্সিগুলোকে নিয়মিতভাবে নজর রাখতে হবে। ব্যবসায়ীদের এলসি করার ক্ষেত্রে নির্দেশ দিতে হবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়কে। যেসব পণ্যের দাম অস্বাভাবিক বেড়েছে সেগুলোর ওপর থেকে সম্পূরক শুল্ক প্রত্যাহারের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

খুচরা বাজার পরিস্থিতি : খুচরা বিক্রেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, প্রতি কেজি মোটা চাল এখন ৪৮ থেকে ৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। বাড়তি দরে বিক্রি হচ্ছে আটা ও ময়দা। প্রতি কেজি খোলা আটা ৩৫ টাকা দিয়ে কিনতে হচ্ছে ক্রেতাদের। যা এক মাস আগেও ৩৩ টাকা ছিল। খোলা ময়দা ৪৫ টাকা, এক মাস আগে ৪০ টাকায় বিক্রি হয়। লিটার প্রতি খোলা সয়াবিন ১৪০ টাকা, এক মাস আগে ১৩৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। বোতলজাত সয়াবিন প্রতি লিটার ১৫৫ ও খোলা পাম অয়েল বিক্রি হয়েছে ১৩০ টাকা। এক মাসের ব্যবধানে সয়াবিন ও পামওয়েলে ৫ টাকা বেড়েছে। একই সময়ের ব্যবধানে ৮৫ টাকা থেকে বেড়ে ৯০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে মসুর ডাল। প্রতি কেজি দেশি পেঁয়াজ ৭৫ টাকায় বিক্রি হয়েছে। যা মাসখানেক আগে বিক্রি হয়েছে ৪৫ টাকা। দেশি রসুন বিক্রি হয়েছে ৮০ টাকা কেজি, যা এক মাস আগে ৭০ টাকা। দেশি হলুদ প্রতি কেজি ২৪০ টাকা। যা এক মাস আগে ২৩০ টাকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি ব্রয়লার মুরগি বিক্রি হচ্ছে ১৭৫ টাকা। যা এক মাস আগে ১৪৫ টকায় বিক্রি হয়েছে। প্রতি কেজি চিনি মাসের ব্যবধানে না বাড়লেও বাড়তি মূল্যে ৮০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *