পথশিশুদের জন্য কাজ করতেন ডা. আহমেদ মাহী বুলবুল, স্বেচ্ছাসেবী আরও সংগঠনেও যুক্ত ছিলেন। কিন্তু তিনি যখন আক্রান্ত হলেন, জখম হলেন, তখন কাছের হাসপাতালে নেওয়ার পর চিকিৎসক হয়েও প্রাথমিক চিকিৎসাটুকুও তিনি পাননি বলে অভিযোগ উঠেছে।
৩৮ বছর বয়সী এই দন্ত চিকিৎসক রোববার ভোরে শেওড়াপাড়ার বাসা থেকে বেরিয়ে রোকেয়া সরণীতে আক্রান্ত হন। তিনি তখন ব্যাটারিচালিত রিকশায় ছিলেন। হামলাকারীরা তার উরুতে ছুরিকাঘাত করে যায়।
বুলবুলকে তখনই কাছের আল হেলাল হাসপাতালে নিয়েছিলেন স্থানীয়রা। কিন্তু বেসরকারি এই হাসপাতালে তাকে কোনো চিকিৎসা না দিয়ে পাঠিয়ে দেওয়া হয় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে। সেখানে কর্তব্যরত চিকিৎসক তাকে দেখে মৃত ঘোষণা করেন।
আল হেলাল হাসপাতাল কর্মকর্তারা অবশ্য দাবি করছেন, বুলবুলকে তাদের হাসপাতালে নেওয়াই হয়নি।
তবে প্রত্যক্ষদর্শীরা বলছেন ভিন্ন কথা।
দিনে ঘটনাস্থলে গিয়ে পাওয়া যায় মো. ইসমাঈল নামে স্থানীয় এক নিরাপত্তাকর্মীকে। তিনি হামলার স্থানটি দেখিয়ে বলছিলেন, এখানেই ঘটেছে ঘটনা।
মেট্রোরেলের নির্মাণযজ্ঞে চারদিক ধুলোয় ধূসর। এর মধ্যে এক কোণায় রক্তে কালচে হয়ে ছিল অনেকটা মাটি। তার কয়েকশ গজ দূরেই আল হেলাল হাসপাতাল।
ইসমাইল বলেন, আল হেলাল হাসপাতালে নেওয়া হয়েছিল বুলবুলকে। কিন্তু ওই হাসপাতালে কোনো চিকিৎসা হয়নি।
সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল মর্গে বন্ধুর লাশের অপেক্ষায় থাকা মোহাম্মদ সিরাজও বলেন, “প্রথমে সেই (আল হেলাল) হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হলে তারা পুলিশ কেস বুঝতে পেরে বুলবুলকে হাসপাতালেই ঢুকতে দেয়নি। তারা চিকিৎসা না দিয়ে ৯৯৯ এ কল দিয়ে পুলিশকে খবর দেয়। এখানেও কিছু সময়ক্ষেপণ হয়েছে, যার কারণে অতিরিক্ত রক্তপাতেই তিনি মারা গেছেন।”
পুলিশের ভাষ্য, এই চিকিৎসকের ডান পায়ের উরুতে একটি আঘাতই করা হয়েছিল। উরুর সেই জখম থেকে অনেক রক্ত পড়ছিল।
ডিএমপির মিরপুর বিভাগের উপকমিশনার মাহতাব উদ্দীন বলেন, “প্রত্যক্ষদর্শীদের যে বর্ণনা, সেটা হচ্ছে, তিনি চিৎকার করার কারণে ছিনতাইকারীরা চলে যায়। তিনি যখন দেখেন রক্ত পড়ছে, তখন স্থানীয় লোকজনের সহায়তায় তাকে আল হেলাল হাসপাতালে নেওয়া হয়।
“আল হেলাল হাসপাতাল কর্তৃপক্ষ তার চিকিৎসা করতে না পেরে তাকে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পাঠিয়ে দেয়। সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালে যাওয়ারও অনেকক্ষণ পরে তিনি আস্তে আস্তে নিস্তেজ হয়ে পড়েন।”
তবে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ কর্তৃপক্ষ বলছে, বুলবুলকে মৃতই আনা হয়েছিল।
বুলবুলের স্ত্রী যে থানায় মামলা করেছেন, সেই মিরপুর থানার ওসি মোস্তাজিরুল ইসলাম বলেন, “সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের কাগজে লেখা রয়েছে- ‘ব্রট ডেড’।”
সোহরাওয়ার্দীতে ময়নাতদন্তের পর বিকালে বুলবুলের লাশ তার স্বজনদের কাছে তুলে দেওয়া হয়।
ময়নাতদন্তে কী পেয়েছেন- জানতে চাইলে সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা বলেন, “অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মৃত্যু হয়েছে।”
বুলবুলের স্বজনদের দাবি, আল হেলাল হাসপাতাল যদি প্রাথমিক চিকিৎসাটা দিত, যদি রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করত, তাহলে হয়ত বুলবুলকে মরতে হত না।
বুলবুলের সঙ্গে ‘পথশিশু সেবা সংগঠনে’ যুক্ত সাখাওয়াত আলী বলেন, “বুলবুলের উরুতে যেই জখমের চিহ্ন আছে, এতটুকু জখমে কেউ মারা যেতে পারে? সেটা খুবই রহস্যজনক।”
বুলবুলের উরুতে ছুরির যে একটাই জখম ছিল, সেটা তেমন গুরুতর মনে হয়নি পুলিশ কর্মকর্তাদের কাছেও।
মাহতাব বলেন, “ডান পায়ের উরুতে আঘাতের ফলে একটা লোক মারা গেল, এটা আপনাদের মতো আমার কাছেও রহস্য। এটা রক্তক্ষরণের কারণে মৃত্যু, না অন্য কারণে, তা ময়নাতদন্ত রিপোর্টেই উঠে আসবে।”
দুপুরে তিনি যখন একথা বলছিলেন, তখনও ময়নাতদন্ত হয়নি।
ময়নাতদন্তের পর এনিয়ে প্রশ্ন করলে সোহরাওয়ার্দীর ফরেনসিক বিভাগের প্রধান অধ্যাপক সেলিম রেজা বলেন, “মেজর কতগুলো রক্তনালী আছে। এগুলোর কোনটা কাটা গেলে ব্লিডিংয়ে মানুষের মৃত্যু হতে পারে।”
পুলিশি ঝামেলা এড়াতে বেসরকারি হাসপাতালগুলো থেকে হামলায় জখম ব্যক্তিদের ফিরিয়ে দেওয়ার অভিযোগ বহু পুরনো।
দুপুরে আল হেলাল হাসপাতালে গিয়ে জানতে চাইলে বেসরকারি এই হাসপাতালটির ব্যবস্থাপক পলাশ কান্তি বলেন, আহত বুলবুলকে তার হাসপাতালে ঢোকানোই হয়নি।
হাসপাতালে কি জরুরি বিভাগ ছিল না, কেন ঢোকানো হল না- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “সেটা ডিউটি ডাক্তার বলতে পারবেন। আপনি এখন যে ডিউটি ডাক্তার, তার সঙ্গে কথা বলেন। আগের ডিউটি ডাক্তার তাকে দায়িত্ব হস্তান্তর করে গেছেন।”
হাসপাতালের দুপুরে কর্মরত চিকিৎসক জিয়া দাবি করেন, বুলবলুকে হাসপাতালে আনাই হয়নি।
বুলবুল ছিনতাইকারীর কবলে পড়েছিলেন বলে পুলিশ ধারণা করলেও তার পরিবারের ধারণা ভিন্ন।
বুলবুলের শ্বশুর ইয়াকুব আলী বলেন, “যদি টাকা আর মোবাইল দুইটাই সাথে থাকে, তাহলে এটা কীভাবে ছিনতাইয়ের ঘটনা হয়?”
বুলবুলের কাছে ১২ হাজার টাকা ছিল এবং তা খোয়া যায়নি বলে জানান তিনি।
বিএনপি ঘরানার চিকিৎসক বুলবুল মগবাজারে ‘রংপুর ডেন্টাল’ নামের একটি চেম্বারে নিয়মিত রোগী দেখতেন। পাশাপাশি গত পাঁচ বছর ধরে ‘মেসার্স রংপুর ট্রেডার্স’ নামে একটি ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানও চালাতেন তিনি৷
ঠিকাদারি কাজে নোয়াখালী যাওয়ার জন্য ভোরে বুলবুল বাসা থেকে বেরিয়েছিলেন বলে জানান তার শ্বশুর ইয়াকুব।
তবে পুলিশ কর্মকর্তা মাহতাব বলেন, “আমরা যতদূর জানি, তিনজন ছিনতাইকারী ছিল। এরা এই ঘটনাটা ঘটিয়েছে।”
হত্যাকাণ্ডস্থলের আশপাশের এলাকার সিসি ক্যামেরার ভিডিও সংগ্রহ করেছে পুলিশ। তার ভিত্তিতে পুলিশ কর্মকর্তারা বলছেন, তিনজন ছিনতাইকারী ঘটনার পর দুটো দলে ভাগ হয়ে হেঁটে গলির পথ ধরে চলে যায়।