‘মহাসচিব’ পদকে ঘিরে জাতীয় পার্টিতে (জাপা) যে ‘নিম্নচাপ’ সৃষ্টি হয়েছিল তা কেটে গেছে। সৃষ্ট বিভেদের মধ্যে পার্টির চেয়ারম্যান জি এম কাদের শেষ পর্যন্ত মহাসচিব পদে দলের কো-চেয়ারম্যান ও কিশোরগঞ্জ-৩ আসনের সংসদ সদস্য বীর মুক্তিযোদ্ধা মুজিবুল হক চুন্নুকে বেছে নেওয়ায় পরিবেশ এখন স্বাভাবিক।
গাইবান্ধা-১ আসনের এমপি ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব করা হচ্ছে- এমন আগাম খবরে দলের যেসব জ্যেষ্ঠ নেতা প্রকাশ্যে বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছিলেন তারাও চুন্নুর হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন। দলটির নেতাকর্মীদের মতে, নতুন মহাসচিব বাছাইয়ে পার্টি চেয়ারম্যান বিচক্ষণতার পরিচয় দেওয়ায় দলের অভ্যন্তরে সৃষ্ট আরেকটি ধাক্কা উবে গেছে। জি এম কাদেরও মঙ্গলবার সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘চুন্নুকে বেছে নেওয়ার কতগুলো কারণ আছে। জোরে কথা বললেও সে খুব দায়িত্বশীল, কাজের অভিজ্ঞতা আছে, সততা আছে, লেখাপড়া জানা। এটাই বড় কথা। জাপার সবচেয়ে বড় সংকট ছিল ভাবমূর্তির। দলের অনেক ভালো কাজ থাকলেও ইমেজ সংকটের কারণে অতীতে গর্ব করা যেত না। এখন অন্তত গর্ব করতে পারি।’
করোনায় আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় জিয়াউদ্দিন আহমেদ বাবলু গত ২ অক্টোবর মৃত্যুবরণ করলে জাপার মহাসচিব পদটি শূন্য হয়। তার মৃত্যুর শোকের মধ্যেই নতুন মহাসচিব কে হচ্ছেন তা নিয়ে জল্পনাকল্পনা শুরু হয় দলটিতে। তত্পর হয়ে ওঠেন মহাসচিব হতে আগ্রহীরা। এর মধ্যেই খবর রটে যায় দলের তরুণ এমপি ও প্রেসিডিয়াম সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারীকে মহাসচিব করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন জি এম কাদের। এমন খবরে উষ্মা প্রকাশ করেন দলের কয়েক জন জ্যেষ্ঠ নেতা। দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদের কলাবাগানের অফিসে গত ৪ অক্টোবর বিকালে দীর্ঘ বৈঠক করেন ঐ জ্যেষ্ঠ নেতারা। বৈঠকে ফিরোজ রশীদ ছাড়াও দলের আরো তিন জন কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার, সৈয়দ আবু হোসেন বাবলা ও মুজিবুল হক চুন্নু, প্রেসিডিয়াম সদস্য মসিউর রহমান রাঙ্গা, প্রেসিডিয়াম সদস্য ও অতিরিক্ত মহাসচিব সাহিদুর রহমান টেপা, প্রেসিডিয়াম সদস্য শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জাপার সাধারণ সম্পাদক জহিরুল আলম রুবেল উপস্থিত ছিলেন।
সেদিনের ঐ বৈঠক থেকে পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরের উদ্দেশ্যে বলা হয়েছিল, অপেক্ষাকৃত জুনিয়র নেতা শামীম হায়দারকে মহাসচিব করা হলে নেতাকর্মীরা তা মেনে নেবেন না। কো-চেয়ারম্যানদের কিংবা জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্য থেকে কাউকে মহাসচিব করার আহ্বান জানানো হয় বৈঠক থেকে। জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রকাশ্য বিরোধিতায় শামীম হায়দারকে মহাসচিব করার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসেন জি এম কাদের। সৌদি আরবে বাংলাদেশের সাবেক রাষ্ট্রদূত গোলাম মসিহকে মহাসচিব করতে জি এম কাদেরকে অনুরোধ জানিয়েছিলেন দলের চিফ প্যাট্রন রওশন এরশাদ। ভেতর-বাইরের নানা চাপের মধ্যেই শনিবার বিকালে মুজিবুল হক চুন্নুকে মহাসচিব হিসেবে নিয়োগ দেন জি এম কাদের। এই সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাকে সহযোগিতা করেন দলের সিনিয়র কো-চেয়ারম্যান ব্যারিস্টার আনিসুল ইসলাম মাহমুদ।
পার্টি চেয়ারম্যানের সিদ্ধান্তকে তাত্ক্ষণিকভাবে স্বাগত জানান দলের অন্য নেতাকর্মীরা। শামীম হায়দারের বিরোধিতাকারী জ্যেষ্ঠ নেতাদের প্রত্যেকের প্রতিক্রিয়া বুঝতে নেতাকর্মীদের অপেক্ষা করতে হয় তিন দিন। শনিবার মহাসচিব নিযুক্ত হয়ে ঐদিন রাতেই সস্ত্রীক জি এম কাদেরের উত্তরার বাসায় গিয়ে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আসেন মুজিবুল হক চুন্নু। পরদিন রবিবার সকালে যান বনানীতে চেয়ারম্যানের কার্যালয়ে। সেখানে তাকে স্বাগত জানান দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য সাহিদুর রহমান টেপা, লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি, মীর আব্দুস সবুর আসুদ, রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়া, এ টি ইউ তাজ রহমান, শফিকুল ইসলাম সেন্টু ও জহিরুল হক জহির। এর মধ্যে সাহিদুর রহমান টেপা, লিয়াকত হোসেন খোকা ও রেজাউল ইসলাম ভুঁইয়াও মহাসচিব হতে আগ্রহী ছিলেন।
এরপর সোমবার সন্ধ্যায় নবনিযুক্ত মহাসচিব চুন্নু যান রাজধানীর কাকরাইলে জাপার কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে। সেখানে দলের বিভিন্ন অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের পক্ষ থেকে তাকে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানানো হয়। কাকরাইল কার্যালয়ের সামনে এরশাদের প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান চুন্নু। দলের কো-চেয়ারম্যান কাজী ফিরোজ রশীদ ও সৈয়দ আবু হোসেন বাবলাও তার সঙ্গে ছিলেন। ফিরোজ রশীদ ও বাবলার ইচ্ছা ছিল মহাসচিব হওয়ার। এদিন দুপুরে রাজধানীর মিরপুরে শহিদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে গিয়ে প্রয়াত মহাসচিব জিয়াউদ্দিন বাবলুর কবর জিয়ারত করেন তার স্থলাভিষিক্ত হওয়া চুন্নু।
সোমবার সন্ধ্যা থেকে রাত প্রায় ৯টা পর্যন্ত কাকরাইল কার্যালয়ে চুন্নুর অবস্থানকালে সংক্ষিপ্ত সংবর্ধনা অনুষ্ঠান থেকে শুরু করে সবকিছুই পরিচালনা করেন দলের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও ঢাকা বিভাগীয় অতিরিক্ত মহাসচিব লিয়াকত হোসেন খোকা এমপি। এ সময় খোকা তার বক্তব্যে বলেন, ‘চুন্নু ভাইয়ের মতো একজন পরিচ্ছন্ন মানুষ পার্টির মহাসচিব হওয়ায় দলের সর্বস্তরের নেতাকর্মীরা খুশি। অন্য দলের নেতাকর্মীরাও পার্টি চেয়ারম্যানের এই সিদ্ধান্তের প্রশংসা করছেন। তার নেতৃত্বে জাপা নতুন করে ঘুরে দাঁড়াবে।’
চুন্নুকে শুভেচ্ছা জানানোর ক্ষেত্রে জ্যেষ্ঠ নেতাদের মধ্যে অবশিষ্ট ছিলেন দলের কো-চেয়ারম্যান এ বি এম রুহুল আমিন হাওলাদার। তিনিও বুধবার বনানী কার্যালয়ে গিয়ে চুন্নুর হাতে ফুল দিয়ে শুভেচ্ছা জানান। দলের ভাইস-চেয়ারম্যান ও সাবেক এমপি ইয়াহ্ইয়া চৌধুরী এ সময় হাওলাদারের সঙ্গে ছিলেন। চুন্নুকে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে পার্টি চেয়ারম্যান জি এম কাদেরকে রুহুল আমিন হাওলাদার বলেছেন, ‘দলের নেতৃত্বের প্রতি আমার আনুগত্য প্রশ্নাতীত। চুন্নু আমার মুক্তিযুদ্ধের রণাঙ্গনের বন্ধু। পার্টিকে শক্তিশালী করতে আমরা একযোগে কাজ করব।’ আর চুন্নুকে দলের সাবেক মহাসচিব হাওলাদার বলেছেন, ‘দলের যে কোনো কর্মসূচিতে আমি সব ধরনের সহযোগিতা নিয়ে আপনার পাশে থাকব।’ দলের আরেক কো-চেয়ারম্যান সালমা ইসলামও বুধবার বনানী কার্যালয়ে গিয়ে চুন্নুকে শুভেচ্ছা জানান, তিনিও মহাসচিব হতে আগ্রহী ছিলেন।
মহাসচিব হওয়ার আগে ও পরের দৃশ্যপটসহ সামগ্রিক বিষয়ে মুজিবুল হক চুন্নু সঙ্গে আলাপকালে বলেন, ‘আমাকে মহাসচিব করায় দলের সিনিয়র-জুনিয়র কারো কোনো আপত্তি নেই। সবাই চোখ বুঝে আমাকে মেনে নিয়েছেন। বুদ্ধি-পরামর্শ দিয়ে সবাই আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করছেন। ফিরোজ ভাই, বাবলা ভাই, হাওলাদার ভাই সবার সঙ্গেই আমার সুসম্পর্ক। তারা প্রত্যেকেই আমাকে বলেছেন, আপনাকে মহাসচিব করায় আমরা খুশি। মসিউর রহমান রাঙ্গাও ফোন করে শুভেচ্ছা জানিয়েছেন।’ জাপার নতুন মহাসচিব জানান, আগামী ২৪ অক্টোবর তিনি নেতাকর্মীদের সঙ্গে নিয়ে রংপুরে দলের প্রয়াত চেয়ারম্যান এইচ এম এরশাদের কবরে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানাবেন ও কবর জিয়ারত করবেন।