দিন যত যাচ্ছে এডিস মশাবাহিত ডেঙ্গুর প্রকোপ ততই বাড়ছে। রাজধানী ঢাকার পাশাপাশি সারা দেশের হাসপাতালগুলোতে ক্রমেই ডেঙ্গু রোগীর ভিড় বাড়ছে। সরকারি হিসাবে চলতি বছরে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা ১৮ হাজার ছাড়িয়ে গেছে।
এর মধ্যে বৃহস্পতিবার সকাল থেকে শুক্রবার সকাল ৮টা পর্যন্ত গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সারা দেশের হাসপাতালে আরও ১৯৬ জন রোগী ভর্তি হয়েছেন। সব মিলে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৮ হাজার ৪১ জনে। তবে গত একদিনে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যুর তথ্য পাওয়া যায়নি। চলতি বছরের এ যাবত ডেঙ্গুতে মৃত্যুবরণ করেছেন ১০৩ জন।
জনস্বাস্থ্যবিদরা বলেছেন, প্রকৃতিতে থেমে থেমে বৃষ্টিপাত ও আর্দ্রতার কারণে ডেঙ্গু রোগের বাহক এডিস মশার প্রজননের উপযোগী পরিবেশ তৈরি হয়েছে। একই সঙ্গে সিটি করপোরেশনের মেয়র, ওয়ার্ড কাউন্সিলর এবং পৌরসভার মেয়র ও কাউন্সিলররা না থাকায় মশা নিধন কর্মসূচি বন্ধ রয়েছে। নিয়মিতভাবে কাজ করছেন না মশক নিধন কর্মীরা। অভিযান পরিচালনা কার্যক্রম থেমে গেছে। এছাড়াও লার্ভিসাইড স্প্রে এবং ফগিংসহ সিটি করপোরেশনের নিয়মিত মশাবিরোধী ব্যবস্থাগুলোও উলেখযোগ্যভাবে হ্রাস পেয়েছে। ফলে ডেঙ্গুর মৌসুম হওয়ায় রাজধানীসহ সারা দেশে মশাবাহিত রোগের ঝুঁকি উদ্বেগজনকভাবে বাড়ছে। তাপমাত্রা ও আর্দ্রতা বাড়তে থাকলে এডিস মশার বংশবিস্তার আরও বাড়বে। ফলে সেপ্টেম্বরের শেষে এবং সামনের মাসগুলোতে ডেঙ্গু পরিস্থিতি আরও খারাপ হতে পারে।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের ডেঙ্গু সংক্রমণবিষয়ক সবশেষ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীদের মধ্যে চট্টগ্রাম বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৩ জন, ঢাকা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ৩৭ জন, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনে ৫৩ জন, ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনে ৫০ জন, খুলনা বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) ১৪ জন, রাজশাহী বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) সাতজন এবং রংপুর বিভাগে (সিটি করপোরেশনের বাইরে) দুজন রয়েছেন।
গত ২৪ ঘণ্টায় সারা দেশে ২৯৭ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতাল থেকে ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরে মোট ১৬ হাজার ১৯৩ জন ছাড়পত্র পেয়েছেন। চলতি বছরের ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত মোট ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছে ১৮ হাজার ৪১ জন। এর মধ্যে ৬১ দশমিক ৯ শতাংশ পুরুষ এবং ৩৮ দশমিক ১ শতাংশ মহিলা রয়েছেন। গত ২৪ ঘণ্টায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে কারও মৃত্যু হয়নি।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, চলতি বছরের জানুয়ারিতে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হন ১ হাজার ৫৫ জন, যাদের মধ্যে ১৪ জনের মৃত্যু হয়েছে। ফেব্রুয়ারিতে হাসপাতালে ভর্তি হন ৩৩৯ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। মার্চে আক্রান্ত হয়েছেন ৩১১ জন, যাদের মধ্যে পাঁচজনের মৃত্যু হয়েছে। এপ্রিলে আক্রান্ত হয়েছেন ৫০৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে দুজনের। মে-তে আক্রান্ত হয়েছেন ৬৪৪ জন, যাদের মধ্যে মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। জুনে ৭৯৮ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ৮ জনের, জুলাইয়ে ২ হাজার ৬৬৯ জন ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন, মৃত্যু হয়েছে ১২ জনের। এছাড়া আগস্টে মৃত্যু হয়েছিল ২৭ জনের এবং আক্রান্ত হয়েছিলেন ৬ হাজার ৫২১ জন। অন্যদিকে সেপ্টেম্বরে আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২০০ জন এবং মারা গেছেন ২০ জন।
চলতি বছর জানুয়ারি থেকে ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত যে ১০৩ জনের মৃত্যু হয়েছে তার মধ্যে ৬৮ জনই ঢাকার দুই সিটি করপোরেশনের। তবে সবচেয়ে বেশি ৫৯ জন ঢাকা দক্ষিণ সিটিতে।
শহীদ সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের পরিচালক ডা. মো. শফিউর রহমান বলেন, এ বছর তার হাসপাতালে ১২৩ জন ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হয়েছেন। তাদের মধ্যে ৬৪ জন সুস্থ হয়ে বাড়ি চলে গেছেন। বর্তমানে ৫৯ জন রোগী ভর্তি আছেন। এখন পর্যন্ত এই হাসপাতালে ডেঙ্গুতে কারও মৃত্যু হয়নি। গত ২ সপ্তাহ ধরে রোগীর সংখ্যা ক্রমেই বাড়ছে।
এই চিকিৎসক আরও বলেন, ডেঙ্গু হলে আতঙ্কিত হওয়া যাবে না। পর্যাপ্ত পরিমাণে তরল ও খাবার খেতে হবে। জ্বর বেশি হলে গামছা বা টাওয়েল ভিজিয়ে বারবার রোগীর শরীর মুছে দিতে হবে। পাশাপাশি চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী প্যারাসিটামল জাতীয় ওষুধ সেবন এবং ডেঙ্গু এনএস-১ ও এন্টিজেন টেস্ট করতে হবে। শারীরিক পরিস্থিতির অবনতি হলে দ্রুত হাসপাতালে নিয়ে আসতে হবে।
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের কীটতত্ত¡বিদ ড. আবু ফয়েজ আসলাম বলেন, এডিস মশা নিয়ন্ত্রণে শুধু ওষুধ ছিটালেই হবে না। একইভাবে বর্ষা মৌসুম নয়, বরং মশা নিধনে বছরজুড়েই সমন্বিত পদক্ষেপ নিতে হবে। ডেঙ্গু মোকাবিলায় অন্তর্বর্তী সরকারকে জোরালো ভ‚মিকা নিতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা আরও জানান, বিগত কয়েক বছরের পর্যালোচনায় দেখা গেছে-বর্ষার মূল মৌসুমের পরে ডেঙ্গুর প্রকোপ মারাত্মক আকার ধারণ করে। ডেঙ্গু শুধু এখন ঢাকাকেন্দ্রিক নয়, বরং সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ছে। ডেঙ্গু প্রতিরোধে কারিগরিভাবে সঠিক ও বাস্তবায়নযোগ্য একটি কর্মকৌশল দ্রুত প্রণয়ন করা জরুরি হয়ে পড়ছে।
দেশে ২০০০ সাল থেকে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখছে স্বাস্থ্য অধিদপ্তর। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয় ওই বছর। যা দেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ মৃত্যু ও আক্রান্তের রেকর্ড। যা আগে কখন দেখা যায়নি।