বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলো তারল্য বা টাকার ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বড় ধরনের চাপে পড়েছে। এই চাপ সামাল দিতে একদিকে বিভিন্ন ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় চড়া সুদে ধার নিচ্ছে।
অন্যদিকে কলমানি মার্কেট বা অন্য ব্যাংক থেকে নিচ্ছে স্বল্পমেয়াদি ধার। এই ধার নেওয়ার প্রবণতা এখন মাত্রাতিরিক্ত হারে বেড়ে গেছে। গত বুধবার একদিনেই ব্যাংকগুলো বিভিন্ন উৎস থেকে প্রায় ২৮ হাজার কোটি টাকা ধার করেছে। এর মধ্যে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা, কলমানি মার্কেট ও অন্য ব্যাংক থেকে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা ধার করেছে। সাম্প্রতিক সময়ে প্রায় প্রতিদিনই ব্যাংকগুলো মোটা অঙ্কের অর্থ ধার করছে। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি ধার করছে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে।
সূত্র জানায়, মূলত পাঁচ কারণে তারল্য ব্যবস্থাপনায় বড় চাপ তৈরি হয়েছে। এগুলো হচ্ছে- বৈদেশিক মুদ্রার সংকট মেটাতে নগদ টাকা দিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কেনায় তারল্যের একটি অংশ চলে যাচ্ছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। রপ্তানি আয় ও প্রবাসীদের রেমিট্যান্স কমার কারণে ব্যাংকগুলো কেন্দ্রীয় ব্যাংকে ডলার বিক্রি করতে পারছে না, ফলে বৈদেশিক মুদ্রা কেনা বাবদ কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে টাকার জোগান কমেছে। আমানত প্রবাহ বাড়ার তুলনায় ঋণের প্রবাহ বেশি বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ব্যাংকে যে টাকা ঢুকছে, তার চেয়ে বেশি বেরিয়ে যাচ্ছে। বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে ব্যর্থতায় তারল্যের জোগান বাড়ছে না। ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ বাড়ায় এর বিপরীতে প্রভিশন রাখতে গিয়ে মোটা অঙ্কের টাকা আটকে যাচ্ছে। কিছু দুর্বল ও সবল ব্যাংক এখন তারল্য সংকটে পড়েছে। এর মধ্যে কয়েকটি ব্যাংকে বড় ধরনের জালিয়াতির কারণে মোটা অঙ্কের টাকা বেরিয়ে গেছে। বেশ কিছু ব্যাংকে এখনো বাড়তি তারল্য রয়েছে।
এদিকে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্যের জোগান বাড়ানোর কারণে ব্যাংকগুলোতেও এর প্রবাহ বেড়েছে। একই সঙ্গে আমানত প্রবাহও বাড়তে শুরু করেছে। তবে রেমিট্যান্স কমায় তারল্যে কিছুটা ঘাটতি রয়েছে। এছাড়া আগে ব্যাংক থেকে টাকা তুলে জনগণের হাতে রাখার প্রবণতা বাড়লেও এখন তা কমছে। এতেও তারল্যের জোগান আগের চেয়ে কিছুটা বেড়েছে। এসব কারণে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য কমার প্রবণতা হ্রাস পেয়ে এখন বাড়তে শুরু করেছে। গত জুনে ব্যাংকগুলোতে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৪ লাখ ২১ হাজার কোটি টাকা। গত আগস্টে তা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৩৮ হাজার কোটি টাকা। দুই মাসে অতিরিক্ত তারল্য বেড়েছে ১৭ হাজার কোটি টাকা। ২০২১ সালের জুনে অতিরিক্ত তারল্য ছিল ৪ লাখ ৫০ হাজার কোটি টাকা, ২০২২ সালের জুনে তা কমে দাঁড়ায় ৪ লাখ ৪২ হাজার কোটি টাকায়।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন কর্মকর্তা জানান, কিছু ব্যাংক যেমন বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে তারল্য সহায়তা নিচ্ছে। আবার এর বিপরীত চিত্রও আছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের ট্রেজারি বিলের নিলামে অনেক ব্যাংক চাহিদার চেয়ে বেশি টাকার বিল কিনতে আগ্রহ দেখাচ্ছে। অর্থাৎ ওইসব ব্যাংকে অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।
গত বুধবার বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ১৯টি ব্যাংক মোট ২৪ হাজার ৪৫৫ কোটি টাকা ধার নেয়। এর মধ্যে বেশির ভাগই সাত দিন মেয়াদি বিলের আওতায়। সামান্য টাকা নেওয়া হয়েছে একদিন মেয়াদি বিলের আওতায়। এর বিপরীতে গড় সুদ নেওয়া হচ্ছে ৭ দশমিক ২৫ শতাংশ থেকে ৯ দশমিক ২৫ শতাংশ। যা ব্যাংকগুলোর আমানতের সুদের সমান। চড়া সুদে ধার নেওয়ার কারণে ব্যাংকগুলোর তহবিল ব্যবস্থাপনার খরচ বেড়ে যাচ্ছে। একইদিন কলমানি মার্কেট ও মুদ্রা বাজার থেকে এক ব্যাংক অন্য ব্যাংক থেকে ধার করেছে প্রায় সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা। গত বৃহস্পতিবার একই বাজার থেকে মোট ধার করেছে ৪ হাজার ৮৫২ কোটি টাকা। এর মধ্যে একদিনের জন্য কলমানিতে ধার নিয়েছে ৪ হাজার ৩৭০ কোটি টাকা। বাকি টাকা স্বল্পমেয়াদি ধার।
গত ২৩ অক্টোবর কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিশেষ তারল্য সহায়তার আওতায় ধার নেয় ১৬ হাজার ৯১ কোটি টাকা। সুদের হার ছিল পৌনে ৭ থেকে সোয়া ৯ শতাংশ। ২২ অক্টোবর একই উপকরণের মাধ্যমে নেয় ১৩ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। ১৯ অক্টোবর ১২ হাজার ৫১৮ কোটি টাকা। ১৮ অক্টোবর ১৪ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা ও ১৭ অক্টোবর ১৫ হাজার ৫৩২ কোটি টাকা ধার দেওয়া হয় কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে। এগুলোর সুদের হার ছিল ৬ থেকে সোয়া ৯ শতাংশ। এভাবে প্রায় প্রতিদিনই কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বিভিন্ন ব্যাংক ধার করছে।
সংশ্লিষ্টদের মতে, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর ধারদেনা নিয়মিত ঘটনা হলেও সাম্প্রতিক সময়ে তা মাত্রাতিরিক্ত বেড়ে গেছে। এই বেড়ে যাওয়াকে ভালো চোখে দেখছেন না অনেকে। তবে কেন্দ্রীয় ব্যাংক মনে করছে, দেশে ব্যাংকের সংখ্যা বেড়েছে। ঋণ আমানত বেড়েছে। তার মধ্যে আছে ডলার সংকট। এসব কারণে এখন কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে বাণিজ্যিক ব্যাংকগুলোর লেনদেন বেড়েছে। সার্বিকভাবে ব্যাংক খাতে এখন অতিরিক্ত তারল্য রয়েছে।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও পলিসি রিসার্স ইনস্টিটিউটের (পিআরআই) নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর বলেন, ব্যাংকগুলোকে আমানতের চেয়ে কম ঋণ দিতে হবে। কিন্তু তারা এখন বেশি দিচ্ছে। ঋণ আদায় বাড়াতে হবে, খেলাপি কমাতে হবে। এটি পারছে না। রেমিট্যান্স প্রবাহ বাড়াতে পারছে না। বৈদেশিক দেনা শোধে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনতে হচ্ছে। এছাড়া সরকার এখন টাকা ছাপিয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ঋণ না নিয়ে বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নিচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে আগে নেওয়া ঋণ এখন বাণিজ্যিক ব্যাংক থেকে নতুন ঋণ নিয়ে পরিশোধ করা হচ্ছে। এসব মিলে ব্যাংকগুলোর তহবিলের একটি বড় অংশ আটকে যাচ্ছে। যে কারণে তারল্য ব্যবস্থাপনায় ভারসাম্যহীনতার সৃষ্টি হয়েছে।
তিনি আরও বলেন, এ সংকট মোকাবিলা করতে হলে আমানত বাড়াতে হবে, ঋণ কমাতে হবে। বিতরণ করা ঋণ আদায় করতে হবে। খেলাপি কমাতে হবে। রেমিট্যান্স বাড়াতে হবে। একই সঙ্গে ঋণের নামে ব্যাংক থেকে টাকা পাচার হচ্ছে কিনা সেটি দেখতে হবে, হলে বন্ধ করতে হবে।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন থেকে দেখা যায়, গত অর্থবছরে ব্যাংক খাতে আমানত প্রবাহ বেড়েছিল ৮ দশমিক ৪০ শতাংশ। ঋণ প্রবাহ বেড়েছিল ১৫ দশমিক ২৫ শতাংশ। অর্থাৎ আমানতের চেয়ে ঋণ প্রবাহ বেড়েছে প্রায় দ্বিগুণ। চলতি অর্থবছরের জুলাই-আগস্টে আমানত বেড়েছে ১০ দশমিক ১৮ শতাংশ। ঋণ বেড়েছে ১৪ শতাংশ। অর্থাৎ এখনো আমানতের চেয়ে ঋণ বেশি বাড়ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য কমে যাচ্ছে।
ব্যাংকগুলো যে ঋণ বিতরণ করছে তার সিংহভাগই আদায় করতে পারছে না। ফলে খেলাপি বাড়ছে। ২০২২ সালে মোট ঋণের ৮ দশমিক ১৬ শতাংশ ছিল খেলাপি। গত জুনে তা বেড়ে ১০ দশমিক ১১ শতাংশ হয়েছে। খেলাপি ঋণ বাড়ায় তহবিলের একটি বড় অংশ আটকে আছে। খেলাপি ঋণের বিপরীতে প্রভিশন রাখতে হচ্ছে। এ খাতে আটকে আছে প্রায় ৮০ হাজার কোটি টাকা।
এদিকে ব্যাংকগুলোতে ডলার সংকট প্রকট। কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে ডলার কিনে বৈদেশিক দেনা শোধ করতে হচ্ছে। গত অর্থবছরে কেন্দ্রীয় ব্যাংক রিজার্ভ থেকে ১ হাজার ৩৫৭ কোটি ডলার ব্যাংকগুলোর কাছে বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে ব্যাংক থেকে টাকা কেন্দ্রীয় ব্যাংকে গেছে প্রায় দেড় লাখ কোটি টাকা। চলতি অর্থবছরে এখন পর্যন্ত প্রায় ৪০০ কোটি ডলার বিক্রি করেছে। এর বিপরীতে গেছে ৪২ হাজার কোটি টাকা। ওই সময়ে ১ লাখ ৯০ হাজার কোটি টাকা চলে গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকে। এসব অর্থ কেন্দ্রীয় ব্যাংক তারল্য সহায়তার আওতায় ব্যাংকগুলোকে ফিরিয়ে দিচ্ছে। ডলার সংকটের কারণে এ পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
এদিকে গত জুনের পর থেকে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স কমছে। আন্তর্জাতিক বাজারে পণ্যের দাম বেশি হওয়ায় আমদানি ব্যয়ও বেশি হচ্ছে। ফলে ব্যাংকগুলোর কাছে বাড়তি ডলার থাকছে না। এতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কাছে ডলার বিক্রিও করতে পারছে না। ফলে এ খাতেও টাকার জোগান কমে গেছে।