খেলাধুলা

দুর্দান্ত বোলিং-ফিল্ডিংয়ে আফগানিস্তানকে হারিয়ে টিকে রইল বাংলাদেশ

দেশের বাইরে টি-টোয়েন্টিতে প্রথমবার আফগানিস্তানকে হারাতে পারল বাংলাদেশ, জিইয়ে রইল এশিয়া কাপে পরের ধাপে যাওয়ার সম্ভাবনা।

অফ স্টাম্পের বাইরের ফুল লেংথ ডেলিভারিতে ব্যাট চালিয়ে দিলেন রাশিদ খান। ব্যাটের কানায় লেগে বল গেল শর্ট থার্ড ম্যানে। ফিল্ডার তাসকিন আহমেদ ক্যাচ নিয়েই হুঙ্কার ছুড়লেন। লিটন দাসের মুখে ফুটে উঠল চওড়া হাসি। রাশিদ তখন হতাশায় তাকিয়ে আকাশের দিকে। অধিনায়কের বিদায়ে শেষ হয়ে গেল আফগানিস্তানের শেষ আশা। বাংলাদেশের জয়ও কার্যত নিশ্চিত হয়ে গেল সেখানেই।

জয় ছাড়া এ দিন আর কোনো উপায় ছিল না বাংলাদেশের। ব্যাটিং ইনিংস শেষেও ছিল শঙ্কার দোলাচল। তবে দুর্দান্ত বোলিং-ফিল্ডিংয়ে ৮ রানে জিতে এশিয়া কাপে টিকে রইল লিটন কুমার দাসের দল।

অবিশ্বাস্য হলেও সত্যি, টি-টোয়েন্টিতে দেশের বাইরে ষষ্ঠবারের চেষ্টায় আফগানদের প্রথম হারাতে পারল বাংলাদেশ।

জয়ের পরও অবশ্য শেষটায় মিশে থাকল একটু অস্বস্তি। ম্যাচের ভাগ্য নিশ্চিত হয়ে যাওয়ার পর তাসকিনের শেষ ওভারে নুর আহমেদের দুই ছক্কায় রান রেটে সমীকরণ আরেকটু কঠিন হয়ে গেল বাংলাদেশের জন্য।

সুপার ফোর পর্বে খেলতে লিটনকে এখন তাকিয়ে থাকতে হবে শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান ম্যাচের দিকে। সেই ম্যাচে লঙ্কানরা জিতলে বাংলাদেশ কোনো হিসাব ছাড়াই পৌঁছে যাবে ‘সুপার ফোর’ পর্বে। আফগানরা জিতলেও বাংলাদেশের আশা টিকে থাকবে, তবে সেক্ষেত্রে লঙ্কানদের হারতে হবে বিশাল ব্যবধানে।

রান রেটের সমীকরণের আগে জয়টা ছিল জরুরি। টস জয়ী বাংলাদেশ ২০ ওভারে বাংলাদেশ তোলে ১৫৪ রান। একসময় যদিও ১৭০-১৮০ রানের পথে ছিল তারা। কিন্তু প্রথম ১০ ওভারে ১ উইকেট হারিয়ে ৮৭ রান তোলা দল পরের ১০ ওভারে করতে পারে স্রেফ ৬৭ রান!

৩১ বলে ৫২ রানের ইনিংস খেলেন তানজিদ।

মাত্র চার বিশেষজ্ঞ বোলার নিয়ে নামা বাংলাদেশ তখন বড় ঝুঁকিতে। অনিয়মিত দুই স্পিনার সাইফ হাসান ও শামীম হোসেন মিলে ৪ ওভারে ৫৫ রান দিয়ে কাজ কঠিন করেও তোলেন। তবে অন্য বোলারদের দারুণ পারফরম্যান্স ও সম্মিলিত ফিল্ডিংয়ে আফগানদের আটকে রাখা যায় ১৪৬ রানে।

তিন উইকেট নিয়ে সফলতম বোলার যদিও মুস্তাফিজুর রহমান, তবে সেরা বোলার ছিলেন নিঃসন্দেহে নাসুম আহমেদ। আসরে প্রথম খেলতে নেমে উইকেট শিকার করেন তিনি প্রথম বলেই। চার ওভারে স্রেফ ১১ রান দিয়ে দুই উইকেট নিয়ে এই বাঁহাতি স্পিনারই ম্যাচের সেরা।

সাম্প্রতিক হতাশা কাটিয়ে দুর্দান্ত বোলিং করেন রিশাদ হোসেন। এই লেগ স্পিনারের মতো দুটি উইকেট নেন তাসকিন আহমেদও।

জয়ের চেষ্টায় মরিয়া বাংলাদেশ একাদশ সাজায় চার পরিবর্তন নিয়ে। পরিবর্তন আসে উদ্বোধনী জুটিতেও।

বাংলাদেশের শুরুটা জুটি হিসেবে দারুণ। তবে নতুন উদ্বোধনী দুই ব্যাটসম্যানের ছিল দুই রূপ। সাইফ হাসানের ব্যাটিং ছিল অস্বস্তিময়, তবু টিকে যান পাওয়ার প্লের পুরোটা। ফাঁকে দু-একটি ভালো শটও খেলেন। তানজিদ ছিলেন রুদ্ররূপে। দুজনের সংযোগে শুরুর জুটিতে আসে ৬৩ রান।

প্রথম ওভাররে ফাজালহাক ফারুকির সুইংয়ে টালমাটাল সাইফ জীবন পান শূন্য রানে। বাঁহাতি এই পেসারের বলে তানজিদও সুযোগে মতো দেন। তবে তা কিপার ও স্লিপের মাঝ দিয়ে ছুটে যায় বাউন্ডারিতে। ওই ওভারে তানজিদের ব্যাট থেকে আসে চারটি বাউন্ডারি।

এএম গাজানফারকে মাথার ওপর দিয়ে উড়িয়ে দেন সাইফ, এই রহস্য স্পিনারকেই পাত্তা না দিয়ে দুটি ছক্কা মেরে দেন তানজিদ।

১১ ম্যাচ পর এই সংস্করণে অর্ধশত রানের জুটি পায় বাংলাদেশ। পাওয়ার প্লেতে ওঠে ৫৯ রান।

রাশিদ খান আক্রমণে এসেই ভাঙেন জুটি। ধৈর্য হারিয়ে স্লগ করে বোল্ড হন সাইফ (২৮ বলে ৩০)।

লিটন দাস চেষ্টা করে একটু সময় নিয়ে থিতু হওয়ার। দশম ওভারে মোহাম্মাদ নাবির বলে পুল করে তানজিদের ছক্কায় দারুণ অবস্থানে থেকে পানি পানের বিরতিতে যায় বাংলাদেশ।

বিরতির পর প্রথম বলেই ছন্দপতন। মোহাম্মাদ নুর বল হাতে নিয়েই ফেরান লিটনকে (১১ বলে ৯)। ২৮ বলে ফিফটি করা তানজিদ বিদায় নেন বাঁহাতি এই রিস্ট স্পিনারের পরের ওভারে।

তাওহিদ হৃদয়ের শুরুটা ছিল দারুণ। ক্রিজে যাওয়ার পরপরই প্রিয় সুইপে ছক্কা মারেন তিনি নুরকে। তার রানিং বিটুইন দা উইকেট ছিল দুর্দান্ত।

তবে ক্রমশ গতি হারায় বাংলাদেশের ইনিংস। রাশিদের ওভারে দুটি বাউন্ডারির পর আফগান অধিনায়কের কাছেই উইকেট হারান শামীম হোসেন (১১ বলে ১১)। হৃদয়ও পরের দিকে মেটাতে পারেননি সময়ের দাবি (২০ বলে ২৬)।

জাকের আলি ক্রিজে যাওয়ার পরপরই নুরকে চার মারলেও পরে আর ব্যাট-বলেই করতে পারছিলেন না। শাফল করে বল লেগ সাইডে টেনে মার চেষ্টায় ব্যর্থ হন বারবার। ১৯তম ওভারে টানা তিন বলে রান নিতে পারেননি তিনি। শেষ পর্যন্ত পর্যন্ত থাকেন ১২ বলে ১৩ রান করে।

শেষ দিকে দুটি বাউন্ডারিতে নুরুল হাসান সোহানের ৬ বলে ১২ রানের ইনিংসে দেড়শ ছাড়াতে পারে বাংলাদেশ।

শেষ পাঁচ ওভারে মাত্র ৩৫ রান তুলতে পারে তারা।

এই পুঁজির পর যেমন দরকার ছিল, বাংলাদেশকে ঠিক তেমন শুরুই এনে দেন নাসুম। ইনিংসের প্রথম বলেই এলবিডব্লিউ করে দেন তিনি সেদিকউল্লাহ আটালকে। একটু পরে একইভাবে তার শিকার ইব্রাহিম জাদরান (১২ বলে ৫)।

দুই উইকেট হারিয়ে পাওয়ার প্লেতে মাত্র ২৭ রান তুলতে পারে আফগানরা। জুটি গড়ে ওঠার মুখে রিশাদ হোসেন ফিরতি ক্যাচ নিয়ে ফিরিয়ে দেন গুলবাদিন নাইবকে (১৪ বলে ১৬)।

ওপেন করতে নেমে তখনও লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলেন রাহমানউল্লাহ গুরবাজ। শামীম ও সাইফকে সামনে পেয়ে দুটি ছক্কা মারেন তিনি। তবে বিপজ্জনক হয়ে ওঠার আগে তাকেও (৩১ বলে ৩৫) ফেরান রিশাদ।

মুস্তাফিজ দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে যখন ভেঙে দেন নাবির প্রতিরোধ (১৫ বলে ১৫), ম্যাচ তখন বাংলাদেশের মুঠোয়।

আজমাতউল্লাহ ওমারজাইয়ের মনে যদিও ছিল ভিন্ন ভাবনা। অনিয়মিত স্পিনার সাইফকে পেয়ে এক ওভারে ২০ রান নেন তিনি। তাসকিনকে হুক করে আছড়ে ফেলেন মাঠের বাইরে।

তবে স্লোয়ার ডেলিভারিকে ওমারজাইকে (১৬ বলে ৩০) ফিরিয়ে শোধ তোলেন তাসকিন। সোহানের অসাধারণ ফিল্ডিংয়ে রান আউট হয়ে ফেরেন কারিম জানাত।

বাংলাদেশের যন্ত্রণার যদিও শেষ হয়নি তাতে। রাশিদ ক্রিজে নেমে সহজাত ব্যাটিংয়ে আবার জাগিয়ে তোলেন আফগানদের আশা। ‘নো লুক’ শটে মুস্তাফিজকে ছক্কা মারেন তিনি, পরে চার মারেন দুটি।

সেই দ্বৈরথে শেষ পর্যন্ত রাশিদকে (১১ বলে ২০) ফিরিয়ে জিতে যান মুস্তাফিজ। সেই পথ ধরে একটু পরে জিতে যায় দলও।

এই জয় কতটা মূল্যবান, সেটি পরিস্কার হবে বৃহস্পতিবার এই মাঠেই শ্রীলঙ্কা-আফগানিস্তান লড়াইয়ে।

সংক্ষিপ্ত স্কোর:

বাংলাদেশ: ২০ ওভারে ১৫৪/৫ (সাইফ ৩০, তানজিদ ৫২, লিটন ৯, হৃদয় ২৬, শামীম ১১, জাকের ১২*, সোহান ১২*; ফারুকি ৪-০-৩৭-০, ওমারজাই ৩-০-১৯-১, গাজানফার ৩-০-৩২-০, রাশিদ ৪-০-২৬-২, নাবি ২-০-১৭-০, নুর ৪-০-২৩-২)।

আফগানিস্তান: ২০ ওভারে ১৪৬ (আটাল ০, গুরবাজ ৩৫, ইব্রাহিম ৫, নাইব ১৩, নাবি ১৫, ওমারজাই ৩০, জানাত ৬, রাশিদ ২০, নুর ১৪, গাজানফার ০, ফারুকি ২*; নাসুম ৪-১-১১-২, তাসকিন , মুস্তাফিজ ৪-০-২৮-৩, রিশাদ ৪-০-১৮-২, শামীম ১-০-১৬-০, সাইফ ৩-০-৩৯-০)।

ফল: বাংলাদেশ ৮ রানে জয়ী।

ম্যান অব দা ম্যাচ: নাসুম আহমেদ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *