অর্থনীতি

নতুন করে ‍শুল্ক-করের ‘বোঝা’ চাপ বাড়াবে জীবনযাত্রায়

“এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট। এখন এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আবার নতুন করে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।”

এক বছরের বেশি সময় ধরেই দেশে সার্বিক মূল্যস্ফীতির উল্লম্ফন ঘটেছে; কখনো খাদ্যে, কখনো খাদ্য বহির্ভূত খাতে, কখনো আবার সার্বিক মূল্যস্ফীতি ছাড়িয়েছে দুই অংকের ঘর।

উচ্চ মূল্যস্ফীতির এ সময়েও ওষুধ, এলপি গ্যাস, মোবাইলে ফোনের সিম কার্ডের মত প্রয়োজনীয় পণ্যসহ শতাধিক পণ্য ও সেবায় আমদানি, ‍উৎপাদন, সরবরাহ পর্যায়ে শুল্ক ও কর বাড়ল।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজস্ব আদায় বাড়াতে সরকার শুল্ক-কর বাড়ানোর সহজ পথ বেছে নিয়েছে। আর এই পদক্ষেপে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন সাধারণ মানুষ থেকে শুরু করে খাতসংশ্লিষ্ট ব্যবসায়ীরা।

অন্তর্বর্তী সরকারের এ সিদ্ধান্তকে ‘গণবিরোধী’ বলে মন্তব্য করেছেন রাজনীতিকদের কেউ কেউ।

রাজধানীর মহাখালী এলাকার বাসিন্দা বেসরকারি চাকুরে তানভীর জিলুই হতাশার সুরে বলেন, “সরকার খালি কর বাড়ানোর তালে আছে, আয় বাড়ল কিনা তা নিয়ে কারও মাথাব্যথা নেই। একে তো মূল্যস্ফীতি দুই অংকের নিচে নামে না, এর মধ্যে আবার এই ভ্যাট বাড়ানোতে অবশ্যই জিনিসপত্রের দাম বাড়বে। আমরা যাবো কই? আমাদের চাপ তো আরও বাড়ল।”

রাজধানীর বনানীতে একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মী আফতাব আহমেদ সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘হঠকারী’ বলছেন।

তার ভাষায়, “সরকার রাজস্ব বাড়াতে চায়, ভালো কথা। কিন্তু, সেটা বাজেটে করা যেত। এমনিতেই দীর্ঘ দিন ধরে নিত্যপণ্যের উচ্চমূল্যের চাপে মানুষ পিষ্ট। এখন এই ভ্যাট বাড়ানোর কারণে আবার নতুন করে কিছু জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাবে।”

২০২৪ সালের ৫ অগাস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর জাতীয় সংসদ বিলুপ্ত করেন রাষ্ট্রপতি। তাই অধ্যাদেশ জারি করে শুল্ক-কর বাড়িয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

বৃহস্পতিবার রাতে ‘মূল্য সংযোজন কর ও সম্পূরক শুল্ক (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ এবং ‘দ্য এক্সাইজ অ্যান্ড সল্ট (সংশোধন) অধ্যাদেশ ২০২৫’ নামে এ দুটি অধ্যাদেশ জারি করা হয়।

তার আগে ১ জানুয়ারি অন্তর্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা পরিষদের বৈঠকে মূল্য সংযোজন কর-ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক বাড়াতে এনবিআরের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়।

অধ্যাদেশ জারির পরপরই জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) এ বিষয়ে নির্দেশনা দিয়েছে; এতে তা সঙ্গে সঙ্গেই কার্যকর হয়ে গেছে।

সরকারের এমন সিদ্ধান্তের বিষয়ে অর্থ উপদেষ্টা সালেহউদ্দিন আহমেদ ও এনবিআর দাবি করেছে, এতে ভোক্তার বাড়তি মূল্য গুনতে হবে না।

শুল্ক-কর বাড়ানোর উদ্যোগ নিয়ে অর্থ উপদেষ্টা দাবি করেছিলেন, এ পদক্ষেপে নিত্যপণ্যের বাজারে ‘প্রভাব পড়বে না’।

কর আদায়কারী সংস্থা এনবিআরও একই সুরে সংবাদ বিজ্ঞপ্তি পাঠিয়ে দাবি করেছিল, মূল্যস্ফীতিতে ‘প্রভাব পড়বে না’।

তবে, এ বিষয়ে ভিন্নমত প্রকাশ করেছেন বিশ্ব ব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক প্রধান অর্থনীতিবিদ জাহিদ হোসেন।

তিনি বলেন, “যেসব পণ্যে ট্যাক্স বেড়েছে, সেগুলোর দাম তো বাড়বে। কোনো ধরনের বাস্তবতায় এটা (প্রভাব পড়বে না) তো হয় না। প্রভাব পড়বে না বলা হলে, বোধ হয় তা বাস্তবতাকে অস্বীকার করা হয়।

জাহিদ হোসেন বলেন, ভোক্তা মূল্য সূচক (সিপিআই) অনুযায়ী, এসব পণ্যের ওজন কম, দর কম, সেজন্য হয়ত মূল্যস্ফীতির হারের উপর খুবই কম প্রভাব পড়বে।

তিনি বলেন, “যেসব পণ্যের দাম বাড়ানো হল, অধিকাংশ পণ্যের ক্ষেত্রে যেগুলো ১৫ শতাংশের নিচে ছিল, সেগুলোকে ১৫ শতাংশে উঠানো হয়েছে। তার মানে ভ্যাট রেইট ইউনিফিকেশন (একীভূতকরণ), মানে সব পণ্যে একই ভ্যাট হবে, এটা তো একটা নীতি ছিল সরকারের।

“এর মধ্যে অনেক অব্যাহতি ছিল। ওই অব্যাহতিগুলোকে তুলে নেওয়া হচ্ছে। কারণ, রাজস্ব আদায় বাড়াতে হবে। রাজস্বে তো এখন পর্যন্ত কোনো প্রবৃদ্ধি নেই।”

শুল্ক ও কর বাড়ানোর জন্য এই সময়টাকে যথোপযুক্ত মনে করছেন না এই অর্থনীতিবিদ। তিনি বলেন, “এখানে সময়টি প্রশ্নবিদ্ধ। যখন খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতিও প্রায় দুই অংকের ঘরে, সেরকম একটা সময়ে ভ্যাট, ট্যাক্স বাড়ানোর এ সিদ্ধান্ত বাস্তবতার নিরিখে কতটা যৌক্তিক সে প্রশ্ন করা যেতে পারে। যদি, একীভূত করা উদ্দেশ্য হয়ে থাকে, সেটা তো আগামী বাজেটে করা যেত।”

৪৭০ কোটি ডলারের ঋণ চুক্তির শর্ত হিসেবে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল-আইএমএফ চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে বাড়তি ১২ হাজার কোটি টাকার রাজস্ব আদায় করতে বলেছে। ‘সে কারণে’ অর্থবছরের মাঝপথে এসে এভাবে হঠাৎ শুল্ক ও করের বোঝা বাড়ানোর পথে হাঁটে সরকার।

জনজীবন ‘অতিষ্ট করে তুলবে’

পণ্য ও সেবার তালিকায় চাল, ডাল, আটা, ভোজ্য তেলের মত পণ্য না থাকলেও যেসব পণ্য ও সেবার শুল্ক-কর বাড়ানো হয়েছে, এগুলোর বেশির ভাগ বর্তমান সময়ে প্রয়োজনীয় হওয়ায় তা খাদ্য বহির্ভূত মূল্যস্ফীতি উসকে দেবে বলে মনে করছেন রাজনীতিকরা।

বিদায়ী বছরের ডিসেম্বরে আগের মাসের তুলনায় কিছুটা কমে খাদ্য বহির্ভূত খাতে মূল্যস্ফীতি ছিল ৯ দশমিক ২৬ শতাংশ। নভেম্বরে যা ছিল ৯ দশমিক ৩৯ শতাংশ।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম ও সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স সরকারের এই সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।

এক যৌথ বিবৃতিতে তারা বলেছেন, “সরকার সাধারণ মানুষের ওপর পরোক্ষ কর বৃদ্ধির সিদ্ধান্ত নিয়েছে যেমন- সাধারণ মানুষের দৈনন্দিন খাদ্য বিস্কুট, সাধারণ হোটেল, মোবাইল রিচার্জ, গ্যাসসহ অপরিহার্য পণ্যের ওপর ভ্যাট বৃদ্ধি করা হয়েছে। যা সাধারণ মানুষের জীবনকে অতিষ্ট করে তুলবে।”

বিবৃতিতে বলা হয়েছে, “উচ্চ মুদ্রাস্ফীতি এবং আইএমএফের চাপে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এই সিদ্ধান্ত প্রান্তিক, স্থায়ী উপার্জনকারী এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের উপর যে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে, তা দেশের অর্থনীতিতেও সংকট তৈরি করবে।

“এসব সিদ্ধান্ত প্রকারান্তরে স্বৈরাচারী সরকারের মত জনগণের পকেট কাটার নীতি।”

বিবৃতিতে অবিলম্বে সরকারের এই সিদ্ধান্ত বাতিল, বিদেশে পাচারকৃত অর্থ, খেলাপি ঋণ আদায় ও ধনীদের প্রয়োজনীয় বিশেষ কর আরোপের আহ্বান জানান হয়।

আরেক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ কেন্দ্রীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক বজলুর রশীদ ফিরোজ বলেন, “উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির ফলে জনজীবন এমনিতেই দুর্বিসহ, তদুপরি আইএমএফের পরামর্শে অন্তর্বর্তী সরকারের এই সিদ্ধান্ত গ্রামীণ স্বল্প উপার্জনকারী এবং নিম্ন-মধ্যম আয়ের মানুষের উপর যে বিরূপ প্রভাব পড়বে, তা দেশের অর্থনীতি ও জনজীবনে গভীর সংকট তৈরি করবে।”

সরকারের এই সিদ্ধান্তকে ‘গণবিরোধী’ আখ্যা দিয়ে তা বাতিলের দাবি জানান তিনি।

কোন পণ্যে কত ভ্যাট

কিচেন টাওয়াল, টয়লেট টিস্যু, ন্যাপকিন টিস্যু, ফেসিয়াল টিস্যু, হ্যান্ড টাওয়াল, সানগ্লাস, নন-এসি হোটেল, মিষ্টান্ন ভান্ডার, প্রতিষ্ঠানের কেনাকাটা, নিজস্ব ব্র্যান্ড সম্বলিত তৈরি পোশাকের শো-রুম বা বিপণি বিতানে পণ্য ও সেবা বিক্রিতে থাকা বিদ্যমান ভ্যাট বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে। এতদিন তা সাড়ে ৭ শতাংশ ছিল।

বৈদ্যুতিক খুঁটি, মোটর গাড়ির গ্যারেজ ও ওয়ার্কশপ, ডক ইয়ার্ড, ছাপাখানা, চলচ্চিত্র স্টুডিও, চলচিত্র প্রদর্শনী (সিনেমা হল), চলচ্চিত্র পরিবেশক, মেরামত ও সার্ভিসিং, স্বয়ংক্রিয় বা যন্ত্রচালিত করাতকল, খেলাধুলা আয়োজক, পরিবহন ঠিকাদার, বোর্ড সভায় পণ্য যোগানদাতা, টেইলারিং শপ ও টেইলার্স, ভবন রক্ষণাবেক্ষণকারী সংস্থা, সামাজিক ও খেলাধুলা বিষয়ক ক্লাবে সেবার ক্ষেত্রে ভ্যাট ১০ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

আমদানি করা সুপারিতে ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, পাইন বাদাম ২০ থেকে ৩০ শতাংশ, তাজা বা শুকনা সুপারি ৩০ থেকে ৪৫ শতাংশ, আম, কমলালেবু, লেবুজাতীয় ফল, আঙ্গুর, লেবু, পেঁপে, তরমুজ, আপেল ও নাশপাতি, ফলের রস, সবজির রস, তামাক, বাদাম, পেইন্টস, পলিমার, ভার্নিশ ও লেকার, সাবান ও সাবান জাতীয় পণ্য, ডিটারজেন্ট, ফ্রুট ড্রিংকস, আর্টিফিশিয়াল বা ফ্লেভার ড্রিংকস ও ইলেক্ট্রোলাইট ড্রিংকস (কার্বোনেটেড ও নন-কার্বোনেটেড), তামাকযুক্ত সিগারেট এসব পণ্যে সম্পূরক শুল্ক ৫ থেকে ১৫ শতাংশ পর্যন্ত বাড়ানো হয়েছে।

যেসব হোটেলে মদ বা মদ জাতীয় পানীয় সরবরাহ করা হয় সেসব হোটেল বা বারের বিলের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে। রেস্তোরাঁর ক্ষেত্রেও একইভাবে মদ বা মদজাতীয় পণ্য সরবরাহ করা হলে-তার বিলের উপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ৩০ শতাংশ করা হয়েছে।

মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের উপর ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির উপর প্রথমবারের মত ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

পটেটো ফ্ল্যাকস, কর্ন, মেশিন প্রস্তুত বিস্কুট, হাতে তৈরি বিস্কুট, আচার, চাটনি, টমেটো পেস্ট বা টমেটো কেচাপ বা সস, আম, আনারস, পেয়ারা ও কলার পাল্প, তেঁতুলের পেস্ট, ব্যবহারের অযোগ্য ট্রান্সফরমার অয়েল, লুবব্লেয়িং অয়েল, এলপি গ্যাস, বাল্ক ইম্পোটেড পেট্রোলিয়াম বিটুমিন, বিআরটিএ থেকে নেওয়া লেমিনেটেড ড্রাইভিং লাইসেন্স, কঠিন শিলা, ফেরো-ম্যাঙ্গানিজ ও ফেরো-সিলিকো ম্যাঙ্গানিজ, ফেরো সিলিকন অ্যালয়, এইচ আর কয়েল থেকে সি আর কয়েল, সি আর কয়েল থেকে জিপি শিট, জি আই ওয়্যার, ৫ কেভিএ থেকে ২ হাজার কেভিএ বৈদ্যুতিক ট্রান্সফরমার, চশমার প্লাস্টিক ফ্রেম, চশমার মেটাল ফ্রেম, রিডিং গ্লাস, নারিকেলের ছোবড়া হতে তৈরি ম্যাট্রেস- এসব পণ্যের ভ্যাট ৫ থেকে বাড়িয়ে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

এছাড়া রেস্তোরাঁর ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ, ইনভেন্টিং সংস্থার ভ্যাট ৫ থেকে ১৫ শতাংশ করা হয়েছে।

স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ৫ থেকে সাড়ে ৭ শতাংশ, ওষুধের ক্ষেত্রে স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ২ দশমিক ৪ থেকে ৩ শতাংশ করা হয়েছে।

তবে এলপি গ্যাসের স্থানীয় ব্যবসায়ী পর্যায়ে ভ্যাট ২ শতাংশ বাতিল করা হয়েছে।

সিগারেটের চারটি স্তরে দাম ও শুল্ক-দুটোই বাড়ানো হয়েছে।

চলতি অর্থবছরের বাজেটেও একইভাবে বাড়ানো হয়েছিল। এর আগে কখনও একই সঙ্গে চার স্তরের দাম ও শুল্ক-কর বাড়ানোর নজির ছিল না।

অধ্যাদেশে বলা হয়েছে, নিম্নস্তরে ১০ শলাকা সিগারেটের দাম ৫০ থেকে বাড়িয়ে ৬০ টাকা করা হয়েছে। এতে প্রযোজ্য সম্পূরক শুল্ক ৬০ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে।

এছাড়া মধ্যমস্তরে ৭০ থেকে ৮০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে ৬৭ শতাংশ; উচ্চস্তরে ১২০ থেকে বাড়িয়ে ১৪০ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ এবং অতি উচ্চস্তরের দাম ১৬০ থেকে ১৮৫ টাকা এবং সম্পূরক শুল্ক ৬৫ দশমিক ৫ থেকে বাড়িয়ে ৬৭ শতাংশ করা হয়েছে।

লাইম স্টোন ও ডলোমাইটে ১০ শতাংশ হারে সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

এতদিন সিগারেটের ক্ষেত্রে সম্পূরক শুল্ক নিম্নস্তরে অন্য তিন স্তরের তুলনায় কম রাখা হত। এবারই প্রথম সম্পূরক শুল্ক একক হারে নেওয়া হল।

এ খাত থেকে এই দাম ও কর বৃদ্ধির মাধ্যমে চলতি অর্থবছরের বাকি দিনগুলোতে ৪ হাজার কোটি বাড়তি রাজস্ব আদায়ের লক্ষ্য এনবিআরের।

অপরদিকে, ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের বার্ষিক লেনদেন ৩০ লাখ থেকে ৫০ লাখ টাকা হলেই টার্নওভার কর দিতে হবে। বর্তমানে ৫০ লাখ থেকে ৩ কোটি টাকা পর্যন্ত টার্নওভারে কর দিতে হয়।

নতুন বিধান অনুযায়ী, বার্ষিক লেনদেন ৫০ লাখ টাকা পেরোলে পণ্য ও সেবা বেচাকেনায় ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট দিতে হবে।

উড়োজাহাজের টিকেটের দামও বাড়তে পারে। অধ্যাদেশ অনুযায়ী অভ্যন্তরীণ রুট ও সার্কভুক্ত দেশের বিমান টিকেটে ৫০০ টাকা হারে আবগারি শুল্ক দিতে হয়। এটা ২০০ বাড়িয়ে ৭০০ টাকা এবং সার্কভুক্ত দেশে বর্তমানের দ্বিগুণ বাড়িয়ে এক হাজার টাকা করা হয়েছে।

এছাড়া এশিয়ার দেশগুলোতে দুই হাজার থেকে বাড়িয়ে আড়াই হাজার টাকা এবং ইউরোপের দেশগুলোতে তিন হাজার থেকে বাড়িয়ে চার হাজার টাকা করা হয়েছে।

ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা যা বলছেন

ভ্যাট বাড়ানোর বিষয়টি ‘আইনসিদ্ধ’ নয় দাবি ইনসেপ্টা ফার্মাসিউটিক্যালসের চেয়ারম্যান আব্দুল মুক্তাদিরের।

তিনি বলেন, “ভ্যাট বাড়ানোর একটা নিয়ম আছে। বর্তমানে আমরা উৎপাদন থেকে পাইকারি পর্যায়ে যখন সরবরাহ করছি তখন ১৫ শতাংশ অলরেডি ভ্যাট দিচ্ছি। এরপর তারা যখন খুচরায় বিক্রি করে তার জন্য তাদের প্রফিট মার্জিন দিতে হয় ১৬ শতাংশ। ভ্যাট নিলে তাদের থেকে ১৫ শতাংশ নেওয়ার কথা ছিল।

“কিন্তু সরকার ২ লাখ প্রতিষ্ঠান এমন আছে, তাদের থেকে নিতে পারে না। ফলে সরকার আমাদেরই বলেছে, এই মার্জিনের ওপর ২ দশমিক ৪০ টাকা ভ্যাট কেটে পরিশোধ করতে। আমরা তা অগ্রিম দেই। এখন আপনি যদি ধরেন ১৬ টাকার মধ্যে ৩ টাকা দিয়ে দেব তখন ভ্যাট দাঁড়ায় ১৮ দশমিক ৭৫ শতাংশ। এটা অবৈধ।”

ঢাকা চেম্বার অব কমার্স অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রির (ডিসিসিআই) সাবেক সভাপতি রিজওয়ান রাহমান বলেন, “সরকার বলছে এর মাধ্যমে সরকারের আয় বাড়াচ্ছে। তারা আয় বাড়াচ্ছে না; আমার খরচ বাড়াচ্ছে।”

ভ্যাট না বাড়িয়ে রাজস্ব বাড়াতে ব্যবসার পরিবেশ নিশ্চিত ও সরকারের উন্নয়ন কমানোর পক্ষে পরামর্শ দিয়ে তিনি বলেন, “আপনি বিদ্যুৎ দেন, গ্যাস দেন, আমরা দরকারে ফেরি করে আমাদের পণ্য সরবরাহ করব।

“এডিপিতে খরচ কমিয়ে এটি দুই লাখ কোটি টাকায় নামিয়ে ফেলেন। এই মুহূর্তে সরকারের ৩০ শতাংশ ব্যয় কমানো সম্ভব।”

সরকারের দ্রুত রাজস্ব বাড়াতে সংস্কারের অংশ হিসেবে ভ্যাট বাড়ানো হচ্ছে মন্তব্য করে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্ট (র‍্যাপিড) চেয়ারম্যান এম এ রাজ্জাক বলেন, “কিন্তু টাইমিং একটা ফ্যাক্টর। সবকিছু সুচিন্তিত হচ্ছে না। এই মুহূর্তে মহার্ঘ্য ভাতা না দেওয়া উচিৎ ছিল। ওয়েট করা যেত। অপারেটিং বাজেট কমানো যেত। অনেক জায়গায় হাত দেওয়ার ছিল।”

এ অর্থনীতিবিদ বলেন, “পৃথিবীতে যেসব দেশে এ ধরনের ক্রাইসিস হয়, তারা যেটা করে, তা হল- তার অপারেটিং কস্ট কমিয়ে দেয়। কোনো কোনো দেশে এটি ২৫ থেকে ৩০ শতাংশ কমিয়ে ফেলা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এমন এক ফোর্স আছে, যার ফলে অপারেটিং কস্ট কমানো যাচ্ছে না।”

রেস্তোরাঁ মালিক আর মোবাইল অপারেটরদের মধ্যে ক্ষোভ

সরকারের ভ্যাট বাড়ানোর সিদ্ধান্তে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন রেস্তোরাঁ মালিক আর মোবাইল ফোন অপারেটররাও।

বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক ইমরান হোসেন বলেন, “জনগণের সরকার ক্ষমতায়; কিন্তু এমন একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে কারও সঙ্গে কোনো আলোচনা নেই। আইএমএফের কথা বলে বাজেটের মাঝপথে এভাবে জনগণের ওপর করের বোঝা চাপিয়ে দেওয়ার কোনো যুক্তি নেই।”

এটা পাড়া-মহল্লা, ফুটপাথের ছোট ব্যবসায়ীর কাছে এনবিআরের ‘চাঁদাবাজির’ নতুন ফর্মুলা বলে মন্তব্য করেন তিনি।

“সরকারের রাজস্ব কমে গেছে। সেজন্য বড়-বড় বিলাসী ব্যয়গুলো কমালেই তো পারে। আমলারা তো ঠিকই বড়-বড় বাড়ি বানাচ্ছে, গাড়ি কিনছে। সরকারের অনেক বাড়তি ব্যয় আছে, প্রয়োজনে সেগুলো কমানো হোক,” যোগ করেন রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির সাধারণ সম্পাদক।

সারাদেশে ৪ লাখ ৮২ হাজার রেঁস্তোরা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “এসব রেস্তোরাঁর ৬০ হাজার মালিক আমাদের সদস্য। আমরা আগামী দুই দিনের মধ্যে আন্দোলনের ঘোষণা দেব।”

বাংলাদেশে ইন্টারনেট সেবাদাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন-আইএসপিএবি’র সভাপতি ইমদাদুল হক বলেন, “এমনিতে বাংলাদেশে ব্রডব্যান্ডের পেনিট্রেশন অনেক কম। আপনি গ্রহকদের সুবিধা না দিতে পারলে তা আর বাড়বে না। এখন এই সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে যে বাড়তি টাকাটা দিতে হবে এটা কিন্তু সরাসরি গ্রাহকের পকেট থেকে যাবে।

“আগে যে ব্যবহারকারীকে ৫০০ টাকা দিতে হত, সম্পূরক শুল্ক আরোপের ফলে তাকে এখন থেকে দিতে হবে ৫৭৭ টাকা ৫০ পয়সা। আগে যিনি ১০০০ টাকা দিতেন, তাকে দিতে হবে ১১৫৫ টাকা। এই হারেই সবাইকে বাড়তি পেমেন্ট দিতে হবে।”

কর্পোরেট খাতে ইন্টারনেটের ব্যয় নিয়ে তারা শঙ্কায় আছেন জানিয়ে ইমদাদুল বলেন, “কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানগুলোতে ১০ হাজার টাকা বিল পাঠালে তারা এক হাজার এএআইটি (অগ্রিম আয়কর) হিসেবে কেটে রাখছে। ভ্যাট আছে ১৫ শতাংশ। ১০ শতাংশ এসডি। মানে ২৫ শতাংশ সরাসরি চলে যাচ্ছে সরকারের খাতে।

“আবার কোম্পানির বার্ষিক ট্যাক্স আছে। আমরা যত টাকা ক্লায়েন্টের কাছে থেকে পাই তার মোর দ্যান ফিফটি পার্সেন্ট নিয়ে যাচ্ছে সরকার। আমার মনে হয় এই এসডি (সম্পূরক শুল্ক) আরোপের বিষয়টি সরকারের পুনর্বিবেচনা করা উচিৎ।”

মোবাইলের রিচার্জেও অতিরিক্ত তিন শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করা হয়েছে। এর ফলে এখন ১০০ টাকা রিচার্জে একজন গ্রাহক মোটে ৪৩ টাকা ৭০ পয়সার সেবা নিতে পারবেন মোবাইল অপারেটর কাছ থেকে।

বর্তমানে মোবাইল সেবায় ১০০ টাকার রিচার্জে সম্পূরক শুল্ক, ভ্যাট ও সারচার্জ দিতে হয় ২৮ দশমিক ১ টাকা, রেভেনিউ শেয়ার ও মিনিমাম ট্যাক্স ৬ দশমিক ১ টাকা, পরোক্ষ কর ২০ দশমিক ৪ টাকা। সব মিলিয়ে ১০০ টাকা রিচার্জে কর দাঁড়ায় ৫৪ দশমিক ৬ টাকা। এর সঙ্গে সম্পূরক শুল্ক ৩ শতাংশ বাড়ানোর পর সবমিলিয়ে কর দিতে হবে ৫৬ দশমিক ৩ টাকা।

সরকারের সিদ্ধান্তে বিস্ময় প্রকাশ করে গ্রামীণফোনের চিফ কর্পোরেট অ্যাফেয়ার্স অফিসার তানভীর মোহাম্মদ বলেন, “মোবাইল ফোন ব্যবহারের ওপর হঠাৎ আরও ৩ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক আরোপ করায় আমরা বিস্মিত।

“এমন পরিস্থিতিতে এটি বাড়ানো হলো যখন ধকল কাটিয়ে উঠছে অর্থনীতি। এই নিয়ে গত সাত মাসের মধ্যে দ্বিতীয়বার সম্পূরক শুল্ক বাড়ানো হল।”

২০২৪ সালের জুনে ৫ শতাংশ কর বাড়ানো হয়েছিল। এখন আবারও ৩ শতাংশ বাড়ল। তাতে সাত মাসের মাথায় গ্রাহকদের ওপর পরোক্ষ করের বোঝা বাড়ল ৯ দশমিক ২ শতাংশ।

এখন থেকে গ্রাহকরা প্রতি ১০০ টাকার সেবা গ্রহণ করলে প্রদান করতে হবে ১৪২ দশমিক ৪৫ টাকা (ভ্যাট, সম্পূরক শুল্ক ও সারচার্জসহ)। গত বাজেটের আগে যা ছিল ১৩৩ দশমিক ২৫ টাকা।

তানভীর মোহাম্মদ বলেন, “ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তির জন্য সংকল্পবদ্ধ টেলিযোগাযোগ শিল্প। কিন্তু এমন পদক্ষেপ এই অগ্রগতি ব্যাহত করবে এবং ডিজিটাল বৈষম্য বাড়াবে।

“গ্রাহকদের স্বার্থে এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গঠনের বৃহত্তর লক্ষ্যে আমরা সরকারের কাছে এই সিদ্ধান্ত পুনর্বিবেচনার আহ্বান জানাচ্ছি।”

রবি আজিয়াটার চিফ করপোরেট অ্যান্ড রেগুলেটরি অফিসার সাহেদ আলম বলেন, “নতুন অর্থবছর শুরুর প্রায় ছয় মাস আগে একটা পরিপত্রের মাধ্যমে যেভাবে টেলিযোগাযোগ খাতের সব ধরনের সেবার ওপর সম্পূরক শুল্ক বৃদ্ধির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, সেটি আমাদের কাছে খুবই ব্যতিক্রমী মনে হয়েছে।”

আগের অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি দাবি করেন, এ ধরনের শুল্ক বৃদ্ধির ফলে সরকারের রাজস্ব আয় বৃদ্ধির প্রকৃত উদ্দেশ্য কখনো পূরণ হয় না। কারণ সাধারণ গ্রাহকেরা ব্যয় কমিয়ে এ ধরনের সেবা মূল্য বাড়ার ধাক্কা সামাল দেন।

জাতীয় রাজস্ব বোর্ড ও সরকারের কাছে সিদ্ধান্তটি পুনর্বিবেচনার জন্য তারা আবেদন করবেন বলেছেন সাহেদ আলম।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *