রাজনীতি

নামসর্বস্ব রাজনৈতিক দলের ছড়াছড়ি

দেশে নাম ও সাইনবোর্ডসর্বস্ব ভুঁইফোঁড় কিছু রাজনৈতিক দল গজিয়ে উঠেছে। সঠিক পরিসংখ্যান না থাকলেও এগুলোর সংখ্যা শতাধিক। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে নতুন আরও কিছু দল আত্মপ্রকাশের অপেক্ষায় আছে। এসব দলে নেই সর্বজন পরিচিত কোনো নেতা। রাজপথে নেই কোনো কর্মসূচি কিংবা জনবান্ধব কর্মকাণ্ড। শহরের অলিগলিতে দেওয়াললিখন, পোস্টার সাঁটানো কিংবা ব্যানার-ফেস্টুনেই সীমাবদ্ধ তাদের কার্যক্রম। ইদানীং সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এগুলো ব্যাপকভাবে নিজেদের তুলে ধরছে।

এসব দলের বেশির ভাগেরই নেই নির্বাচন কমিশনের নিবন্ধন। ইসির শর্ত অনুযায়ী সারা দেশে কমিটি ও জনসমর্থন তো দূরে থাক, অনেকের নেই কেন্দ্রীয় কার্যালয়ও। নিজের বাসা বা ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা ব্যবহার করে তথাকথিত দল পরিচালনা করছেন কেউ কেউ।

বর্তমানে নিবন্ধিত ৩৯টি রাজনৈতিক দল আছে। এগুলোর অনেকের কার্যক্রম নিয়েও রয়েছে নানা সমালোচনা। নামসর্বস্ব দলগুলোর কাজ কী-এমন প্রশ্ন সর্বত্র। তবে রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা মনে করেন, জনগণের কথা চিন্তা না করে নিজেদের আখের গোছাতেই এসব ভুঁইফোঁড় দলের সৃষ্টি। জাতীয় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে তাদের কোনো ভূমিকা নেই। এমনকি এ নিয়ে তারা ভাবেনও না। জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে এসব দলের তৎপরতা বেড়ে যায়। শক্তি বাড়াতে কয়েকটি দল মিলে গঠন করে নতুন জোট। এরপর জোটের রাজনীতি কাজে লাগিয়ে বড় দলের ওপর ভর করে ফায়দা হাসিল করে। তাদের কোনো রাজনৈতিক আদর্শ নেই।

জানতে চাইলে সুশাসনের জন্য নাগরিক-সুজন সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার বলেন, সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ ও গণতন্ত্র থাকলে এসব দল প্রাকৃতিকভাবেই বিলুপ্ত হতো। আমাদের দেশে এখনো ভালো রাজনৈতিক সংস্কৃতি গড়ে ওঠেনি। ফলে ভুঁইফোঁড় রাজনৈতিক দলগুলো তাদের নাম-প্যাড ব্যবহার করে সুযোগ-সুবিধা নেওয়ার চেষ্টা করে। জোট রাজনীতির প্রবণতাও এদের উৎসাহিত করে। কোনো জোটে ভিড়ে যদি দু-একটা সিট বাগিয়ে নেওয়া যায়, সেই চেষ্টায় থাকে। এরা দেশ ও রাজনীতিতে খুব বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে না। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, বাংলাদেশ লিবারেল ডেমোক্রেটিক পার্টি-বিএলডিপি, ন্যাশনাল ডেমোক্রেটিক পার্টি-এনডিপি, জাতীয় জনতা পার্টি, বাংলাদেশ গণসাংস্কৃতিক দল, বাংলাদেশ জনতা লীগ, বাংলাদেশ শরিয়া আন্দোলন, বাংলাদেশ লেবার পার্টি, মুসলিম লীগ, জাগপা, ন্যাশনাল পার্টি-ন্যাপ (ভাসানী), ন্যাশনাল পিপলস পার্টি, সাম্যবাদী দল, ডেমোক্রেটিক লীগ, ইসলামিক পার্টি, পিপলস লীগ, বাংলাদেশ জাতীয় দল, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলন, ভাসানী অনুসারী পরিষদ, বাংলাদেশ পিপলস পার্টি (পিপিবি), নতুন ধারা বাংলাদেশ (এনডিবি), বাংলাদেশ ন্যাশনালিস্ট ফ্রন্ট (বিএনএফ), প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক দল (পিডিপি), গণতান্ত্রিক মজদুর পার্টি, গণ আজাদী লীগসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক দল বিভিন্ন জোটে থাকলেও জোটের বাইরে তেমন কোনো তৎপরতা চোখে পড়ে না। এর বাইরে ইনসাফ পার্টি, সম্মিলিত নাগরিক পার্টি, ট্রুথ পার্টি, বাংলাদেশ জাতীয় বঙ্গলীগ, জাতীয়তাবাদী গণতান্ত্রিক আন্দোলন (এনডিএম)-সহ আরও অনেক নামসর্বস্ব দল রয়েছে। যাদের বেশির ভাগেরই নেই কোনো নিজস্ব অফিস। রাজনৈতিক কোনো কর্মসূচি নিয়ে রাজপথে দেখা যায় না। সরেজমিনে ঘুরে এবং খোঁজ নিয়ে এসব রাজনৈতিক দলের দলীয় কার্যালয়ের দেখা মেলেনি।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিগত কয়েকটি জাতীয় নির্বাচনে জনবিচ্ছিন্ন, ভুঁইফোঁড় বিভিন্ন দল ও সংগঠনকে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে দেখা গেছে। সবশেষ চারটি জাতীয় নির্বাচনে জোটের রাজনীতির সংস্কৃতি ব্যাপকভাবে দেখা যায়। এর ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে জোট ভারী করার একধরনের প্রবণতাও আছে। বড় সংখ্যার জোট গঠনে জনসম্পৃক্ত দলগুলোও জনবিচ্ছিন্ন ও পোস্টারসর্বস্ব দলগুলোকে কাছে টেনেছে। ফলে ক্ষমতার কাছাকাছি থাকতে অনেকেই নতুন দল গঠনের চেষ্টা করছে।

গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ (আরপিও) ২০০৮ অনুযায়ী তিন শর্তে রাজনৈতিক দলগুলোকে নিবন্ধন দেওয়া হয়। এতে বলা হয়, ‘নিবন্ধনে আগ্রহী দলকে দেশ স্বাধীন হওয়ার পর থেকে দরখাস্ত জমা দেওয়ার তারিখ পর্যন্ত সময়ের মধ্যে অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনের যে কোনো একটিতে কমপক্ষে একটি আসন লাভ করতে হবে। অথবা, অংশ নেওয়া আসনে কমপক্ষে পাঁচ শতাংশ ভোট পেতে হবে।’ তিন নম্বর শর্তে বলা হয়, ‘দলের কেন্দ্রীয় কমিটিসহ সক্রিয় কেন্দ্রীয় দপ্তর এবং কমপক্ষে ২২ জেলা ও ১০০ উপজেলায় কমিটিসহ সক্রিয় দপ্তর থাকতে হবে।’

নির্বাচন কমিশন প্রতিবছর রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ করলেও এদের অনেকেই আবেদন করে না। হাতেগোনা কিছু রাজনৈতিক দল নিবন্ধনের আবেদন করলেও দু-চারটি ছাড়া শর্ত পূরণে ব্যর্থ হয় বাকিরা। এ পর্যন্ত ১৬টি রাজনৈতিক দল ইসিতে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করেছে। সেগুলো হলো-এবি পার্টি, নৈতিক সমাজ, বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধা লীগ, বাংলাদেশ ন্যাশনাল রিপাবলিক পার্টি, মুসকিল লীগ, নতুন বাংলা, বঙ্গবন্ধু দুস্থ ও প্রতিবন্ধী উন্নয়ন পরিষদ, বাংলাদেশ গণতান্ত্রিক মুক্তি আন্দোলন (বিজিএমএ), বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক পার্টি (কেএসপি), বাংলাদেশ ইত্যাদি পার্টি, সোনার বাংলা উন্নয়ন লীগ-সংগঠন, প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক জোট (পিডিএ), বাংলাদেশ রিপাবলিকান পার্টি (বিআরপি), বৈরাবরী পার্টি, বাংলাদেশ বিদেশ প্রত্যাগত প্রবাসী ও ননপ্রবাসী কল্যাণ দল এবং বাংলাদেশ জনমত পার্টি।

জানতে চাইলে নির্বাচন কমিশনের (ইসি) অতিরিক্ত সচিব অশোক কুমার দেবনাথ বলেন, নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধনের জন্য অনেক রাজনৈদিক দল আবেদন করেছে। আবেদনের সময়সীমা শেষ হওয়ার পর ওই দলগুলোর তথ্য যাচাই করা হবে। যেসব দল আইন অনুযায়ী শর্ত পূরণ করতে পারবে, তাদের নিবন্ধন দেওয়ার জন্য কমিশনের কাছে সুপারিশ করা হবে। এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ইসিতে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দলগুলোর বাইরে অন্যদের তথ্য আমাদের কাছে নেই।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, দেশে বর্তমানে নিবন্ধিত রাজনৈতিক দল ৩৯টি। ২০০৮ সালে নিবন্ধন প্রক্রিয়া শুরুর পর ৪৪টি দলকে নিবন্ধন দেয় ইসি। পরবর্তী সময়ে আদালতের আদেশে এবং ইসির শর্ত পালনে ব্যর্থ হওয়ায় পাঁচটি দলের নিবন্ধন বাতিল হয়। নির্বাচন কমিশনের হিসাব মতে, ১৯৭৩ সালে দেশের প্রথম সংসদ নির্বাচনে মোট ১৪টি রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ১৯৭৯ সালের নির্বাচনে ২৯টি, ১৯৮৬ সালে ২৮টি, ১৯৮৮ সালের নির্বাচনে ৮টি, ১৯৯১ সালের পঞ্চম সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি, ১৯৯৬ সালের সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ৮১টি, ২০০১ সালের অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৫টি, ২০০৮ সালের নবম সংসদ নির্বাচনে ৩৮টি এবং দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সময় ১২টি রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেয়। তবে নির্বাচনে অংশ নিলেও সংসদে বেশির ভাগ রাজনৈতিক দলই প্রতিনিধিত্ব করতে পারেনি। অনেক ক্ষেত্রে এসব রাজনৈতিক দলের প্রায় সব প্রার্থীই জামানত হারিয়েছেন।

রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বর্তমান সংসদে আওয়ামী লীগ, বিএনপি ও জাতীয় পার্টিসহ আটটি দলের প্রতিনিধিত্ব আছে। এর আগে ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৭টি রাজতৈক দল অংশ নিলেও সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল মাত্র সাতটি দলের। নবম সংসদে প্রতিনিধিত্ব ছিল আটটি দলের। ২০০১ সালের ১ অক্টোবর অষ্টম সংসদ নির্বাচনে ৫৪ রাজনৈতিক দল অংশ নেয়। ওই সংসদেও মাত্র আটটি রজনৈতিক দলের নেতা এমপি হয়েছিলেন। ১৯৯৬ সালের ১২ জুন অনুষ্ঠিত সপ্তম সংসদ নির্বাচনে ২৮১ জন স্বতন্ত্র প্রার্থীসহ ৮১টি দল থেকে দুই হাজার ৫৭৪ প্রার্থী অংশ নিলেও সাতটি দল সংসদে প্রতিনিধিত্ব করার সুযোগ পায়। ১৯৯৬ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি ষষ্ঠ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিন দল অংশ নেয়।

আওয়ামী লীগ জাতীয় পার্টিসহ প্রায় সব বিরোধী দল এই নির্বাচন বর্জন করে। নির্বাচনে বিএনপি ২৭৮, ফ্রিডম পার্টি এক এবং স্বতন্ত্র প্রার্থীরা ১০ আসনে জয়লাভ করে। এ সংসদের মেয়াদ ছিল ১১ দিন।

১৯৯১ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ৭৫টি দল অংশ নেয়। ওই নির্বাচেন প্রায় ১৫টি রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিরা বিজয়ী হয়েছিলেন। ১৯৮৮ সালের ৩ মার্চ চতুর্থ সংসদ নির্বাচনে ছয়টি দল অংশ নেয়। সেখানে চারটি দলের প্রার্থীরা বিজয়ী হন। আওয়ামী লীগ, বিএনপি, সিপিবিসহ অধিকাংশ রাজনৈতিক দল বর্জন করে। ১৯৮৬ সালের ৭ মে তৃতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৩ দল অংশ নেয়। ওই সংসদে ১২টি দলের প্রতিনিধি ছিলেন। ৩০টি রাজনৈতিক দলের অংশগ্রহণে ১৯৭৯ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি দ্বিতীয় সংসদ নির্বাচন হয়। এ নির্বাচনেও ১২টি দলের প্রার্থীরা জয়লাভ করেন। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১৯৭৩ সালের ৭ মার্চ প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ১৫ দল অংশ নেয়। এই নির্বাচনে আওয়ামী লীগ, জাসদ ও বাংলদেশ জাতীয় লীগ-এই তিন দলের প্রতিনিধি ছিলেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *