অস্ট্রেলিয়ান কিংবদন্তি রিকি পন্টিংয়ের রাজ্য তাজম্যানিয়ায় নেদারল্যান্ডসের বিপক্ষে জয় দিয়ে বিশ্বকাপ অভিযান শুরু করার আশায় বাংলাদেশ।
অস্ট্রেলিয়ার মূল ভূ-খণ্ড থেকে বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ তাজম্যানিয়া। ভৌগলিক অবস্থানে যেমন, তেমনি আরও অনেক কিছুতেই দেশের অন্যান্য অংশ থেকে অনেকটা আলাদা এই রাজ্য। আয়তন ও জনসংখ্যায় ৬ রাজ্যের মধ্যে সবচেয়ে ছোট এটি, জীবন এখানে অস্ট্রেলিয়ার অন্য রাজ্যগুলোর মতো জাঁকালো, গতিময় ও যান্ত্রিক নয়। পাহাড়-নদী-সাগরের মিশেলে অপরূপ এক স্বর্গ যেন। ডারওয়েন্ট নদীর শান্ত জলরাশির মতোই জীবন যেখানে বয়ে চলে আপন সুখের প্রবাহে। ক্রিকেটের সুরও এখানে ভিন্ন, খুব উঁচু স্বরে তা বাজে না।
রাজ্যের রাজধানী ও সবচেয়ে বড় শহর হোবার্টের বেলেরিভ ওভাল স্টেডিয়াম আন্তর্জাতিক ক্রিকেটের স্বাদ পায় কদাচিৎ। এই মাঠে আন্তর্জাতিক ক্রিকেট শুরুর পর ৩৪ বছরে টেস্ট ম্যাচ হয়েছে স্রেফ ১৪টি। ২০১৫ ওয়ানডে বিশ্বকাপের পর এই সাড়ে ৭ বছরে আর কেবল ১টি ওয়ানডে ম্যাচ দেখেছে এখানকার দর্শকেরা। এমনকি অনেক নিস্তরঙ্গ ভূমিও আন্দোলিত হয় যে সংস্করণের দাপটে, সেই টি-টোয়েন্টি আন্তর্জাতিক ম্যাচ এখানে হয়েছে এবারের বিশ্বকাপের আগে এক যুগে কেবল ৩টি।
মাঠের দর্শক ধারণক্ষমতা ২০ হাজারের মতো। কোনো ম্যাচে একসঙ্গে ১৭ হাজারের বেশি দর্শক হওয়ার নজির এখনও নেই। তবে এই রাজ্যই অস্ট্রেলিয়াকে উপহার দিয়েছে তাদের ক্রিকেট ইতিহাসের শ্রেষ্ঠ সন্তানদের একজনকে। নাম তার রিকি থমাস পন্টিং। ব্যস, আর কোনো বাড়তি পরিচয়ের প্রয়োজন নেই।
পন্টিংয়ের জন্ম অবশ্য হোবার্টে নয়, তাজম্যানিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর লঞ্চেস্টনে। তবে তিনি যে গোটা রাজ্যেরই গর্ব-ভালোবাসার প্রতিনিধি, সেটির প্রমাণ বেলেরিভ ওভালে তার নান্দনিক এক ভাস্কর্য।
এই মাঠেরই একটি স্ট্যান্ডের নামকরণ করা হয়েছে ডেভিড বুনের নামের। পন্টিংয়ের আবির্ভাবের আগে যাকে মনে করা হতো এই রাজ্যের সবচেয়ে বিখ্যাত ক্রিকেটার। ব্যাট হাতে শৌর্য, আইকনিক গোঁফ আর শারীরিক আকৃতি মিলিয়ে আভিজাত্যপূর্ণ উপস্থিতির কারণে তাকে বলা হতো ‘তাসমানিয়ান টাইগার।’ন-পন্টিংদের সেই ক্রিকেট ভূমেই এবার পা পড়েছে বাংলাদেশ দলের। হোবার্টেই নেদারল্যান্ডসের সঙ্গে ম্যাচ দিয়ে সোমবার সাকিব আল হাসানরা শুরু করবেন তাদের বিশ্বকাপ অভিযান।
যে মাঠে অস্ট্রেলিয়ার ম্যাচেও গ্যালারি পরিপূর্ণ হয় না, যে শহরে ক্রিকেটের প্রতি লোকের আগ্রহ কিছুটা থাকলেও উন্মাদনা নেই, সেই আঙিনায় বাংলাদেশকে নিয়ে বাড়তি উচ্ছ্বাসের কোনো কারণ নেই। তবে হোবার্টের আড়াই-তিন হাজার প্রবাসী বাংলাদেশির নিস্তরঙ্গ জীবনে রোমাঞ্চের উথাল-পাথাল ঢেউ বইয়ে দিয়েছে বাংলাদেশের ম্যাচ।
ম্যাচটির জন্য প্রবল উত্তেজনা নিয়ে অপেক্ষায় তারা। পাশাপাশি আছেন শঙ্কায়ও, আবহাওয়ার পূর্বাভাস যে জানিয়ে দিচ্ছে বৃষ্টির চোখরাঙানির কথা! শহরের প্রবাসী বাংলাদেশিরা অনেকেই বললেন, তারা খুব করে চান, ম্যাচটি যেন হয়।
সেই একই চাওয়া থাকার কথা বাংলাদেশ দলেরও। প্রথম পর্বের নাটকীয় নানা সমীকরণ শেষে যখন চূড়ান্ত হলো প্রথম ম্যাচের প্রতিপক্ষ, বাংলাদেশ দলের আশার ক্যানভাসে তখন বাড়তি রঙের ছটা খেলে গেছে নিশ্চিতভাবেই। জয় দিয়ে বিশ্বকাপ শুরুর এমন সুযোগ তো সহসা মিলবে না!
বিশেষ করে, এই ম্যাচে প্রতিপক্ষ হতে পারত শ্রীলঙ্কাও। সেখানে নেদারল্যান্ডসকে পেয়ে জয়ে শুরুর হাতছানিটা স্পষ্ট করেই দেখার কথা সবার।
যদিও জয়ের হাতছানি থাকা মানেই, চূড়ান্ত লক্ষ্য ছোঁয়ার নিশ্চয়তা নয়। টি-টোয়েন্টি সংস্করণে ফেভারিট তত্ত্ব যে খুব একটা খাটে না, এটা বারবার যেমন প্রমাণিত হয়েছে, এবারের বিশ্বকাপও তেমনি সেই বার্তা দিয়েছে জোরালভাবেই। দলের সঙ্গে থাকা বিসিবির পরিচালক জালাল ইউনুস যেমন তুলে ধরলেন এই সংস্করণের সব দলের বাস্তবতা।
“আমাকে যদি জিজ্ঞেস করেন, তাহলে আমি বলব এই পর্বে যারা কোয়ালিফাই করেছে, তাদের সবারই সামর্থ্য আছে এবং তারা খুব শক্তিশালী দল। নিজেদের প্রমাণ করেই এখানে এসেছে। নামিবিয়া, স্কটল্যান্ড, নেদারল্যান্ডস, জিম্বাবুয়ে, তারা কিন্তু এই ফরম্যাটে খুব ভালো করেছে। তাদের পারফরম্যান্স খুবই ভালো ছিল। তারা কিন্তু প্রমাণ করেছে, টি-টোয়েন্টিতে তারা খুবই শক্তিশালী দল। যাদের বিপক্ষেই আমরা খেলি, তারা সবাই খুবই শক্তিশালী।”
তার নিজের সেই ভাবনার ছোঁয়া তিনি দেখেছেন ক্রিকেটারদের মধ্যেও। কোনো দলকেই কম গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে না বলেই জানালেন তিনি।
“আমি দলের কথা যেটা বলব, ওদের যে ব্রিফিংগুলো হচ্ছে, পরিকল্পনাগুলো হচ্ছে, তারা প্রতিটি দলকেই সিরিয়াসভাবে নিচ্ছে। তাদের মাথায় ছিল না কে আসবে (প্রথম রাউন্ড পেরিয়ে)… নেদারল্যান্ডস না হয়ে প্রতিপক্ষ অন্য কোনো দল থাকতে পারত, শ্রীলঙ্কা হতে পারত। সেটা যাই হোক, যে প্রতিপক্ষই হোক, তারা খুবই সিরিয়াস।”
কাউন্টি ক্রিকেটের অভিজ্ঞ একগাদা ক্রিকেটারকে নিয়ে গড়া নেদারল্যান্ডস দলকে এমনিতে খুব একটা দুর্বল ভাবার কারণ নেই। তাদের কাছে ২০১০ সালে ওয়ানডেতে ও ২০১২ সালে টি-টোয়েন্টিতে হারের অভিজ্ঞতাও আছে বাংলাদেশের। আর সত্যি বলতে, বাংলাদেশের এখন কোনো দলকে খাটো করে দেখার অবস্থা নেই। প্রতিপক্ষ নিয়ে ভাবনা তো পরে, নিজেদের অবস্থাই যাচ্ছেতাই। টি-টোয়েন্টি বিশ্বকাপের মূল পর্বে একটি জয়ের খোঁজ চলছে গত ১৫ বছর ধরে!
টিম ডিরেক্টর খালেদ মাহমুদের যদিও বিশ্বাস, এবার সেই অপেক্ষার অবসান হবে।
“ছেলেরা সবাই অনেক ভালো ট্রেনিং করেছে। প্রস্তুতি ভালো হয়েছে। তবে আমরা একসঙ্গে এখনও আমাদের সেরা খেলাটা খেলিনি। আশা করি বিশ্বকাপেই খেলব। সেই বিশ্বাস আছে।”
“সবাই জানে কাজ ভালো হয়েছে। যার যার মতো করে কাজ করেছে। সবাই নিজের ভূমিকা জানে। বিশ্বাসগুলো এখান থেকেই এসেছে। সবাই কষ্টও করেছে অনেক। যথাযথভাবে অনুশীলন করেছে সবাই।”
তবে এর চেয়েও বেশি আশা, এমন বিশ্বাস, আরও বেশি সহায়ক কন্ডিশন ছিল গত আসরে। প্রাপ্তির পালা ছিল শূন্য। এবারও তাই দেশের ক্রিকেটের অপেক্ষা থাকবে উৎকণ্ঠা নিয়েই।