জাতীয়

‘পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে আছি, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে?’

‘১৬ জুনের আওয়ামী লীগ অফিসে বোমা হামলা মামলার বাদী ছিলাম। বিএনপি-জামায়াত আমলে মৃত মায়ের চেহারা দেখা তো দূরে থাক, মুখাগ্নিও করতে পারিনি। ২৬ বছর ধরে দলের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্বে আছি। গত ২টি সিটি করপোরেশন নির্বাচনে আইভীর পক্ষে দিন-রাত এক করেছি। এখন মেয়র আইভীর মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা নিয়ে পালিয়ে আছি, এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কি হতে পারে ? কারণ, এখন তো হাইব্রিড আর কাউয়াদের দখলেই সবকিছু।’

টেলিফোনে কথাগুলো বলতে বলতে কণ্ঠ জড়িয়ে আসছিল নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহার।

নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামীলীগের সিনিয়র সহ সভাপতি ও নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন মেয়র সেলিনা হায়াৎ আইভীর দায়ের করা মামলায় নিজের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় নিজের অভিব্যক্তি এভাবেই জানিয়েছেন অ্যাডভোকেট খোকন সাহা।

এদিকে ‘খোকন দা’ নামে সুপরিচিত এই ‘পোড়খাওয়া ত্যাগী’ নেতার বিরুদ্ধে দলেরই একজন নেত্রীর দায়ের করা মামলায় গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ইস্যু নিয়ে পুরো জেলার আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের মধ্যে শুরু হয়েছে ক্ষোভ আর সমালোচনার ঝড়।

এদিকে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারির ঘটনায় ক্ষোভ শুরু হয়েছে জেলা আদালত পাড়ায়ও।

জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি হাসান ফেরদৌস জুয়েল জানান, নারায়ণগঞ্জ আইনজীবী সমিতির একাধিকবারের নির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক ছিলেন খোকন সাহা। গত দেড় যুগ ধরে নারায়ণগঞ্জ আদালতের রাজনীতিতে আওয়ামীপন্থীদের জয়ের নেপথ্যে যে ৩-৪জন আইনজীবী নেতার ভূমিকা সবচেয়ে বেশি তার মধ্যে খোকন সাহা একজন। বিএনপি-জামাত আমলে যখন আওয়ামী লীগ নেতাদের আইন পেশা চালিয়ে যাওয়া ছিল দুষ্কর, তখন খোকন সাহা সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হয়েছিলেন। তার বিরুদ্ধে এমন মামলা আর ওয়ারেন্ট ইস্যুর ঘটনা দলের জন্য অশনি সংকেত।

এ বিষয়ে নারায়ণগঞ্জ জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট আবু হাসনাত মো. শহীদ বাদল জানিয়েছেন, আমি ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার কথা শুনে খুবই হতবাক হয়েছি। শত শত নেতাকর্মীরা আমাকে ক্ষোভ জানাচ্ছেন, নিন্দা জানাচ্ছেন। খোকন সাহা মহানগর আওয়ামী লীগের ২৬ বছর যাবত সেক্রেটারির দায়িত্ব পালন করছে। তার বিরুদ্ধে যে ওয়ারেন্ট ইস্যু হয়েছে এটা আমরা কোন ভাবেই মানতে পারছি না।

তিনি আরও বলেন, সিটি নির্বাচনের পূর্বে কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দরা এসব মামলা প্রত্যাহার করার নির্দেশ দিয়েছিলেন। সেই নির্দেশ পালন করে নাই বরং ওয়ারেন্ট বের হয়েছে। এটা একেবারেই উচিত হয়নি। আমরা এ বিষয়ে কেন্দ্রে জানাবো। বাকি সিদ্ধান্ত তারা নিবেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক শাহ নিজাম ক্ষোভ জানিয়ে বলেন, এ নতুন কিছু নয়। নারায়ণগঞ্জে ত্যাগী নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে মেয়র আইভী আরও মামলা করেছেন। আইভীর দায়ের করা মামলা মাথায় নিয়ে জেলা ছাত্রলীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মিজানুর রহমান সুজন মারা গেছেন কয়েক মাস আগে। নারায়ণগঞ্জ আওয়ামীলীগের মূল ধারা কিংবা ত্যাগীদের শায়েস্তা করার জন্য বিএনপি-জামাতের প্রয়োজন নেই। মেয়র আইভীই যথেষ্ট। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই কথাটি কেন্দ্রীয় অনেক নেতাই বুঝেও নীরবতা পালন করেন।

মহানগর আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক অ্যাডভোকেট মাহমুদা মালা জানান, আইভী নির্বাচনের আগে কথা দিয়েছিলেন নির্বাচনের পর মামলা তুলে নিবেন কিন্তু তিনি উল্টো গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করালেন। মহানগর আওয়ামীলীগ এতে ব্যথিত ও মর্মাহত।

বন্দর থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও বন্দর উপজেলা চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা আব্দুর রশীদ জানান, বাংলাদেশের আইনে দেবোত্তর সম্পত্তি ক্রয় বিক্রিয়ের নিয়ম না থাকলেও দেওভোগে মেয়র আইভীর পরিবারের সদস্যরা নিজেদের নামে একটি দেবোত্তর সম্পত্তি লিখিয়ে নিয়েছেন। সেই পুকুর দখল মুক্ত করতে সামাজিক-ব্যবসায়িক-আইনজীবীসহ ২২টি সংগঠনের সঙ্গে আন্দোলন করতে গিয়ে মামলার আসামী হন অ্যাডভোকেট খোকন সাহা। সেই মামলায় এখন ওয়ারেন্ট জারি হয়েছে। এসব ঘটনা দলকে দুর্বল করবে, হাইব্রিডরা শক্তিশালী হবে। আমরা এই ঘটনার নিন্দা জানানোর ভাষা পাচ্ছি না।

এ বিষয়ে ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও কাশিপুর ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এম সাইফউল্লাহ বাদল বলেন, আমাদের দলের একজন নেতার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়াতো কোনো ছোট বিষয় না। এতে আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট হয়েছে। কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা বলেছিলেন তারা এটি সমাধান করে দিবেন কিন্তু এখনো তা করা হয়নি। প্রয়োজনে আমরা কেন্দ্রে যাব এবং এটির সমাধান করার জন্য একশবার আবেদন করবো।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক জিএম আরমান বলেন, ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়ার বিষয়টি শুনে আমি খুবই বিস্মিত হয়েছি। কেননা তারা একসঙ্গে বসে আলোচনা করে বিষয়টির সমাধান করতে পারতেন। তবে তা না করে ওয়ারেন্ট ইস্যু হওয়া খুবই দুঃখজনক। নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশন নির্বাচনের আগে যখন কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দরা নারায়ণগঞ্জে এসেছিলেন তখন এক মিটিংয়ে এই মামলার কথা বলা হয়েছিল।

ফতুল্লা থানা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও বক্তাবলী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান শওকত আলী বলেন, আমরা মনে হয় দল হিসেবে আমরা অনেক পিছিয়ে যাচ্ছি। না হলে কেন আমার দলের এক নেত্রীর দায়ের করা মামলায় আমার দলের এক নেতা যিনি ২৬ বছর ধরে নারায়ণগঞ্জ মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করছেন তার বিরুদ্ধে ওয়ারেন্ট ইস্যু হবে। এতে আমাদের দলের ভাবমূর্তি নষ্ট ছাড়া আর কিছু হচ্ছে না।

নারায়ণগঞ্জ মহানগর ছাত্রলীগ নেতা ও সরকারি তোলারাম কলেজ ছাত্রলীগের সভাপতি হাবিবুর রহমান রিয়াদ বলেন, মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহা একজন সংগ্রামী নেতা। ছাত্রজীবন থেকে তিনি আওয়ামী লীগের রাজনীতি করছে। তিনি একজন নিবেদিত প্রাণ আমাদের জন্য। এমন একজন কর্মীবান্ধব নেতার বিরুদ্ধে, আওয়ামী লীগের একজন জনপ্রতিনিধি এভাবে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করাবে এটা বোধগম্য নয়। আমি ছাত্রদের পক্ষ থেকে এই ঘটনা নিন্দা জানাই। এটা খুবই লজ্জাজনক বিষয়।

অপরদিকে আওয়ামী লীগের সাধারণ সমর্থকরা বলছেন, ক্ষমতাশীল দলের একজন শীর্ষ নেতার মামলায় আরেকজন শীর্ষ নেতার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি হওয়াটা ভালো দেখায় না। নেতায় নেতায় মতপার্থক্য থাকতেই পারে, তারা নিজেদের মধ্যে আলোচনা করে এটির সমাধান করে নিলে ভালো হতো। তারা গত সিটি করপোরেশন নির্বাচন পরিচালনা করতে আসা কেন্দ্রীয় নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষোভ প্রকাশ কওে বলেছেন, কেন্দ্রীয় নেতারা নির্বাচনের সময়েই বিষয়টি সুরাহা করতে পারতেন।

উল্লেখ্য, গত ২১ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি সেলিনা হায়াৎ আইভীর দায়ের করা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলায় মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট খোকন সাহার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছে ঢাকা সাইবার ট্রাইব্যুনাল আদালত। বৃহস্পতিবার রাতে ছড়িয়ে পরলে নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম ক্ষোভ দেখা গেছে। শুক্রবার পর্যন্ত সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে এনিয়ে ক্ষোভ জানিয়ে স্ট্যাটাস ও মন্তব্য করেছেন কয়েক হাজার নেতাকর্মী।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *