জাতীয়

প্রধানমন্ত্রীর সামনেই তিন নেতার বাহাস

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সামনেই আওয়ামী লীগের তিন কেন্দ্রীয় নেতা বাহাসে জড়িয়েছেন।

সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খান ঘটনার সূত্রপাত করার পর পর্যায়ক্রমে যুক্ত হন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক আ ফ ম বাহাউদ্দিন নাছিম ও কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য আনোয়ার হোসেন।

বৃহস্পতিবার গণভবনে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে এই তিন নেতা একে অপরকে আক্রমণ করে বক্তৃতা করেন। বৈঠকের একাধিক সূত্র জানিয়েছে, বাহাস চলার সময় একটু পরপর শাজাহান খান ও বাহাউদ্দিন নাছিমকে নিবৃত্ত করার চেষ্টা করেছেন দলের সভাপতি ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তা সত্ত্বেও প্রায় এক ঘণ্টা ধরে আওয়ামী লীগের তিন কেন্দ্রীয় নেতার এই বাহাস চলে।

দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে ইঙ্গিত করে শাজাহান খান বলেন, ‘আমি এলাকায় যেতে পারি না। বক্তৃতা দিতেও পারি না কোনো সভা-সমাবেশে। কিন্তু আমার বাপ-দাদা, চৌদ্দগোষ্ঠী আওয়ামী লীগ করতেন। আমার বাবা মাদারীপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। জবাব দেন বাহাউদ্দিন নাছিম।

শাজাহান খানের কাছে তিনি জানতে চান, আপনার বাবা আওয়ামী লীগ ছিলেন ভালো কথা, আপনি কী ছিলেন? জাসদ করতেন। আপনি তো অনেক মানুষ হত্যা করেছেন। যারা মানুষ হত্যাকারী তাদের কবর জিয়ারত আপনি করতে পারেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের কাছে যান না! আর মাদারীপুরে না গেলে আপনাকে কী জোর করে ধরে সভা-সমাবেশে নিয়ে যাওয়া হবে?

জবাবে শাজাহান খান বলেন, বাহাউদ্দিন নাছিম যা বলছেন তার ৯৮ ভাগই মিথ্যা। এর মধ্যে কোনো সত্যতা নেই। তখন যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক বাহাউদ্দিন নাছিমকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগ সভাপতি

শেখ হাসিনা বলেন, শাজাহান খান জাসদ করলেও দুর্দিনে তার কাছ থেকে সহযোগিতা পেয়েছি। তিনি বিভিন্ন প্রতিকূল সময়ে ছুটে এসে সহযোগিতা করেছেন। দলের প্রয়াত নেতা আবদুর রাজ্জাকের বাকশাল যখন সুসংগঠিত তখন তিনি (শেখ হাসিনা) মাদারীপুরে ঢুকতে পারছিলেন না। ওই সময় শাজাহান খান আওয়ামী লীগকে পেছন থেকে সহযোগিতা করতেন বলেও স্মরণ করেন শেখ হাসিনা।

তিনি আরও বলেন, আমি চেয়েছিলাম শাজাহান খান জাসদে থেকে আমাকে সহযোগিতা করুন। কিন্তু তোমরাই (নাছিম) তো তাকে আওয়ামী লীগে নিয়ে এলে। তাকে (শাজাহান খান) দলে নেওয়ার জন্য চাপও দিয়েছিলে।

সিনিয়র দুই নেতারা বাহাসে যুক্ত হন কার্যনির্বাহী সংসদের সদস্য আনোয়ার হোসেন। সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শাজাহান খানকে ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘মাদারীপুরে উনি বড় বড় কথা বলেন। বিএনপি নেত্রী শামা ওবায়েদ গিয়ে নেত্রী আপনার চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করেন। কিন্তু তিনি (শাজাহান খান) কোনো কথা বলেন না। তাকে (শামাকে) বাধা দেন না।’

আনোয়ার হোসেনের বক্তব্যের পর দলের সভাপতি শেখ হাসিনা এসব বিষয় নিয়ে আর কথা না বলার নির্দেশ দিয়ে তাদের ঐক্যবদ্ধ থাকার পরামর্শ দেন। তবে মাদারীপুরের স্থানীয় কেন্দ্রীয় এই তিন নেতার বাহাস ওই সময় বন্ধ হলেও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের এই সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরাম কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠকে আরও বেশ কিছু সময় দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে তীব্র ভাষায় কথা বলেছেন কয়েকজন কেন্দ্রীয় নেতা।

কয়েকজন এমপির অপকর্মের কারণে আওয়ামী লীগ জনসমর্থন হারাচ্ছে বলে অভিযোগ করেন নেতারা। এই নেতাদের মধ্যে ছিলেন হবিগঞ্জের জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান ও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য ডা. মুশফিক হোসেন চৌধুরী।

তিনি জানান, তার জেলায় ত্যাগী ও পুরোনো নেতারা কমিটি থেকে বাদ পড়ছেন। তখন শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্ট সাংগঠনিক সম্পাদককে উদ্দেশ করে বলেন, যাদের টাকা নেই তাদের কমিটিতে রাখবে না-এটা তো হতে পারে না। নতুনদের সঙ্গে পুরোনো ও ত্যাগী নেতাদেরও কমিটিতে রাখতে হবে।

দলীয় এমপিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ ছাড়াও তৃণমূলের কোন্দল নিয়ে কথা বলেন কোনো কোনো নেতা। তাদের মধ্যে সিরাজগঞ্জের এমপি প্রফেসর মেরিনা জাহান কবিতা তার আপন ভাই শাহজাদপুর আওয়ামী লীগের সভাপতি ও দলীয় সাবেক এমপি চয়ন ইসলামের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন।

তিনি বলেন, এলাকার যেসব নেতার সঙ্গে তার সখ্য রয়েছে তাদের কমিটি ভেঙে দিচ্ছেন চয়ন ইসলাম। কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সংসদ সদস্য পারভীন জামান কল্পনা তার নির্বাচনি এলাকার দলীয় সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন। ওই সংসদ সদস্য একটি থানা কমিটি বিতর্কিত ব্যক্তির হাতে তুলে দিয়েছেন।

সাংগঠনিক সম্পাদক বিএম মোজাম্মেল হক তার সাংগঠনিক রিপোর্ট উপস্থাপনের সময় জানান, দলের এক নেতার ছেলের বিরুদ্ধে মন্দির ভাঙার অভিযোগ রয়েছে। তখন দলের সভাপতি শেখ হাসিনা প্রশ্ন করেন, কে সে? জবাবে বিএম মোজাম্মেল হক জানান, ঝিনাইদহের শৈলকুপা উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতির ছেলে।

আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে সকাল সাড়ে ১০টার দিকে দলের বৈঠক শুরু হয়। তার সূচনা বক্তৃতার পর বিকাল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত চলে রুদ্ধদ্বার বৈঠক। বৈঠকের ফাঁকেই দলের কেন্দ্রীয় নেতাদের সঙ্গে দুপুরের খাবার খান শেখ হাসিনা। এ বৈঠকে দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে দীর্ঘ আলোচনা হয়।

নেতাদের কাছে আশঙ্কা প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, সামনে ভোটযুদ্ধ (দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন)। নির্বাচনি এই যুদ্ধকে সামনে রেখে বিভিন্ন পরাশক্তি আমাদের বিরুদ্ধে মাঠে নেমেছে। জনগণের সমর্থন নিয়েই জিতে আসতে হবে। যারা এলাকার মানুষের কাছে জনপ্রিয় এবং আওয়ামী লীগ সরকারের উন্নয়ন কাজ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করবেন, দলীয় মনোনয়নের ব্যাপারে তাদের প্রাধান্য দেওয়া হবে।

এর আগে সূচনা বক্তৃতায় তিনি সম্প্রতি অনুষ্ঠিত কয়েকটি নির্বাচন সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ হয়েছে বলে দাবি করেন। এই নির্বাচনগুলো সম্পর্কে বিদেশি কূটনীতিকদের দৃষ্টি আকর্ষণও করেন প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে। সম্প্রতি অনুষ্ঠিত বরিশাল, খুলনা, সিলেট ও রাজশাহী সিটি করপোরেশন নির্বাচন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন এবং উপনির্বাচনের কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা প্রমাণ করেছি যে, আওয়ামী লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন অবাধ হতে পারে এবং এর বিরুদ্ধে কেউ অভিযোগ করতে পারে না।

যেসব দেশ বাংলাদেশের নির্বাচনকে নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণ করছে, তাদের সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এসব নির্বাচন পর্যবেক্ষণের আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, এই নির্বাচনগুলো দেশের জনগণ স্বতঃস্ফূর্তভাবে তাদের ভোট প্রদান করেছেন। কিন্তু বিএনপি শাসনামলে উপনির্বাচনে ভোট দিতে মানুষ ভোটকেন্দ্রে যেতে পারেনি। কারণ তারা তাদের প্রার্থীদের বিজয়ী করতে ভোট লুট করেছিল।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, কানাডার একটি আদালতে যে বিএনপিকে সন্ত্রাসী সংগঠন ঘোষণা করেছে, সেই বিএনপি এখন আওয়ামী লীগকে ভোটচোর বলছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের ভোট চুরির দরকার নেই। কারণ তার দল আওয়ামী লীগ দেশ ও জনগণের কল্যাণে কাজ করার মাধ্যমে জনগণের ভোট পায় এবং এভাবে জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জন করে।

পরে রুদ্ধদ্বার বৈঠকে শেখ হাসিনা আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগেই দলকে ঐক্যবদ্ধ করার নির্দেশ দেন। দলীয় কোন্দল যাতে আর বাড়তে না পারে সেজন্য নতুন করে সংগঠনের কোনো সম্মেলন বা কমিটি না করার জন্য বলেন তিনি। তবে যেসব জেলা-উপজেলার সম্মেলনের তারিখ ঘোষণা করা আছে, সেসবের সম্মেলন শেষ করতে হবে।

বৈঠকে শুরুতে প্রধানমন্ত্রী বরিশাল, খুলনা, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশনে আওয়ামী লীগের প্রার্থীদের মেয়র নির্বাচিত করায় দেশবাসীকে অভিনন্দন জানান। তিনি বলেন, তার দল যখনই পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে, ষড়যন্ত্রের কারণেই হয়েছে। দেশের মানুষ যখনই ভোট দেওয়ার সুযোগ পেয়েছে, তারা আওয়ামী লীগকে ভোট দিয়েছে এবং ২০০৮ সালের নির্বাচনে তা প্রমাণিত হয়েছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনও হয়েছিল।

বিপরীতে, জনগণ কখনোই সন্ত্রাসী সংগঠন বিএনপিকে ভোট দেয় না। কারণ তাদের জনগণের সেবা এবং উন্নতির জন্য কাজ করার কোনো আগ্রহই নেই। বরং বড় ধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে নিজেদের আখের গোছানোর কাজেই ব্যস্ত ছিল। খুনি, সন্ত্রাসী ও যুদ্ধাপরাধীদের দল বিএনপির বিরুদ্ধে সবাইকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, দেশবাসীকে খুনি ও সন্ত্রাসীদের দল সম্পর্কে সতর্ক থাকতে হবে। কারণ তারা জনগণের কল্যাণ চায় না।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৪৯ সালের ২৩ জুন আওয়ামী লীগ প্রতিষ্ঠার পর থেকে জনগণের অধিকার আদায়ের সংগ্রাম অব্যাহত রেখেছে। আওয়ামী লীগই একমাত্র সংগঠন যা জনগণের পক্ষে কথা বলে। আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে।

কার্যনির্বাহী সংসদের বৈঠক সঞ্চালনা করেন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। উপস্থিত ছিলেন আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও সংসদ উপনেতা মতিয়া চৌধুরী এবং আওয়ামী লীগের সিনিয়র সদস্য আবুল হাসানাত আবদুল্লাহ প্রমুখ। বৈঠকে সাংগঠনিক সম্পাদকরা তাদের দায়িত্বে থাকা বিভাগগুলোর সাংগঠনিক রিপোর্ট উপস্থাপন করেন।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *