জাতীয়

বাঙ্গলার ব্যক্তিসত্তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান

ইতিহাসপূর্ব কাল থেকে গড়ে উঠেছে এই বাংলার বৃহৎ জনপদ। এই জনপদ- ‘হিমালয় থেকে সুন্দরবন হঠাৎ বাংলাদেশ’- এই বাণীবয়ানে কাব্যিক পরিচিতি লাভ করেছে। সেই ভূখণ্ডের এক তৃণমূলীয় মানুষ তথা মৌলিক ব্যক্তিসত্তার নাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। ব্যক্তিনাম থেকে ‘বঙ্গবন্ধু’ তিনি একদিনে বঙ্গবন্ধু হয়ে ওঠেননি।

১৯২০ সালে জন্মগ্রহণের পর ইতিহাসের ধারায় নিজেই নির্মাণ করেছেন নিজের স্বতন্ত্র পথরেখা। সেই সঙ্গে বাঙালির ব্যক্তিসত্তা, পারিবারিক সত্তা, গোত্র সত্তা থেকে কীভাবে জাতিসত্তায় উপনীত হয়েছে বাঙালি জাতি, সেই বিবর্তনরেখাটিও তিনি স্পষ্ট করে তুলেছেন তার সচেতন পথযাত্রায়। এটি মূলত তারই একাকী যাত্রা। কিংবদন্তি থেকে ইতিহাসে এসে নিজের ব্যক্তিঅভিজ্ঞতার নির্যাস থেকে তিনি তার মৌলিক ধারণাগুলো পেয়েছেন।

এভাবেই তিনি জেনেছেন যে, এই বঙ্গীয় অববাহিকায় গড়ে উঠেছে যে দেশ-ভূখণ্ড, যাকে আমরা বাংলাদেশ বলি, সেখানে ভাষা আছে, মানুষের মুখে। আর এই ভাষার প্রমিত নাম বাংলাভাষা, যা বাঙালির মাতৃভাষা। এই বাংলাই হচ্ছে তার অভিব্যক্তি, আর সেই অভিব্যক্তির মধ্যেই তার সদাচার ও নান্দনিকতা উন্মোচিত। সেই জনগোষ্ঠীর মধ্যে পরিবারপ্রথা আছে আর সেই প্রথাটি পরিবারটি কালে কালে বিকশিত হয়েছে গোত্রে, আর শেষাবধি বিবিধ গোত্রসত্তাও ভাষিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে ও ঐক্যে বিকশিত হয়েছে জাতিসত্তায়। এই জাতিসত্তাকে ঘিরেই বর্তমান রাষ্ট্রসত্তা। জাতিসত্তা ও প্রশাসনিক সার্বভৌমত্বের অর্জনের পর রাষ্ট্রের জন্য প্রয়োজন আইনি কাঠামো, সংবিধান ও তার বাস্তবায়ন।

দ্বিজাতিতত্ত্বের পরে দেশভাগ, তারপর ভাষা আন্দোলনের পথ ধরে বাংলাদেশ যে একটি অন্যরকম দেশ হতে পারে, তিনি এই সত্যে উপনীত হয়েছিলেন। তারপর দীর্ঘ গণতান্ত্রিক যুক্তিযুদ্ধের পর একটি প্রত্যাসন্ন ও রক্তাক্ত মুক্তিযুদ্ধের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে তার মুখেই উচ্চারিত হলো : ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, আমি বাংলার মানুষের অধিকার চাই।’

এই নির্বিকল্প উক্তির পরে তিনি দিলেন চূড়ান্ত ঘোষণা : ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই মুক্তির সংগ্রাম এবং স্বাধীনতার সংগ্রাম বাস্তবায়িত হয়েছে। তারই হাত দিয়ে হয়েছে তার বাস্তবায়ন; আর সেটি হচ্ছে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। এটাকে ভেতরে-বাইরে, স্বদেশে-বিদেশে যারা সহ্য করতে পারেনি তারাই বিরোধিতা করেছে ও করছে। এই না নিতে পারার কারণ বিবিধ। সারা পৃথিবীতে খুব বেশি জাতিরাষ্ট্র নেই। এই উপমহাদেশেও বহু জাতিসত্তা আছে, কিন্তু তারা বিকশিত হয়নি সার্বভৌম রাষ্ট্রসত্তায়।

কারণ সেখানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন মৌলিক ব্যক্তিসত্তা, মৌলিক চিন্তক-রাজনীতিক ও মৌলিক গণবীরের উপস্থিতি সহজলভ্য ছিল কিনা অনুসন্ধানযোগ্য। ফলে যারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিপক্ষে ছিল, বাঙালি জাতিসত্তার বিপক্ষে ছিল তারা তাকে সরিয়ে দিতে চেয়েছে। মাত্র সাড়ে তিনি বছরের মাথায় আন্তর্জাতিক চক্রের সহযোগিতায় এবং বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযোগে তাকে তারা সপরিবারে হত্যা করেছে। এতটাই তিনি ভালবাসতেন ও বিশ্বাস করতেন বাঙালিকে যে, তিনি তার নিজের বাসভবনে গুটিকয় পুলিশ ছাড়া অন্য কোনো সামরিক প্রহরায় ছিলেন না। ফলে যা হবার তাই হয়েছে।

যারা ষড়যন্ত্রকারী, তারা তার ঘরের ভেতর থেকে, বাইরে থেকে তার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করেছে এবং তাকে পৃথিবী থেকে শারীরিকভাবে সরিয়ে দিয়েছে। মাত্র ৫৫ বছরের জীবনের ইতিবাচক কর্মধর্ম নিয়ে বঙ্গবন্ধু অনন্তকালের জীবনে প্রবেশ করেছেন। তার আগেই তিনি বাংলা, বাঙালি, জাতিসত্তা ও জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বকে চিরকালের জন্য সুনিশ্চিত করেছেন। তিনি এই জাতিরাষ্ট্রের যে চারটি আপাত বিপরীতমুখী নীতি সন্নিবেশ করেছেন সেগুলো বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতা : এই নীতিগুলোর মধ্যে যে নিগূঢ় বন্ধনরজ্জু তা হলো মানবিক নান্দনিকতা।

এই নান্দনিকতা সব বিভাজন সত্ত্বেও মানুষে মানুষে যে সদাচারী মনের মিল বিরাজমান, তার অনুুরূপ। সব আপাত-অমিলের মধ্যেও সব মানুষের জন্য এটি সমতাশ্রয়ী মমতার মৈত্রী। আমি যদি প্রকৃত মানুষ হই, তাহলে আরেকজন মানুষকে আমি অহেতুক আঘাত করতে পারব না। মানুষ হিসাবে মানুষের সহকর্মী ও সহমর্মী হওয়ার ইতিবাচকতা সভ্যতার শুরু থেকেই চলছে। এই মানবমিলনের সূত্র মানুষের নৈয়ায়িক নান্দনিকতা।

এই নান্দনিকতাকে বঙ্গবন্ধু আমাদের সংবিধানে স্থাপন করেছিলেন বলেই সারা পৃথিবীতে এটি অনন্য। প্রতিনিয়ত দ্বন্দ্ব, যুদ্ধ ও বৈপরীত্যের মধ্যেও মানবজাতির জন্য অনুসন্ধেয় এই অভিন্ন শুদ্ধাচারের উৎস হতে পারে বিশ্বমানবতার এই সৃষ্টিশীল নানন্দিকতা। ব্যক্তি, সম্প্রদায়, জাতীয়তা, বৈশ্বিকতা ও মানবিক সদাচারের মধ্যে সূক্ষ্মতম অভিন্নতা আবিষ্কারের মাধ্যমে সর্বস্তরের জনগণকে তার ইপ্সিত মানবিক উচ্চতায় উন্নীত করার সহজতম উপায় হতে পারে স্থানিক প্রান্তিকতা থেকে বৈশ্বিক স্তর পর্যন্ত সর্বপ্রকার সৃষ্টিশীলতার ভাষিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যিক বিকাশ।

এই রূপক, তথা মডেলকে যদি অনুসরণ করা যায় তবে সারা পৃথিবীজুড়ে একটি মৌলিক পৃথিবী রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে, যা সর্বমানবিক ও মানবনান্দনিক হয়ে উঠবে বলে আশা করি। এই পরিপ্রেক্ষিতে আগস্টের যে ট্র্যাজেডি, যে শোক, সেই শোক থেকে শক্তি এবং শক্তি থেকে জাগরণ এবং সেই জাগরণ থেকেই পৃথিবীব্যাপী বাঙালি জাতিসত্তার বৈশ্বিক উদ্ভাসন নতুনভাবে ঘটবে বলে আমাদের বিশ্বাস। এখানেই জাতিরাষ্ট্র বাংলাদেশে বঙ্গবন্ধুর সাংবিধানিক নান্দনিকতার চলমান সার্থকতা।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *