মিয়ানমারে বর্বর নির্যাতনের শিকার হয়ে পালিয়ে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের দেশে ফেরাতে বিশেষ কোনো উদ্যোগ না নিয়ে উল্টো দেশটিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের বিনিয়োগ ও ব্যবসা বাড়ায় হতাশা প্রকাশ করেছেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. একে আবদুল মোমেন।
বৃহস্পতিবার একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ে বইয়ের প্রকাশনা অনুষ্ঠানে মোমেন এ হতাশা প্রকাশ করে বলেন, ‘সত্তর ও আশির দশকে রোহিঙ্গাদের যখন ফিরিয়ে নিয়েছিল মিয়ানমার, তখন তাদের ওপর নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু ২০১৭ সালের পর মিয়ানমারে আমাদের বন্ধু রাষ্ট্রগুলোর বিনিয়োগ ও ব্যবসা ব্যাপকহারে বৃদ্ধি পেয়েছে।’
২০১৭ সালের ২৫ আগস্ট মিয়ানমার সামরিক বাহিনীর বর্বর নির্যাতনের মুখে পালিয়ে আসা প্রায় ৮ লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় গ্রহণ করে। সব মিলে প্রায় ১১ লাখ রোহিঙ্গা বর্তমানে কক্সবাজার জেলা ও ভাসানচরে অবস্থান করছে।জাতিসংঘসহ আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থা মিয়ানমারের বাহিনীর ওইঅভিযানকে ‘জাতিগত নির্মূল অভিযান’ হিসেবে বর্ণনা করে আসছে।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী মোমেন বলেন, ‘স্বাধীনতার পর গত ৫০ বছরে বাংলাদেশে আমাদের সমর্থন যুগিয়ে গেছে যুক্তরাজ্য। কিন্তু এই পাঁচ দশকে আমাদের এখানে তাদের বিনিয়োগের পরিমাণ ২ দশমিক ৫ বিলিয়ন ডলার।কিন্তু গত পাঁচ বছরে মিয়ানমারে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগ ২ দশমিক ৩ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে গেছে। এটা খুব হাস্যকর শোনা যায় যে, তারা কিছু জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে।’
রাখাইন রাজ্যে পাঁচ বছর আগে দমনমূলক সেনা অভিযানের ঘটনায় দেশটির বেশ কয়েকজন জেনারেলের ওপর নিষেধাজ্ঞা দেয় যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্রসহ ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও কানাডা।
মিয়ানমারে ইউরোপের বিনিয়োগ সম্পর্কে মোমেন বলেন, ‘আমাদের অনুমান হচ্ছে, জাতিগত নিধনের উদাহরণ তৈরির পর থেকে মিয়ানমারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের বিনিয়োগ ২-৩ গুণ থেকে ১৫ গুণ বেড়েছে।
মন্ত্রী বলেন, ‘প্রায় পাঁচ বছর হতে চললেও একজন রোহিঙ্গাও তাদের ভিটেমাটিতে ফিরে যায়নি। এর মধ্যে অনেক মুখের কথা আমরা শুনেছি কিন্তু তারা যায়নি। এটা হচ্ছে সবচেয়ে কষ্টদায়ক দিক।’
জাতিসংঘ দীর্ঘদিন ধরে রোহিঙ্গা সংকটের সঙ্গে সম্পৃক্ত থাকলেও এই জনগোষ্ঠী কেবল বঞ্চিতই হয়েছে এবং বছরের পর বছর তাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ছড়ানো হয়েছে বলে অভিযোগ করেন মোমেন। বলেন, ‘এরপরও এই আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো এসব ঘটনাকে অগ্রভাগে নিয়ে আসেনি। দেখে মনে হয়, এই সংস্থাগুলোর কার্যক্রমের দুর্বলতা রয়েছে।’
আসিয়ান, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের পক্ষ থেকে প্রত্যাবাসন নিয়ে কাজ করার আশ্বাস পাওয়ার কথা জানিয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ‘চীন আগ্রহ দেখিয়েছে। তাদের মাধ্যমে একটি সভাও হয়েছে। মিটিংগুলোতে মিয়ানমার এটা-সেটা বলে, কিন্তু তারা কখনো বলেনি ওদেরকে ফেরত নেবে না। এটা তাদের বাইরের চেহারা। কিন্তু আমাদের তাদের অন্য চেহারা আমরা জানি না।’
রোহিঙ্গাদের দ্রুত সময়ে ফেরাতে না পারলে এই অঞ্চলে উগ্রবাদ ও সন্ত্রাসবাদ ছড়িয়ে পড়বে উল্লেখ করে ড. মোমেন বলেন, ‘এটা কেবল বাংলাদেশের বিষয় নয়, এটা বিশ্ববাসীর বিষয়। কিন্তু বাংলাদেশ মানবিক দিক বিবেচনায় তাদেরকে আশ্রয় দেওয়ার পর বিশ্ব নেতারা এক্ষেত্রে কাজ করতে ব্যর্থ হয়েছেন।’
অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ শরণার্থীবিষয়ক সংস্থা ইউএনএইচসিআর’র বাংলাদেশ প্রতিনিধি ইয়োহানেস ফন ডেয়ার ক্লাউভ বলেন, ‘এখন ৯ লাখের বেশি নিবন্ধনকৃত রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী ক্যাম্পগুলোতে আছে। এটা বাংলাদেশের জন্য বোঝা ও চ্যালেঞ্জের। বাংলাদেশকে এই অবস্থায় একা ফেলে রাখা যাবে না। কারণ শরণার্থী সংকট কেবল আশ্রয়দাতা দেশের দায়িত্ব নয়। এটা আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের দায়িত্বের মধ্যে পড়ে।’
রোহিঙ্গা ইস্যুকে কঠিন সংকট উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘এর গোড়ার কারণগুলো আমাদেরকে খুঁজে বের করতে হবে, আর সেটা মিয়ানমারেই রয়েছে। সেখানে তাদেরকে নাগরিক হিসাবে স্বীকৃতি, অধিকার, সেবাগ্রহণের সুযোগ ও নাগরিক হিসেবে সম্মানের সাথে বসবাসের সুযোগ দিতে হবে।’
তাদের সেই অধিকার নিশ্চিতে কূটনৈতিক ও সম্মিলিত রাজনৈতিক উদ্যোগ দরকার বলে মনে করেন ইউএনএইচসিআর প্রতিনিধি।