তারুণ্যদীপ্ত বাংলাদেশ সব চ্যালেঞ্জ কাটিয়ে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলারূপে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হবে বলে প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উপলক্ষে বুধবার জাতীয় সংসদে বিশেষ আলোচনার জন্য সাধারণ প্রস্তাব উপস্থাপনকালে তিনি এ কথা বলেন।
বুধবার বিকালে সংসদ নেতা শেখ হাসিনার এ প্রস্তাবের পর সংসদের কার্যপ্রণালী বিধির ১৪৭ বিধিতে আনা এ প্রস্তাবের ওপর স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তীর বিশেষ আলোচনা শুরু হয়েছে। আলোচনায় সরকার ও বিরোধী দলের সংসদ সদস্যরা অংশ নেবেন।
বৃহস্পতিবার বিশেষ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি কন্ঠভোটে পাসের জন্য উপস্থাপন করা হবে। অতীতের রেওয়াজ অনুযায়ী বিশেষ আলোচনা শেষে প্রস্তাবটি সর্বসম্মতক্রমে গৃহীত হতে পারে।
বুধবার সংসদের বৈঠকের শুরুতে স্মারক বক্তৃতা দেন রাষ্ট্রপতি। এরপর অধিবেশন কিছু সময়ের জন্য মুলতবি করেন স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী। পরে সংসদের বৈঠক শুরু হলে প্রস্তাব তোলেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনের এ ঐতিহাসিক মাহেন্দ্রক্ষণে তারুণ্যদীপ্ত বাংলাদেশ সব চ্যালেঞ্জে উত্তরণ ঘটিয়ে ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত, শোষণ ও বৈষম্যহীন, উন্নত ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ – জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের স্বপ্নের সোনার বাংলারূপে বিশ্বসভায় মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত হোক- এই হোক আমাদের প্রত্যয়।”
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মশতবর্ষ উপলক্ষে গত বছরের নভেম্বরে ইতিহাসে প্রথমবারের মতো বিশেষ অধিবেশনে বসে জাতীয় সংসদ। ওই অধিবেশনে বঙ্গবন্ধুর জীবন ও কর্মের উপর ভাষণ দেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ।
ওই অধিবেশনে রাষ্ট্রপতির ভাষণের পর সাধারণ প্রস্তাব আনেন সংসদ নেতা শেখ হাসিনা। এর আগে সাধারণ আলোচনার জন্য সংসদ নেতার প্রস্তাব তোলার নজির নিকট অতীতে ছিল না।
সাধারণত জাতীয় সংসদের প্রধান হুইপ বা সংসদের জ্যেষ্ঠ কোনো সদস্য সাধারণ প্রস্তাব উত্থাপন করে থাকেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্থপতি বঙ্গবন্ধুর জন্মশতবার্ষিকী সাড়ম্বরে উদযাপনে গত বছরকে ‘মুজিববর্ষ’ ঘোষণা করে নানা কর্মসূচি নিয়েছিল সরকার।
তবে করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে কর্মসূচিগুলো যথাযথভাবে করতে না পারায় মুজিববর্ষের মেয়াদ ২০২০ সালের ১৭ মার্চ থেকে ২০২১ সালের ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত বাড়ানো হয়।
এ বছরের ২৬ মার্চ বাংলাদেশ উদযাপন করেছে স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী। ১৬ ডিসেম্বর বিজয়ের ৫০তম বার্ষিকী উদযাপন করবে বাংলাদেশ।
সংসদে আলোচনার জন্য প্রধানমন্ত্রীর ১৪৭ বিধির প্রস্তাবে বলা হয়েছে, “সংসদের অভিমত এই যে, ২০২১ সালে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতার ৫০ বছর পূর্তিতে সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপন বাঙালির জাতীয় জীবনে এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলেছে বাংলাদেশ। সমগ্র বিশ্বে বাংলাদেশ আজ এক ‘উন্নয়ন বিস্ময়’।
সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে ১৯৪৮ থেকে ৫২’র ভাষা আন্দোলন, ৬৬’র ছয় দফা, ৬৯’র গণঅভূত্থান, ১৯৭১ এর ৭ মার্চের বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক ভাষণ, ২৫ মার্চ গণহত্যা, ২৬ মার্চের প্রথম প্রহরে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক স্বাধীনতার ঘোষণা, ১৭ এপ্রিল মুজিবনগর সরকার গঠন এবং এক রক্তক্ষয়ী মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে ৩০ লক্ষ মহান শহীদ ও দুই লক্ষ মা-বোনের আত্মত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত হয় স্বাধীনতা।
১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ এ পাক সেনাদের আত্মসমর্পনের মধ্য দিয়ে চূড়ান্ত বিজয় অর্জিত হয়।
“বাংলাদেশের স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি, মুক্তির মহানায়ক জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, ৩০ লক্ষ মহান শহীদ, আত্মত্যাগী ২ লক্ষ মা-বোন, সকল বীর মুক্তিযোদ্ধা, জাতীয় চার নেতা- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমদ, ক্যাপ্টেন মনসুর আলী, এ এইচ এম কামারুজ্জামানসহ সব গণতান্ত্রিক আন্দোলনের শহীদদের প্রতি জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা। ১০ জানুয়ারি ১৯৭২ স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পর জাতির পিতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন করেন।”
প্রধানমন্ত্রী প্রস্তাব উপস্থাপনকালে বলেন, “১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমান প্রথমবার জাতিসংঘে বাংলায় ভাষণ প্রদান করেন। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশ গড়ে তোলার লক্ষ্যে বিভিন্ন পরিকল্পনা গ্রহণ ও বাস্তবায়নকালে, ১৫ অগাস্ট ১৯৭৫ জাতীয় জীবনে নেমে আসে অমানিশার ঘোর অন্ধকার। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
“কারাগারের অভ্যন্তরে জাতীয় চার নেতাকে হত্যা, অবৈধভাবে ক্ষমতাদখল, সংবিধানকে সামরিক ফরমান জারি ও গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৯৬ সালে সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করা হয়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সম্পন্ন করা হয়। ২০২১ সালের রূপকল্প বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশের কাতার থেকে বেরিয়ে উন্নয়নশীল দেশরূপে স্বীকৃতি অর্জন করেছে।”
প্রস্তাবে বলা হয়, “২০০৮ সালের ঘোষিত ডিজিটাল বাংলাদেশ আজ বাস্তবতা। দারিদ্র্য হ্রাস, খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন, সারাদেশে শতভাগ বিদ্যুতায়ন, গৃহহীন ৯ লক্ষ মানুষকে ঘর তৈরি করে দেওয়া, সামাজিক নিরাপত্তা কার্যক্রম, নারী শিক্ষা ও ক্ষমতায়ন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় দক্ষতা, শিক্ষার্থীদের উপবৃত্তি, মাতৃমৃত্যু ও শিশুমৃত্যু রোধসহ মানবসম্পদ উন্নয়নের প্রতিটি ক্ষেত্রে সফলতা অর্জিত হয়েছে।
“অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, রেমিট্যান্স, রিজার্ভ প্রতিটি সূচকে অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। বিশ্ব অর্থনীতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ৪১তম। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার লক্ষ্যে ব-দ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণয়ন করা হয়েছে।”
শেখ হাসিনা বলেন, “করোনাভাইরাস অতিমারীর সংকট উত্তরণে ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ অর্থনীতির চালিকা শক্তি সচল রেখেছে। মেট্রোরেল, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব কর্ণফুলী টানেলসহ স্বঅর্থায়নে পদ্মাসেতু নির্মাণ বিশ্বে বাংলাদেশের সক্ষমতা প্রমাণ করেছে।
“ভারত ও মিয়ানমারের সঙ্গে সমুদ্রসীমা নির্ধারণ ও মহাকাশে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট উৎক্ষেপণ বাংলাদেশের সফলতার জয়যাত্রায় যুক্ত করেছে অনন্য মাইলফলক। সংসদীয় গণতন্ত্রের কেন্দ্রবিন্দু জাতীয় সংসদ সরকারের স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণের মধ্য দিয়ে জনগণের আশা-আকাঙ্খার সফল বাস্তবায়ন ও প্রত্যাশা পূরণে কার্যকর ভূমিকা রাখছে।”
প্রস্তাবটি তোলার আগে প্রধানমন্ত্রী সংসদে ভাষণ দেওয়ার জন্য রাষ্ট্রপতিকে ধন্যবাদ জানিয়ে বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতির বক্তব্য সংসদের এ আলোচনাকে গৌরবান্বিত করেছে।”