খেলাধুলা

বাংলাদেশ বোলারদের নৈপুন্যে চাপে ওয়েস্ট ইন্ডিজ

এমন নিস্তরঙ্গ প্রথম দিন শের-ই-বাংলা জাতীয় স্টেডিয়াম দেখেনি। ২২৩ রান টেস্ট শুরুর দিনের এ মাঠের সর্বনিম্ন স্কোর। তাই টস জিতে ব্যাটিং নেওয়ার আক্ষেপেও পুড়ছে না ওয়েস্ট ইন্ডিজ। ৫ উইকেট তো এখনো অক্ষত আছে। তাই বহুদিন পর দুই দলের ‘সৌহার্দে’র দিন হয়ে রইল গতকাল। হুড়মুড়িয়ে উইকেট পড়া কিংবা ব্যাটসম্যানশিপের দাপট—কোনোটাই অনুপস্থিতি এ মাঠের জন্য বিরল ঘটনাই।

যেমন বিরল সকালের উইকেটে ব্যাটসম্যানদের নির্ভয়ে ড্রাইভ আর কাট খেলতে দেখা। আভিধানিক বাংলায় আঠালো বলে। তবে ক্রিকেটের পরিভাষায় ইংরেজি ‘স্টিকি’ উপমাটা যথার্থ শোনায় বেশি। উইকেটের যে আচরণ সংশয়ের চাপে নাভিশ্বাস তুলে দেয় ব্যাটসম্যানের। কিন্তু এ যে অচেনা উইকেট! শুরু থেকেই ব্যাটফুটে গিয়ে কাটও খেলেছেন দুই ক্যারিবীয় ওপেনার ক্রেইগ ব্রাথওয়েট ও শন ক্যাম্পবেল। যেন চট্টগ্রাম টেস্টেও অসমাপ্ত দ্বিতীয় ইনিংসের আত্মবিশ্বাস এখানে নিয়ে এসেছেন তাঁরা। তরতরিয়ে রান উঠছে স্কোরবোর্ডে। বোলিং পরিবর্তনে বাংলাদেশ অধিনায়ক মমিনুল হকের অস্থিরতা দৃশ্যমান। বোলাররাও প্রতি ওভারে রানের বল দিচ্ছেন নিয়ম করে।

সাড়ে তিনের ওপর রান উঠছে তখন, ক্যারিবীয় ডাগ আউটে স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে ওঠেন কোচ ফিল সিমন্স। রিজার্ভ আম্পায়ার মাসুদুর রহমান মুকুলের আশ্বস্ত করার ভঙ্গিই বলে দিচ্ছিল অসন্তুষ্ট তিনি। সিমন্সের অসন্তোষের কারণ শন ক্যাম্পবেলের নেওয়া ‘রিভিউ’ বাতিল হওয়ার জন্য। তাইজুল ইসলামের অফস্টাম্পের বাইরে পিচ করা বল সামান্য টার্ন করে আঘাত হানছে স্টাম্পে—বল ট্র্যাকিং সেটিই দেখিয়েছে। তবে প্যাডের আগে বল ব্যাটে ছুঁয়েছে কি ছোঁয়নি, সেটি পরিষ্কার নয়। এর পরও টিভি আম্পায়ার গাজী সোহেল ‘বেনিফিট অব ডাউট’ দেননি বলেই ক্ষুব্ধ সিমন্স। সংশয়ের রায় ব্যাটসম্যানের পক্ষে যাওয়ার রীতি আছে। তবে রিভিউর ক্ষেত্রে সংশয় ‘আম্পায়ার্স কলে’র পক্ষালম্বন করাই এখনকার আইন। গাজী সোহেল সে আইন মেনে আম্পায়ার শরফুদ্দৌলা ইবনে শহিদ সৈকতের সিদ্ধান্ত আর বদলাননি। তাতে রিভিউ জড়িত আলোচনায় আরেকবার যুক্ত হলো টেস্ট অভিষিক্ত বাংলাদেশি আম্পায়ারের নাম। আর ১ উইকেটে ৮৪ রানের প্রথম সেশনের বাকিটা ক্যারিবীয়দের।

তবে মুঠো গলে দিনটা বেরিয়ে পড়ার আগে এমন কিছু দরকারও ছিল বাংলাদেশ দলের জন্য। ৬৬ রানে উদ্বোধনী জুটি এভাবে ভাঙার আগে ক্রমেই যে অক্সিজেনের লেভেল কমছিল বাংলাদেশ দলের! লাঞ্চের পর অবশ্য সৌহার্দের বার্তা হয়ে আসে শেন মোজলের উইকেটটি। মুস্তাফিজুর রহমানের পরিবর্তে এ টেস্টে একমাত্র বিশেষজ্ঞ পেসার হিসেবে খেলতে নামা আবু জায়েদ রাহীকে ‘স্বপ্নের উইকেট’ উপহার দেন তিনি। অফস্টাম্পের অনেক বাইরের বল টেনে এনে ব্যাটসম্যানের বোল্ড হওয়া উইকেট তো স্বপ্নের মতো ব্যাপারই!

প্রথম দিনে বাংলাদেশের নিজের হিস্যা বুঝে নেওয়ার শুরু এর পর থেকে। মোজলে দলীয় ৮৭ রানে বিদায় নেওয়ার পর এক ঘণ্টার মধ্যেই ক্যারিবীয় ইনিংসে ব্রেক পড়িয়ে দিয়েছে বাংলাদেশ। নিজের তৃতীয় ওভারে ব্রাথয়েটকে ড্রাইভ খেলা ফাঁদে ফেলেন সৌম্য সরকার। প্রথম স্পেলে আরো বারদুয়েক প্রতিপক্ষ ব্যাটসম্যানদের সংশয়ে ফেলেছিলেন খণ্ডকালীন এ মিডিয়াম পেসার। তবে চট্টগ্রাম টেস্ট-পরবর্তী মূল সূচকে কাইল মেয়ার্সের চেয়ে দামি কোনো উইকেট এ সিরিজে নেই। তাঁকেও ড্রাইভ খেলিয়ে তুলে নেন আবু জায়েদ। ৪ উইকেটে ১১৬ স্কোর তখন ক্যারিবীয়দের। খোলামকুচির মতো রান তোলার ঝুঁকি দুই উইকেট হারানোর পরই কমিয়ে দিয়েছিল সফরকারীরা। চট্টগ্রামের ডাবল সেঞ্চুরিয়ান মেয়ার্সের বিদায়ের পর ব্যাট গুটিয়ে নেয় ক্যারিবীয়রা। তবে কৃতিত্ব বাংলাদেশি বোলারদেরও আছে। সকালের সেশনে ‘বিক্ষিপ্ত’ বোলিং করা বোলারদের সম্ভবত দলীয় পরিকল্পনার কথা মনে পড়েছিল মধ্যাহ্ন বিরতির পর।

এর প্রভাবে দ্বিতীয় সেশনের প্রথম ঘণ্টায় ওয়েস্ট ইন্ডিজ রান তুলেছে মাত্র ২৪। আর শেষ তিন ঘণ্টায় যোগ করেছে ১১৫ রান। ২৯ ওভারের প্রথম সেশনে ৮৪ রানের অস্বস্তি তাই ভুলে গিয়েই মাঠে রেখেই হোটেলে ফিরতে পেয়েছে বাংলাদেশ।

তার মানে এই না যে প্রথম দিনের ঘটনাপ্রবাহের প্রভাবে নির্ঘুম রাত কেটেছে ক্যারিবীয়দের। মিরপুরের চিরায়ত ‘ধুন্ধুমার’ ক্রিকেটের ইতিহাস না ঘেঁটে এনক্রুমা বোনার অবিচল থেকেছেন নিজের প্রিয় টেস্ট মেজাজে। ভারতের চেতেশ্বর পূজারার অনুরক্ত তিনি বাংলাদেশি বোলারদের পরিপূর্ণ মর্যাদা দিয়েছেন। কিন্তু নিজের মহামূল্য উইকেট দেওয়ার ঝুঁকি নেননি। চট্টগ্রামে বেধড়ক মেরে ম্যাচ বের করে নিয়েছিলেন মেয়ার্স। এখন না আবার বোনারের ধৈর্যশীল ব্যাটিং ‘সার্জিক্যাল স্ট্রাইক’য়ের মতো নীরবে ক্ষয়ক্ষতি করে দিয়ে যায় বাংলাদেশ দলের!

৪২.৭৭ স্ট্রাইকরেটে ৭৪ রান নিয়ে আজ আবার ব্যাটিংয়ে নামছেন বোনার। সঙ্গী সমান সতর্ক জসুয়া সিলভা। ক্যারিবীয় লাইন আপের শেষ স্বীকৃত ব্যাটিং জুটি। তবু মনে চোরা কাটার খচখচানি উপেক্ষা করা যাচ্ছে না। দুজনের মেজাজ-মর্জি দেখে মনে হচ্ছে এঁদের স্রেফ ড্রাইভ খেলানো ফাঁদে আটকানো যাবে না। আশার কথা, প্রথম সেশনের পর থেকে যত সময় গড়িয়েছে ততই বাংলাদেশি বোলাররা লাইন আর লেংথে ভুলের মাত্রা কমিয়েছেন। দুটি উইকেট পাওয়ার কারণেই নয়, দিনের শেষ ভাগেও আর্ম বলে শিকার বাড়ানোর সম্ভাবনাও জাগিয়েছিলেন তাইজুল ইসলাম। এমনি এমনি তো আর তাঁকে সবচেয়ে বেশি ৩০ ওভার বোলিং করাননি মমিনুল।

আজ পুরো বোলিং ইউনিটের কাছেই আরো বেশি প্রত্যাশা মমিনুলের। কারণ প্রথম দিনে মিরপুরের উইকেট যতই শান্ত থাকুক না কেন, এর কোনো ভরসা নেই। কখন যে রহস্যের ঝাঁপি খুলে দেয়। তখন আবার ৩০০-ঊর্ধ্ব রানকেও মনে হতে পারে দূরের পথ। সেই গন্তব্য থেকে কিন্তু খুব দূরেও নেই ক্যারিবীয়রা। স্বভাবতই সেটি হতে দিতে চাইবেন না বাংলাদেশ অধিনায়ক। বোলাদের নিয়ন্ত্রণ খুঁজে পাওয়া আর স্লিপে নাজমুল হোসেন শান্ত ও সৌম্য সরকারের ভালো দুটি ক্যাচ মমিনুলকে আশাবাদের শক্তিও নিশ্চয় জুগিয়েছে।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *