দেশে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে (সাবস্টেশনে) আগুন দুর্ঘটনা বেড়ে গেছে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ বা বিশেষ সমস্যা ছাড়া স্বাভাবিক সময়ে গুরুত্বপূর্ণ এ কাঠামোতে আগুন লাগা দেশীয় কিংবা আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও অস্বাভাবিক। অথচ গত আট মাসে দেশে স্বাভাবিক সময়ে অন্তত চারটি এবং প্রাকৃতিক দুর্যোগে একটি উপকেন্দ্রে আগুন দুর্ঘটনা হয়েছে। এর ফলে বহুমুখী ভোগান্তিতে পড়েন স্থানীয় জনগণ। রক্ষণাবেক্ষণে দুর্বলতা, দায়িত্বে অবহেলা, আর্থিক দুর্নীতি এবং ট্রান্সফরমারসহ উপকেন্দ্রের অন্যান্য কেনাকাটায় সঠিক মান বজায় না রাখা—এ দুর্ঘটনার পেছনের কারণ বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
বিদ্যুৎ বিভাগ এবং পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) সূত্র জানায়, গত আট মাসে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন প্রান্তে অন্তত পাঁচবার বৈদ্যুতিক উপকেন্দ্রে বড় ধরনের অগ্নিকাণ্ড হয়েছে। আগুনে পুড়ে যায় বিদ্যুতৎ সঞ্চালন-বিতরণে গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র ট্রান্সফরমারসহ নানা সরঞ্জাম। ফলে দীর্ঘসময় বিদ্যুৎহীন থাকে ঐ কেন্দ্রগুলোর আওতাধীন এলাকা। সর্বশেষ গত মঙ্গলবার সকালে সিলেটের কুমারগাঁও বিদ্যুত্ উপকেন্দ্রে আগুন লাগে। অন্ধকারে থাকে সিলেট, সুনামগঞ্জ ও হবিগঞ্জ জেলা। সিলেটে বিদ্যুৎ সরবরাহ পরিস্থিতি এখনো স্বাভাবিক হয়নি।
এর আগে গত ৮ সেপ্টেম্বর দুপুরে ময়মনসিংহ শহরের কেওয়াটখালীতে আগুনে পুড়ে ট্রান্সফরমার। দুই দিন পরে ১০ সেপ্টেম্বর ঐ একই উপকেন্দ্রে আরেক দফা আগুন লাগে। ফলে প্রায় এক সপ্তাহ ময়মনসিংহ বিভাগের চার জেলায় বিদ্যুেসবা বিঘ্নিত হয়। গত ১১ এপ্রিল বিকালে রাজধানীর রামপুরার উলন গ্রিডে অগ্নিকাণ্ড ঘটে। এতে রাজধানীর বেশ কিছু এলাকা কয়েক ঘণ্টা বিদ্যুৎহীন ছিল। গত ২০ মে কুষ্টিয়ায় ভেড়ামারা সাবস্টেশনে আগুন লাগে। তবে ঘূর্ণিঝড় আম্ফানের কারণে ঐ দুর্ঘটনা হয় বলে জানিয়েছে পিজিসিবি। এছাড়া গত বছরের ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকার কেরানীগঞ্জে নির্মাণাধীন উপকেন্দ্রে আগুন লাগে। ২০১৮ সালের ৩০ মে রাজধানীর পরিবাগে ঢাকা পাওয়ার ডিস্ট্রিবিউশন কোম্পানির লোকাল গ্রিড উপকেন্দ্র অগ্নিকাণ্ডের শিকার হয়।
সিলেটে অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় গঠিত তিনটি কমিটির তদন্ত এখনো চলছে। চলতি সপ্তাহের শেষ বা আগামী সপ্তাহে প্রতিবেদন জমা পড়তে পারে। এ উপকেন্দ্রটি ১৯৬৭ সালের। এর বাণিজ্যিক সময়সীমা শেষ হয়ে গেছে। পরে নানাভাবে সংস্কার ও বর্ধিত করা হয়। তাই কিছু কারিগরি অসম্পূর্ণতা রয়ে গেছে। গ্রিড ও পিডিবির লাইনের সংযোগস্থলে এ দুর্ঘটনার সূত্রপাত। অন্য ঘটনাগুলোর তদন্ত প্রতিবেদন বা সংশ্লিষ্টরা জানান, তিনটি উপকেন্দ্রে অভ্যন্তরীণ বৈদ্যুতিক গোলযোগের কারণে অগ্নিকাণ্ডের সূত্রপাত হয়। দুইটি উপকেন্দ্রে ট্রান্সফরমারের ওপরের অংশে থাকা বুশিং থেকে আগুন লাগে। সব দুর্ঘটনার সময়ই দেখা যায় সার্কিট ব্রেকার ঠিকভাবে কাজ করেনি।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া উপকেন্দ্রে বড় ধরনের আগুন লাগা সম্পর্কে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) এক প্রকৌশলী বলেন, বৈদ্যুতিক অবকাঠামোগুলোর মধ্যে গ্রিড সাবস্টেশন খুবই স্পর্শকাতর বিষয়। এর যন্ত্রপাতি মানসম্পন্ন হওয়ার পাশাপাশি নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণ করা জরুরি। সব উপকেন্দ্রেই সার্কিট ব্রেকারসহ কিছু সুরক্ষামূলক ব্যবস্থা থাকে। অর্থাৎ কেন্দ্রের কোথাও সমস্যা-ত্রুটি দেখা দিলে তা যেন প্রকট না হয় অথবা না ছড়িয়ে পড়ে তা রোধ করতে সার্কিট ব্রেকার স্থাপন করা হয়। বিদ্যুত্ লাইনে কোনো সমস্যা দেখা দিলে ব্রেকারগুলো স্বয়ংক্রিয়ভাবে বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সিংহভাগ ক্ষেত্রেই তা হয়নি। এগুলো কাজ করেনি। তার মানে এগুলো আগে থেকেই নিম্নমানের বা ত্রুটিপূর্ণ ছিল, নয়তো পরবর্তীতে রক্ষণাবেক্ষণ ও দায়িত্বে অবহেলার কারণে অকেজো হয়ে যায়।
বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা বলেন, গ্রিড সাবস্টেশন নির্মাণের পর সেগুলোর নিয়মিত রক্ষণাবেক্ষণের নিয়ম রয়েছে। এ জন্য সরকার প্রতিবছর অর্থ বরাদ্দও দেয়। পিজিসিবিসহ অন্য কোম্পানিগুলো তা ব্যয়ও করে। কিন্তু ঐ ব্যয়ের টাকা কোথায় হয় তা নিয়ে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে। কেননা বরাদ্দ সঠিকভাবে ব্যয় করা হলে এ ধরনের দুর্ঘটনা ঘটত না।
এ প্রসঙ্গে পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশের (পিজিসিবি) ভারপ্রাপ্ত ব্যবস্থাপনা পরিচালক ইয়াকুব ইলাহী চৌধুরী জানান, কারিগরি ত্রুটি-দুর্বলতার কারণে এ আগুন দুর্ঘটনাগুলো ঘটেছে। এ ত্রুটিগুলোর কারণ আবার কয়েকটি। এক. পুরোনো সাবস্টেশন। দুই. সময়মতো রক্ষণাবেক্ষণের অভাব। এক্ষেত্রে অনেকসময় কর্মকর্তা-কর্মচারীরা দায়িত্বে অবহেলা করেন। কোম্পানির চেয়ে বিভিন্ন গ্রুপ-উপগ্রুপের প্রতি তারা দায়বদ্ধ থাকার ফলে ঠিকভাবে কাজ করেন না। আবার বিদ্যুৎ চাহিদার কারণে উপকেন্দ্র পুরোদমে বন্ধ করে রক্ষণাবেক্ষণ করাও কঠিন। একই এলাকার জন্য দুটি উপকেন্দ্র থাকলে সেভাবে সংস্কার-রক্ষণাবেক্ষণ সম্ভব হতো। তিন. সাবস্টেশনগুলোর সিংহভাগই বিদেশি ঋণ সহায়তায় নির্মিত। তাদের শর্ত পূরণ করতে গিয়ে অনেক সময় সর্বোচ্চ মানদণ্ড রক্ষা করা যায় না। এক্ষেত্রে একটি ইউনিফরম ব্যবস্থা থাকা দরকার। তিনি বলেন, সিলেটের উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের পর সরকারের শীর্ষ পর্যায়সহ সংশ্লিষ্ট সবাই এ বিষয়ে একটি সমন্বিত ব্যবস্থা গ্রহণ ও সমাধানের ব্যাপারে একমত হয়েছেন। এখন সেভাবেই কাজ এগিয়ে নেওয়া হবে।
বুয়েটের অধ্যাপক ইজাজ হোসেন বলেন, বিদ্যুৎ উপকেন্দ্রে আগুন লাগা কোনো স্বাভাবিক বিষয় নয়। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার এবং রক্ষণাবেক্ষণে অবহেলার কারণে এমন দুর্ঘটনা ঘটতে পারে। নিম্নমানের যন্ত্রপাতি ব্যবহার বন্ধ এবং রক্ষণাবেক্ষণে যত্নশীল না হলে এমন অগ্নিকাণ্ড বন্ধ হবে না।
তড়িৎ প্রকৌশলী এবং কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম বলেন, ঠিকাদারদের নিম্নমানের যন্ত্রপাতি সরবরাহের সুযোগ দিচ্ছে অনেকে। পাশাপাশি রক্ষণাবেক্ষণ কাজে গাফিলতি রয়েছে। এদিকে কেন্দ্রীয়ভাবে বিদ্যুত্ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা রক্ষার উপায় নির্ধারণে একটি উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করেছে সরকার। ঐ কমিটির সদস্য এবং পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসেন বলেন, উপকেন্দ্রে অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনাগুলো সরকার সিরিয়াসলি গ্রহণ করেছে। কারণ খতিয়ে দেখার পাশাপাশি দোষীদেরও শনাক্ত করা হবে। এছাড়া ভবিষ্যতে যেন এমন দুর্ঘটনা না হয় সে ব্যবস্থাও গ্রহণ করা হচ্ছে। বিদ্যুৎ ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা নিরীক্ষণ ও মূল্যায়নে প্রতি মাসে বৈঠকও করবে কমিটি।