নির্বাচনকালীন নির্দলীয় সরকারের দাবিতে আন্দোলনকারী বিএনপির সঙ্গে এ বিষয়ে কোনো আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা।
তিনি বলেছেন, কাদের সঙ্গে আলোচনা করব? একে তো সাজাপ্রাপ্ত আসামি, তারপর আবার আমার বাবা-মা, ভাই-বোনদের খুনি। তারপরও দেশের স্বার্থে, জনগণের স্বার্থে, গণতন্ত্রকে রক্ষার জন্য কিন্তু আমি অনেক উদারতা দেখিয়েছি। তবে এখন আর তাদের (বিএনপি) সঙ্গে কথা বলার মতো কিছু নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে ভয়েস অব আমেরিকার বাংলা বিভাগকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি এসব কথা বলেন। ভয়েস অব আমেরিকার শতরূপা বড়ুয়াকে দেওয়া ভিডিও সাক্ষাৎকারটি সোমবার সম্প্রচারিত হয়।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা কিন্তু বারবার বিএনপির সঙ্গে আলোচনা করেছি, ২০১৮- এর নির্বাচনেও। আসলে বিএনপি এমন একটা রাজনৈতিক দল, এই দলটা সৃষ্টি করেছে একজন মিলিটারি ডিক্টেটর, যে ১৯৭৫ সালে আমার বাবা-মা, ভাই-বোনদের হত্যা করেছে। একজন রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করে পেছনের দরজা দিয়ে ক্ষমতায় এসেছে।
তিনি বলেন, ক্ষমতায় আসার আগে কিন্তু আমার বাবাকে হত্যা করা হলো, তারপর যিনি ক্ষমতায়- তাকে সরাল, তারপরে আরেকজন চিফ জাস্টিস সায়েম তাকে সরিয়ে অস্ত্র হাতে জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় আসে। তারপর সে একটা রাজনৈতিক দল করে। একজন সেনাপ্রধান নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা দিয়ে চেয়ারে বসল, তারপর হ্যাঁ-না ভোটের নামে নাটক করা হলো। একথা সবাইকে মনে রাখতে হবে যে, অস্ত্র হাতে নিয়ে ক্ষমতা দখল করে, ক্ষমতায় বসে থেকে যে রাজনৈতিক দল সৃষ্টি করেছে, সেটাই হচ্ছে বিএনপি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৮-এর নির্বাচন নিয়ে কিন্তু কারও কোনো অভিযোগ নেই। তখন আমাদের ছিল ১৪ দলীয় জোট, আর বিএনপি নেতৃত্বে ছিল ২০ দলীয় জোট। তাদের জোট ৩০০ সিটের মধ্যে পেয়েছিল ২৯টা, বাকি সিটগুলো কিন্তু আমরা পেলাম। সেটা থেকেই তো জনগণের কাছে বিএনপির অবস্থানটা স্পষ্ট হয়ে যায়।
যার ফলে তারা ২০১৪ সালে আর ইলেকশন করবে না, ইলেকশন ঠেকাবে। ইলেকশন ঠেকাতে গিয়ে শুরু করল অগ্নিসন্ত্রাস। এটা মনে হয় কোনো মানুষ ভাবতে পারবে না যে- জীবন্ত মানুষগুলো বাসে করে যাচ্ছে, সেখানে তারা আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, ট্রাকে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, লঞ্চে আগুন দিয়ে মানুষ পোড়াচ্ছে, গাড়ি, সিএনজি।
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগের পরিস্থিতি বর্ণনা করতে গিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, ৩৮০০ গাড়িতে তারা আগুন দিয়েছে। ২৯টা ট্রেনে তারা আগুন দিয়েছে। সিএনজি, প্রাইভেট কার- যাকে যেখানে পেত, গায়ে পেট্রোল ঢেলে মানুষ আগুনে পুড়িয়ে মারাই নাকি তাদের আন্দোলন।
তিনি বলেন, ৫০০ স্কুল তারা জ্বালিয়ে দিয়েছিল আগুন দিয়ে এবং ৭০টা সরকারি অফিস, ৬টা ভূমি অফিস তারা আগুন দিয়ে জ্বালাল, এভাবে তারা ইলেকশন বন্ধ করার চেষ্টা করল। কিন্তু আসলে জনমতের শক্তিটাই সবচেয়ে বড়। কাজেই ইলেকশন বন্ধ করতে পারেনি, আমরা ক্ষমতায় ফিরে আসলাম।
বিএনপির সঙ্গে আলোচনার সম্ভাবনা নাকচ করে দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার ছোট ছেলে মারা গেল, যখন লাশ এসেছে মানবিক কারণে আমি প্রাইম মিনিস্টার, তারপরও সন্তানহারা মাকে সহানুভূতি জানাব বলে আমি গেলাম। আমি যখন রওনা হলাম, প্রথমে বলা হলো আমার গাড়িকে ওই বাড়ির ভেতর ঢুকতে দেবে না। মেইন গেট বন্ধ, যেখানে আমি চলে আসছি কেচি গেটে।
তারপরে খবর এলো যে ওই গেট দিয়ে ঢুকতে দেবে না। তখন আমি বললাম যে, যেহেতু এসেই গেছি, মেইন গেট না খুললেও পকেট গেট দিয়েই যাব। আমার গাড়িটা দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে আমার যে অন ডিউটি এসএসএফ ভেতরে ছিল, সে জাস্ট গেট থেকে একটু বের হয়ে এসেছে আমাকে নেওয়ার জন্য, পেছনে চট করে দরজাটা বন্ধ করে দিল। আমাকে ঢুকতে দিল না। আমি তাও গাড়ি থেকে নামলাম। নেমে দেখি, তাদের লোকজন ভেতরে। আমাকে ঢুকতে না দিয়ে অপমান করা হলো। এখন আপনারা বলেন- এরপর কার সঙ্গে ডায়লগ করব আমি?
২০১৪ সালের নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের অস্থিতিশীল পরিস্থিতির কথা উলেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার করার পর প্রত্যেকটা পরিবার যে কষ্ট পাচ্ছে, আর যারা পুড়ে একটু বেঁচে আছে, তাদের সবার চিকিৎসার ব্যবস্থা করেছিলাম। যে অবস্থায় তারা আছে সেই অবস্থা যদি কেউ চোখে দেখে, তখন আর ওদের (বিএনপি) সঙ্গে আর বসতে ইচ্ছা হয় না। মনে হয় ওদের সঙ্গে বসলে যেন ওই পোড়া মানুষগুলোর পোড়া গন্ধ পাই।
র্যাবের ওপর নিষেধাজ্ঞা জঙ্গিরা উৎসাহিত হবে: র্যাবের ওপর যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমেরিকার পরামর্শেই কিন্তু এ র্যাবের সৃষ্টি এবং তাদের ট্রেনিং, তাদের সবকিছুই কিন্তু আমেরিকার করা। তিনি বলেন, যখন আওয়ামী লীগ সরকার এলো এবং একটা গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া আমরা অব্যাহত রাখলাম, তখন হঠাৎ করে র্যাবের ওপর এই স্যাংশনটা তারা কেন যে জারি করল, সেটা ঠিক আমার কাছে বোধগম্য না।
আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর র্যাবের কোনো সদস্যের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তার তদন্ত করে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, আগে তাদের ভূমিকাগুলো খুবই প্রশ্নবিদ্ধ ছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ আসার পরে র্যাবের কোনো অফিসার যদি কোনোরকম কোনো অপরাধ করে, তাদের কিন্তু বিচার হয়- এটা কিন্তু অন্য দেশে নেই। এমনকি আমি বলব, আমেরিকায়ও নেই।
তিনি বলেন, কিন্তু আমাদের দেশে তো এই আইনের শাসনটা বলবৎ আছে এবং যারা যখনই কোনো রকম অপরাধমূলক কাজ করেছে, আমরাই কিন্তু তাদের শাস্তি দিয়েছি।
র্যাব সদস্যদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার উদাহরণ দিতে গিয়ে নারায়ণগঞ্জে সাত খুনের ঘটনায় প্রতিমন্ত্রীর জামাতার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, সঙ্গে সঙ্গে তাকে কিন্তু গ্রেফতার করা হয়েছে, জেলে দেওয়া হয়েছে, তার বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, সে শাস্তি পেয়েছে। সন্ত্রাস এবং জঙ্গি দমনে র্যাবের বিরাট ভূমিকা রয়েছে। কিন্তু দুর্ভাগ্য যে এভাবে হঠাৎ স্যাংশন দেওয়ার ফলে যেটা হলো, এতে জঙ্গিরা একটু বোধহয় উৎসাহিত হয়ে পড়ল- এটা হলো বাস্তবতা।
তিনি বলেন, আমাদের দেশে আইনের শাসন বলবৎ রয়েছে। আমরা সবকিছু আইনের দৃষ্টিতে দেখি। আবার বিনা অপরাধে কেউ যাতে শাস্তি না পায় সেটাও আমরা দেখি।
ডিজিটাল আইনের ‘অপপ্রয়োগ হয় না’: বিতর্কিত ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের প্রশ্নে প্রধানমন্ত্রী বলেন, পৃথিবীর সব দেশে এমন আইন আছে, যা বাংলাদেশেও করা হয়েছে। নাগরিকদের ডিজিটাল ক্ষেত্রে বিচরণ সুরক্ষিত করতে এই আইন করা হয়েছে।
সাংবাদিকদের হয়রানি করা এই আইনের লক্ষ্য নয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, এখানে যদি কেউ অসামাজিক কার্যক্রম, উসকানিমূলক কার্যক্রম, জঙ্গিবাদী কার্যক্রম করে, তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। শেখ হাসিনা বলেন, কেউ যদি এখন আমার একটি মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ফাইল চুরির চেষ্টা করে, তাকে কি পুরস্কৃত করতে হবে? কোনো সভ্য দেশে এটা করলে কী ব্যবস্থা হয় তার বিরুদ্ধে? দেখলাম তাকে হিরো বানানো হলো, তাকে আবার পুরস্কার দেওয়া হলো!
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের অপপ্রয়োগ করা হয় না বলে দাবি করেন প্রধানমন্ত্রী। এ আইন সংস্কারের বিষয়ে তিনি বলেন, আমাদের আইনটা কিন্তু অন্যান্য দেশের থেকে অনেক সহজ। তারপরও আমরা বলছি, অন্যান্য সভ্য দেশে আইনটা কীভাবে প্রয়োগ হচ্ছে, তা আমরা পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাচ্ছি।
শেখ হাসিনা বলেন, আমরা দেখছি, আমেরিকায় ডিজিটাল আইনে কী আছে, ইংল্যান্ডে কী আছে, ইউরোপের দেশগুলোতে কী আছে। সেখানে যদি আমরা দেখি, আমাদের আইনের চেয়ে কঠিন কোনো শাস্তির ব্যবস্থা আছে, তাহলে আমরা সংস্কার করে দেব।