বিশ্বের ‘ট্যাক্স হেভেন’ দেশগুলোতে বাংলাদেশি নাগরিকদের প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকার (৫.৯১ বিলিয়ন ডলার) অফশোর সম্পদ রয়েছে। যা দেশের মোট জিডিপির প্রায় ১ দশমিক ৩ শতাংশ। এর মধ্যে ৬০ হাজার কোটি টাকার সম্পদ রয়েছে এশিয়ার ট্যাক্স হেভেনগুলোতে, বাকিটা ইউরোপ ও আমেরিকায়। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) ট্যাক্স অবজারভেটরির সম্প্রতি প্রকাশিত ‘অ্যাটলাস অফ অফশোর ওয়ার্ল্ড’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এসব তথ্য জানা গেছে।
যেসব দেশে অন্য দেশ থেকে গোপনে অর্থ পাচার বা জমা রাখার সুযোগ রয়েছে সেই দেশগুলোকে বলা হয় ‘ট্যাক্স হেভেন’। লুক্সেমবার্গ, কেম্যান আইল্যান্ড, ব্রিটিশ ভার্জিন আইল্যান্ড কিংবা বারমুডার মতো বিভিন্ন দেশে অর্থের উৎস জানানোর ঝামেলা নেই। করের হিসাব-নিকাশও নেই। এ ধরনের ট্যাক্স হেভেন দেশে বিদেশি ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান কর ফাঁকি দিয়ে সম্পদ ক্রয় করতে পারে। এই সম্পদকে বলা হয় অফশোর সম্পদ।
এ প্রসঙ্গে অর্থনীতিবিদ ড. এমকে মুজেরি বলেন, দেশ থেকে অবৈধ উপায়ে সম্পদ ও অর্থ পাচার একটি বড় সমস্যা। বাংলাদেশে এ সমস্যা মারাত্মক আকার ধারণ করেছে। ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরি বলেছে, দেশ থেকে প্রায় ৭০ হাজার কোটি টাকা কর ফাঁকি দিয়ে বিভিন্ন দেশে চলে গেছে। এটি একটি অনুমান নির্ভর। আমার ধারণা, আরও বেশি টাকা পাচার হয়েছে। সিঙ্গাপুর, থাইল্যান্ড, কানাডাসহ বিভিন্ন দেশে অবসর অর্থ হিসাবে বিনিয়োগ করা হয়েছে। সেখানে এই বিনিয়োগের অর্থ বৈধ না অবৈধ সেটি নিয়ে প্রশ্ন করা হয় না। তিনি বলেন, এই পাচার রোধ করতে প্রয়োজনীয় আইন প্রয়োগ করা হচ্ছে না। আইন আছে কিন্তু প্রয়োগ হচ্ছে না। কারণ যারা পাচারের সঙ্গে জড়িত তারা অনেক প্রভাবশালী। দেশি কাগজে অনেক পাচারের খবর বের হয়েছে। কোনোটির বিচার না হওয়ায় এটি স্থায়ী সংস্কৃতিতে রূপ নিয়েছে। এটি দেশের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে দিচ্ছে।
অধ্যাপক মইনুল ইসলাম বলেন, টাকা পাচার আগের তুলনায় অনেক বেড়েছে সে বিষয়ে সন্দেহ নেই। পুঁজি পাচারের ব্যাপারে প্রশাসনকে আরও কঠোর হতে হবে। তা না হলে বর্তমান বৈদেশিক মুদ্রার রির্জাভের যে পতন সেটি থামানো যাবে না। পুঁজি পাচার থামাতে না পারলে অর্থনীতি বড় ধরনের ক্ষতিতে পড়বে।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নাগরিকদের অফশোর বিনিয়োগের ২০২২ সালের তথ্য দিয়ে ইইউ ট্যাক্স অবজারভেটরির প্রতিবেদনটি তৈরি করা হয়। এর আগে ২০২১ সালে ট্যাক্স হেভেনে বাংলাদেশিদের মালিকানাধীন অফশোর সম্পদের পরিমাণ ছিল ৮ দশমিক ১৪৫ বিলিয়ন ডলার, যা এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ। এরমধ্যে ৭ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করা হয়েছিল সিঙ্গাপুর, আরব আমিরাত, হংকংসহ এশিয়ার ট্যাক্স হেভেনগুলোতে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ট্যাক্স হেভেনে আবাসন খাতে বাংলাদেশিদের বিনিয়োগ করা মোট অফশোর সম্পদের পরিমাণ শূন্য দশমিক ৬৬ বিলিয়ন ডলার যা বাংলাদেশের জিডিপির শূন্য দশমিক ১৮ শতাংশ। এই বিনিয়োগের বেশিরভাগই হয়েছে সিঙ্গাপুর ও দুবাইতে। এছাড়া লন্ডন ও প্যারিসে কিছু বিনিয়োগ হয়েছে এ খাতে।
এতে আরও বলা হয়, অফশোর আবাসন শেষ পর্যন্ত বিদেশি বিনিয়োগকারীর মালিকানাধীন হয় কিংবা জটিল অফশোর কাঠামোর মাধ্যমে ভিন্ন দেশের কোনো বাসিন্দার মালিকানাধীন হয়ে থাকে যেখানে প্রকৃত মালিকের পরিচয় অস্পষ্ট থাকে।
ট্যাক্স অবজারভেটরির মতে, না জানিয়ে এই অফশোর বিনিয়োগে শূন্য দশমিক ৫ বিলিয়ন কর পাওয়া যায়নি।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০২২ সালে দুবাইয়ের শতভাগ রেডিমেট (প্রস্তুত) আবাসন সম্পদ কিনেছেন বা অপ্রস্তুত আবাসন সম্পদ কেনার জন্য প্রক্রিয়া অনুসরণ করছেন এমন কিছু ব্যক্তির তালিকা ফাঁস হয়েছে। তালিকায় ৩৯৪ জন বাংলাদেশির নাম এসেছে। ওই বছর তারা মোট ২২ কোটি ৫৩ লাখ ডলারের সম্পদ কিনেছেন। সেবার বাংলাদেশিরা মোট ৬৪১টি সম্পদ কিনেছিলেন। তবে অবজারভেটরির মতে, ওই বছর সর্বমোট ৫৩২ জন বাংলাদেশি সেখানে বাড়ি-ফ্ল্যাট কিনেছেন। কারণ ফাঁস হওয়া সম্পদ কেনার ঘটনার সঙ্গে ট্যাক্স অবজারভেটরি নিজেদের আনুমানিক হিসাবও দিয়েছে। যেখানে ফাঁস হওয়া ঘটনার সঙ্গে ফাঁস না হওয়া ঘটনাও বিবেচনায় নেওয়া হয়েছে। তবে কারা এসব সম্পদ কিনেছেন, সেই তথ্য প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়নি।
এতে আরও বলা হয়েছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশিরা দুবাই শহরে প্রস্তুত ও অপ্রস্তুত সম্পদ কিনেছেন এবং যাদের কথা ফাঁস হয়েছে, এমন বাংলাদেশির সংখ্যা ছিল ৪০৫ জন এবং তাদের কেনা সম্পদের মূল্য ছিল ২১ কোটি ১২ লাখ ডলার; সেই বছর বাংলাদেশিরা মোট ৬৫৭টি সম্পদ কিনেছিলেন।
এতে বলা হয়, ২০২২ সালে যে ৫৩২ জন বাংলাদেশি আবাসন কিনেছেন, তাদের কেনা সম্পদের অর্থের মূল্য ছিল ৩৭ কোটি ৭৪ লাখ ডলার। ২০২০ সালে সে সংখ্যাটা ছিল ৫৬২ জন; অর্থের মূল্য ছিল ৩৭ কোটি ৫৩ লাখ ডলার। অর্থাৎ দেখা যাচ্ছে, ২০২২ সালে বাংলাদেশি নাগরিকদের সম্পদ কেনার হার কমলেও তার অর্থের মূল্য বেড়েছে।