লিটনের সেঞ্চুরি আর মুশফিকুর রহিমের সঙ্গে রেকর্ড গড়া জুটি যে উচ্চতায় পৌঁছে দিল বাংলাদেশের স্কোর, আফগানিস্তান পারল না ধারেকাছে যেতেও। দ্বিতীয় ওয়ানডেতে ৮৮ রানের জয়ে তামিম ইকবালের দল নিশ্চিত করল সিরিজ জয়।
এই জয়ে ইংল্যান্ডকে টপকে বিশ্বকাপ সুপার লিগের শীর্ষে উঠে গেল বাংলাদেশ। ওয়ানডে বিশ্বকাপের বাছাইপর্ব হিসেবে চালু হওয়া এই আসরে বাংলাদেশের পয়েন্ট ১৪ ম্যাচে ১০০। বিশ্ব চ্যাম্পিয়ন ইংল্যান্ডের পয়েন্ট ১৫ ম্যাচে ৯৫।
সিরিজের প্রথম ম্যাচে বাংলাদেশের জয়ের ক্ষেত্র তৈরি করে দিয়েছিলেন বোলাররা। এবার জয়ের ভিত গড়ে দেয় দলের ব্যাটিং। চট্টগ্রামের জহুর আহমেদ চৌধুরি স্টেডিয়ামে শুক্রবার টস জিতে তামিম ইকবালের চাওয়া ছিল ২৬০ রানের মতো স্কোর। অধিনায়কের প্রত্যাশাকে ছাড়িয়ে বাংলাদেশ ৫০ ওভারে তোলে ৪ উইকেটে ৩০৬ রান।
আফগানদের বিপক্ষে ১০ ওয়ানডেতে প্রথমবার তিনশ ছুঁতে পারল বাংলাদেশ। এই চূড়ায় ওঠার মূল কাণ্ডারি লিটন। ওয়ানডে ক্যারিয়ারের পঞ্চম সেঞ্চুরিতে এই ওপেনার খেলেন ১২৬ বলে ১৩৬ রানের ইনিংস।
৪৯ ইনিংসেই ৫ সেঞ্চুরি হয়ে গেল তার, অনায়াসেই যা বাংলাদেশের দ্রুততম। এর আগে একশ ইনিংসের কম খেলে ৫ সেঞ্চুরি করতে পেরেছিলেন কেবল সাকিব আল হাসান (৯৩ ইনিংস)।
তৃতীয় উইকেটে মুশফিকের সঙ্গে লিটন গড়েন ২০২ রানের জুটি। ওয়ানডেতে তৃতীয় উইকেটে এই প্রথম দুইশ রানের জুটি পেল বাংলাদেশ।
মুশফিকের ব্যাট থেকে আসে ৯৩ বলে ৮৬ রান।
এই জুটির আগে অবশ্য ভাবা যায়নি সম্ভাব্য এই চিত্র। ব্যাটিং সহায়ক উইকেটে শুরুটা খুব দাপুটে করতে পারেনি বাংলাদেশ। ম্যাচের দ্বিতীয় ওভারে দুটি চার মারলেও তামিম আউট হয়ে যান ১২ রানেই। আগের ম্যাচের মতোই তিনি ফেরেন ফজলহক ফারুকির বলে।
লিটন শুরুতে টাইমিং করতে ভুগছিলেন কিছুটা। সাকিবের শুরুটাও খুব সাবলীল হয়নি। তবে আফগানদের অতিরিক্ত রানের প্রবণতায় বাংলাদেশের রান রেট বেশ ভালো ছিল বরাবরই।
আগের ম্যাচে ফারুকির সাফল্য দেখেই কিনা, আফগানিস্তান এই ম্যাচে আরেক বাঁহাতি পেসার ফরিদ আহমাদ মালিককে নামিয়ে দেয়। কিন্তু এলোমেলো বোলিংয়ে তিনি আলগা করে দেন চাপ।
শুরুর অস্বস্তির মধ্যেও সাকিব লড়াই চালিয়ে ২০ রান করে ফেলেন। কিন্তু রশিদ খান আক্রমণে এসে দ্বিতীয় বলেই ফেরান তাকে।
লিটন আর মুশফিকের জুটির শুরু সেখান থেকে। এক-দুই রান করে নিয়ে জুটি বড় করতে থাকেন দুজন। বাজে বল পেলে বাউন্ডারিতেও পাঠান দারুণ দক্ষতায়। লিটন পঞ্চাশে পা রাখেন ৬৫ বলে, মুশফিক ৫৬ বলে।
ফিফটির পর লিটন দারুণ সব শট খেলে বাড়ান রানের গতি। মুশফিকও আরেকপ্রান্ত থেকে সচল রাখেন রানের চাকা।
জুটি ভাঙার সুবর্ণ একটি সুযোগ পায় আফগানরা ৩৮তম ওভারে। কিন্তু মুজিব উর রহমানের বলে শর্ট কাভারে লিটনের সহজ ক্যাচ ছাড়েন অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদি। পরে মুশফিক স্টাম্পিং হওয়া থেকে রক্ষা পান ৬৯ রানে।
৮৭ রানে জীবন পেয়ে লিটন সেঞ্চুরিতে পৌঁছে যান অনায়াসেই। রশিদ খানকে বাউন্ডারি মেরে তিন অঙ্ক স্পর্শ করেন ১০৭ বলে।
সময়ের সঙ্গে বাড়ে দুজনেরই ব্যাটের ধার। জুটির প্রথম একশ আসে ১০৮ বলে, পরের একশ স্রেফ ৭৬ বলে! ফারুকির বলে লিটনের একটি ছক্কা গ্যালারির দোতলার দেয়ালে আছড়ে পড়ে।
এই জুটি শেষ পর্যন্ত থামে ৪৫ ওভার পেরিয়ে। ফরিদের পরপর দুই বলে আউট হয়ে যান দুজন। স্লোয়ার শর্ট বলে পুল করে ক্যাচ দেন লিটন। পরের বলে মুশফিক আরেকটি শর্ট বলে র্যাম্প শটে আউট হন থার্ডম্যানে। ৯ চারে তিনি করেন ৯৩ বলে ৮৬।
এই জুটির পর শেষ দিকে ঝড় তুলতে পারেননি আফিফ হোসেন ও মাহমুদউল্লাহ। ৯ বল খেলে মাহমুদউল্লাহ করতে পারেন কেবল ৬ রান, ১২ বলে ১৩ আফিফ।
দল তিনশ ছাড়ায় বটে। তবে শেষ চার ওভারে কেবল একটি বাউন্ডারিতে রান আসে মোটে ২২।
বাংলাদেশ ইনিংসের পঞ্চম ওভারে পায়ে চোট পেয়ে বাইরে চলে যান আফগানদের কিপার রহমানউল্লাহ গুরবাজ। বাকি সময়টায় উইকেটের পেছনে দাঁড়ান অতিরিক্ত কিপার ইকরাম আলিখিল। তাতে কিপিংয়ের কাজ চালানো গেলেও বড় ধাক্কা হয়ে আসে ব্যাটিংয়ে। ৩০৭ রান তাড়া করায় আগ্রাসী সূচনা গুরবাজই করতে পারতেন। কিন্তু তিনি নামতেই পারেননি ওপেনিংয়ে।
একাদশে ফেরা রিয়াজ হাসানের সঙ্গে ওপেন করেন রহমত শাহ। দ্বিতীয় ওভারেই আফিফ হোসেনের দুর্দান্ত সরাসরি থ্রো থামায় রিয়াজকে।
প্রথম ১০ ওভারের মধ্যে আফগানরা আরও হারায় অধিনায়ক হাশমতউল্লাহ শাহিদি ও বিপিএল খেলে যাওয়া তরুণ আজমতউল্লাহ ওমরজাইকে। ৩৪ রানে ৩ উইকেট হারিয়ে আফগানদের আশা তখন ম্রিয়মান।
রহমত ও নাজিবউল্লাহ জাদরানের জুটিতে আবার জেগে ওঠে আশা। শুধু জুটি গড়া নয়, বলপ্রতি রান তুলে রান তাড়ায় প্রাণ ফেরান দুজন। বিশেষ করে, মুস্তাফিজুর রহমান ও মেহেদী হাসান মিরাজকে চাপে ফেলে দেন কুশলী ব্যাটিংয়ে। দুজনই পেরিয়ে যান ফিফটি।
উত্তাপটা যখন টের পেতে শুরু করেছে বাংলাদেশ, স্বস্তির হওয়া বইয়ে দেন তখন তাসকিন আহমেদ। দ্বিতীয় স্পেলে ফিরে দুর্দান্ত এক ডেলিভারিতে তিনি বোল্ড করে দেন রহমতকে (৫২)। থেমে যায় ৯০ বলে ৮৯ রানের জুটি।
একটু পর তাসকিন ফিরিয়ে দেন টানা দ্বিতীয় ফিফটি করা নাজিবউল্লাহকেও (৫৪)। এরপর আর সেভাবে জয়ের সম্ভাবনা জাগাতে পারেনি আফগানিস্তান।
অভিজ্ঞ মোহাম্মদ নবি কিছুটা সময় লড়াই চালিয়ে মিরাজের বলে সীমানায় ধরা পড়েন ৩২ রানে। গুরবাজ সাতে নেমে করতে পারেননি তেমন কিছু। রশিদ খানের ২৬ বলে ২৯ রানের ইনিংসে ব্যবধান কিছুটা কমে। তার পরও বাংলাদেশের জয় অনেক বড় ব্যবধানেই।
প্রথম ম্যাচে দারুণ ইনিংস খেলে বাউন্ডারিতে ম্যাচ শেষ করা আফিফ এবার ম্যাচ শেষ করেন নিজের প্রথম বলেই উইকেট নিয়ে। আফগানরা গুটিয়ে যায় ২৯ বল বাকি রেখে।
লড়াকু আফগানদের বিপক্ষে সিরিজটি আশা-শঙ্কার দোলাচল নিয়েই শুরু করেছিল বাংলাদেশ। সিরিজ জয় আর দুই ম্যাচের ২০ পয়েন্ট তাই নিশ্চিতভাবেই স্বস্তির সুবাতাস বইয়ে দেবে ড্রেসিং রুমে। লক্ষ্য এবার শেষ ম্যাচ থেকে আরও ১০ পয়েন্টের।
সংক্ষিপ্ত স্কোর:
বাংলাদেশ: ৫০ ওভারে ৩০৬/৪ (তামিম ১২, লিটন ১৩৬, সাকিব ২০, মুশফিক ৮৬, মাহমুদউল্লাহ , আফিফ ফারুকি ১০-১-৫৪-৪, ফরিদ , মুজিব ১০-০-৪৯-০, ওমরজাই , রশিদ ১০-০-৫৪-১, নবি ৪-০-২৬-০, রহমত ১-০-১০-০)
আফগানিস্তান: ৪৫.১ ওভারে ২১৮ (রহমত ৫২, রিয়াজ ৫, শাহিদি ১, ওমরজাই ৯, নাজিবউল্লাহ ৫৪, নবি ৩২, গুরবাজ ৭, রশিদ ২৯, মুজিব ; মুস্তাফিজ ৮-০-৫৩-১, শরিফুল ৭-০-৪৪-১, তাসকিন ১০-২-৩১-২, সাকিব ৯-০-২৯-২, মিরাজ ১০-০-৫২-১, মাহমুদউল্লাহ ১-০-২-১, আফিফ ০.১-০-০-১)
ফল: বাংলাদেশ ৮৮ রানে জয়ী
সিরিজ: ৩ ম্যাচ সিরিজে বাংলাদেশ ২-০তে এগিয়ে
ম্যান অব দা ম্যাচ: লিটন কুমার দাস