পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদের রূপগঞ্জের আনন্দ হাউজিংয়ে থাকা ডুপ্লেক্স বাড়িটি দখলে নিল নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসন। দুদকের মামলায় হাইকোর্টের আদেশে শনিবার দুপুরে প্রায় ২৪ কাঠা জায়গার ওপর নির্মিত বাংলো বাড়িটি জব্দ করা হয়।
এ সময় উপস্থিত ছিলেন নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শফিকুল আলম, দুদকের উপপরিচালক মঈনুল হাসান রউশনী, রূপগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আহসান মাহমুদ রাসেল, সহকারী কমিশনার-ভ‚মি সিমন সরকারসহ আরও অনেকে। ‘রহস্যে ঘেরা’ বাড়িটি জব্দ করায় জবর-দখলের শিকার হওয়া স্থানীয় জমির মালিক ও বাসিন্দাদের মাঝে স্বস্তি ফিরে এসেছে। সরকারকে ধন্যবাদ জানিয়েছেন তারা।
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ দেশের নানা স্থানে অবৈধ সম্পদ গড়েছেন। বাদ যায়নি নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জের দক্ষিণবাগ চোরাবো মোড়ের বিলাসবহুল ডুপ্লেক্স বাড়িও। আনন্দ হাউজিং নামের পুলিশ কর্মকর্তাদের গড়া আবাসন প্রকল্পে ২৪ কাঠা জমিতে গড়ে তোলেন বাংলো টাইপের আলিশান এই ডুপ্লেক্স বাড়িটি। যেখানে সাধারণের প্রবেশে ছিল নিষেধাজ্ঞা। বাংলোটির মূল্য প্রায় ১০ কোটি টাকা। বেনজীর যেদিন আসতেন এ বাড়িতে আর যতক্ষণ অবস্থান করতেন বন্ধ রাখা হতো এখানকার রাস্তা। পুলিশের পাহারায় এক আতঙ্কের পরিবেশ তৈরি করতেন তিনি।
স্থানীয় বাসিন্দা আলামিন সরকার বলেন, রূপগঞ্জের মুশুরী-ইছাপুরা সড়কের পাশে গুতিয়াবো, মোগলান, দক্ষিণবাগ, জাঙ্গীর মৌজা নিয়ে আনন্দ হাউজিং সোসাইটির অবস্থান। এখানে লেকের পাশে ২৪ কাঠা জায়গাজুড়ে লাল রঙের ডুপ্লেক্স বাড়িটি নজর কাড়ে সবার। তবে ভেতরে প্রবেশ করে দেখার সুযোগ মেলেনি কারও। স্থানীয় সূত্র জানায়, আট বছর আগে এলাকার প্রয়াত প্রেমানন্দ সরকারের সন্তানদের কাছ থেকে ১ কোটি ৮৩ লাখ টাকায় ৫৫ শতাংশ জায়গা কেনেন বেনজীর। বছরচারেক আগে এই জমিতে ওই বাড়ি করেন তিনি। তার বাড়িটি ঘিরে স্থানীয় মানুষের মধ্যে তৈরি হয়েছে নানা গল্প, রহস্য। একটি জাতীয় দৈনিকে বেনজীরের আলাদিনের চেরাগ শিরোনামে সংবাদ প্রকাশের পর বাড়ির তত্ত্বাবধায়ক আবদুল্লাহ ভেতরে থাকা মালামাল সরিয়ে ফেলেছেন বলে গুঞ্জন রয়েছে।
প্রায় সময়ই পুলিশের সাইরেন বাজিয়ে গাড়ির বহর নিয়ে এ বাড়িতে আসতেন বেনজীর। পুলিশের নিরাপত্তার কড়াকড়ির কারণে তখন বাড়ির পাশের সড়ক দিয়ে লোকজনের চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হতো। বেনজীরের সঙ্গে মাঝেমধ্যে আসতেন চেনা-অচেনা সংগীতশিল্পী ও নাটক-সিনেমার অভিনেতা-অভিনেত্রীরা। তখন বাড়িতে গানের আসর বসত। গানের উচ্চশব্দে ঘুমের ব্যাঘাত ঘটত স্থানীয় মানুষদের কিন্তু কখনোই ভয়ে কিছু বলেননি কেউ।
প্রয়াত প্রেমানন্দ সরকারের ছেলে রামধন সরকার বলেন, তারা চার ভাই পৈতৃক সূত্রে ৫৫ শতাংশ জলাশয় পেয়েছিলেন। তাদের কাছ থেকে না কিনেই আনন্দ হাউজিংয়ের নামে বালু দিয়ে জলাশয়টি ভরাট করা হয়। জমি ভরাটের বছরচারেক পর লোক মারফত এক কোটি টাকা বিঘা দরে জমিটুকু বিক্রি করেন তারা। তবে টাকা পেয়েই বিক্রি করেছেন বলে জানালেন জমি বিক্রেতারা।
সাবেক আইজিপি বেনজীর আহমেদ ও তার পরিবারের সদস্যদের নামে দেশের বিভিন্ন এলাকায় থাকা বিপুল পরিমাণ ‘অবৈধ সম্পদ’ জব্দ করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। তারই ধারাবাহিকতায় এবার নারায়ণগঞ্জের রূপগঞ্জে বেনজীরের দৃষ্টিনন্দন ডুপ্লেক্স বাড়িটিও জব্দ করা হলো। দুদকের নারায়ণগঞ্জ সমন্বিত কার্যালয়ের উপপরিচালক মঈনুল হাসান রওশনী শনিবার দুপুরে আনন্দ হাউজিং সোসাইটির ওই বাড়িতে প্রশাসনের পক্ষ থেকে আদালতের নির্দেশে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেন।
মঈনুল হাসান রওশনী বলেন, বাড়িটিতে অত্যাধুনিকভাবে তালাবদ্ধ থাকায় তাৎক্ষণিক ভেতরে প্রবেশ করা যায়নি। তবে একটি কমিটি করে স্থানীয় ইউপি সদস্য মোরশেদ আলমের হেফাজতে আগামী তিন দিনের জন্য রাখা হয়েছে। পরবর্তীতে এর ভেতরে থাকা মালামালসহ সবকিছুর জব্দ তালিকা করব।
নারায়ণগঞ্জের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) শফিকুল আলম বলেন, বিজ্ঞ মহানগর সিনিয়র স্পেশাল জজ আদালত বেনজীর আহমেদের মেয়ের নামের সম্পত্তিটি নারায়ণগঞ্জ জেলা প্রশাসককে রক্ষণাবেক্ষণ করার অনুমতি দেন। এর পরিপ্রেক্ষিতে আমরা এ সম্পত্তিটি নিয়ন্ত্রণে নিলাম।
দুদকের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১২ জুন আদালত তৃতীয় দফায় বেনজীরের আরও বিপুল পরিমাণ সম্পদ জব্দ করেছেন। সে তালিকায় এ বাংলোটিও রয়েছে। এরপর বাড়িটি দেখভালের জন্য জেলা প্রশাসককে রিসিভার নিয়োগ দেন আদালত।