ব্যবসায়ী ও সরকার উভয়কে ‘জেতানোর’ বাজেট নিয়ে আসছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। তার ভাষ্যে, ব্যবসায়ীরা ‘ঠকলে’ দেশ পিছিয়ে যাবে।
অর্থমন্ত্রী মঙ্গলবার ঢাকার একটি হোটেলে জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর) ও এফবিসিসিআই আয়োজিত জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের পরামর্শক কমিটির সভায় ব্যবসায়ীদের আশ্বস্ত করেন অর্থমন্ত্রী।
রাজস্ব বাজেট প্রণয়নে ব্যবসায়ীদের বিপুল দাবির প্রেক্ষাপটে মুস্তফা কামাল বলেন, “আজকের দিনে আমি বলতে চাই, আপনারা কেউ ঠকবেন না। আপনারা আগেও ঠকেন নাই, এখনও ঠকবেন না। আপনাদেরকে ঠকতে দেওয়া যাবে না।”
ব্যবসা থেকে রাজনীতিতে আসা মুস্তফা কামাল বলেন, “আমাদের দেশ পিছিয়ে যাওয়ার জন্য আমরা এখানে আসিনি। আমরা সবাই মিলে, আমি অনুরোধ করব আপনাদেরকে, আপনারা মেহেরবানি করে বিরক্ত না হয়ে যতবার ইচ্ছা আমাদেরকে জানাবেন, অবহিত করবেন।
“এবং আমরা চেষ্টা করব, আগামী দিনের বাজেটটি আমরা প্রণয়ন করব, সেখানে এনবিআর রিলেটেড ইস্যুজ যেগুলো আছে, এগুলো বাস্তবমুখী হবে এবং সেখানে আপনাদের কষ্টের লাঘব যেন হয়, সেটি সবসময় আমাদের চিন্তায় থাকবে।”
ব্যবসায়ীদের ‘কষ্ট’ লাঘবের পাশাপাশি রাজস্ব আহরণের প্রবৃদ্ধিও সঠিক ধারায় রাখতে ২০২২-২৩ বাজেটে নির্দেশনা থাকার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
তিনি বলেন, “কষ্টের লাঘব করব এবং আমাদের কর আহরণটি কীভাবে আপনাদেরকে কষ্ট না দিয়ে সঠিক রাখা যায়, এবং আমাদের উন্নয়নের সাথে মিল রাখা যায়, সেই চেষ্টাটি আমরা অবশ্যই করব। আমি আবারও বলছি, আপনাদের দিকে তাকিয়ে আছে সারা দেশ। যারা আজকে পিছিয়ে আছে, তাদের প্রতি আপনাদের দায়িত্ব আছে।”
যেসব প্রস্তাব পরামর্শ সভায় ব্যবসায়ীরা দিয়েছেন, তার প্রতিফলন বাজেটে থাকবে বলে তাদের আশ্বস্ত করেন মুস্তফা কামাল।
তিনি বলেন, “সব প্রস্তাবনাই আমাদের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে মিল করে আগামী বাজেটটি উপস্থাপন করব। তবে, এর মূল থিম আমাদের আছে। সেটা হচ্ছে উইন-উইন সিচুয়েশন। উইন-উইন সিচুয়েশন মানে হচ্ছে আগামী বাজেটে এনবিআর রিলেটেড ইস্যুজ নিয়ে আপনারা কেউ হারবেন না, আপনারা জিতবেন।
“পাশাপাশি আপনাদের সাথে আপনাদের সরকারও জিতবে। সবাইকে আমরা জিতাব ইনশাআল্লাহ। আপনারা জিতবেন এবং সরকারও জিতবে।”
নিজের বক্তব্য আরও বিস্তৃত করে আর্থমন্ত্রী বলেন, “আমরা বেশি নিয়ে নিলাম, আপনারা কিছুই পাচ্ছেন না, এ ধরনের অভিযোগ আমরা শুনতে চাই না।”
বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্পগুলো বাস্তবায়নের জন্যই করের আওতা বাড়ানোর প্রয়োজনীয়তার কথা তুলে ধরেন তিনি।
এখানেও ব্যবসায়ীদের টেনে মুস্তফা কামাল বলেন, “জনগণের করের টাকায় নির্মিত হচ্ছে পদ্মা সেতু এবং নানাবিধ মেগা প্রকল্প। দেশের অর্থনীতির চাকা সচল রাখতে ও বিনিময় বৃদ্ধিতে ব্যবসায়ীদের সুযোগ অবারিত করতে শতভাগ বিদ্যুতায়ন সম্ভব হয়েছে।”
গত ১৩ বছরে রাজস্ব আদায়ে ব্যাপক প্রবৃদ্ধি হওয়ার কথা বলেন তিনি, সেখানেও ব্যবসায়ীদের অবদানের কথা বলেন।
“গত ১৩ বছরে ৮ গুণ বেড়ে এটা ২ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা হয়েছে। এই বৃদ্ধির পেছনে আপনাদের ভূমিকা রয়েছে এবং আমাদের এনবিআর চেয়ারম্যান ও তার টিম যথেষ্ট কষ্ট করেছে। এজন্য আপনাদেরকে ধন্যবাদ জানাই।”
করোনাভাইরাস মহামারীর কারণে অর্থনীতির যে ক্ষতি গত দুই বছরে হয়েছে, সেটার ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার পথনির্দেশও আগামী বাজেটে রাখার কথা বলেন অর্থমন্ত্রী।
মাঠ পর্যায়ে কর আদায়কারী কর্মীদের বিরুদ্ধে ঘুষ, দুর্নীতি ও হয়রানির অভিযোগ অনুষ্ঠানে করেন একাধিক ব্যবসায়ী নেতা।
এ বিষয়ে অর্থমন্ত্রী বলেন, “দুর্নীতি, স্পিডমানির কথা বলেছেন এবং না দিলে কাজ হয় না। আমার অনুরোধ থাকবে, পাশাপাশি আমি চেয়ারম্যান সাহেবের সাথে আলাপ করলাম– তার অভিমত একটাই, আপনারা দিচ্ছেন কেন? আপনারা যদি না দেন তাহলে এই বিষয়টি, যা আমাদের জন্য দুর্ভাগ্যজনক, আমাদের শুনতে হত না।”
ব্যবসায়ীদের দাবিগুলো ‘যতদূর সম্ভব’ বাজেটে সন্নিবেশিত করার আশ্বাস দেন এনবিআর আবু হেনা মো. রহমাতুল মুনিমও।
করদাতাদের কথা বিবেচনায় নিয়ে ও হয়রানি রোধের জন্য রাজস্ব আদায়ের ক্ষেত্রে বিভিন্ন অটোমেশন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করা হচ্ছে বলে উল্লেখ করেন তিনি।
ব্যবসার প্রবৃদ্ধি চলমান রাখার জন্য কর সংক্রান্ত অনেক বিরোধ আদালতের বাইরে নিষ্পত্তির চেষ্টা এনবিআর করছে জানিয়ে চেয়ারম্যান রহমাতুল মুনিম বলেন, “আদালতের দ্বারস্ত হয়ে আমার রাজস্ব পেন্ডিং রাখা বা আমার ব্যবসার উন্নয়ন বা বিস্তৃতির সক্ষমতাকে মামলার মধ্যে নিবদ্ধ রাখা, মামলার পেছনে এমনভাবে ব্যস্ত রাখা এই ফাঁকে আমার সময় ও শ্রম ক্ষয় হবে, সেটা হলে সবাই ক্ষতিগ্রস্ত হয়।”
ব্যবসায়ীদের ঘুষ-দুর্নীতির অভিযোগের বিষয়ে তিনি বলেন, “কষ্ট হয়, অল্প সংখ্যক বিপথগামী কর আহরণকারী ও অল্প সংখ্যক বিপথগামী করদাতা পরিবেশ নষ্ট করে, সেই পরিবেশের দায় সাধারণভাবে সবার উপরে এসে পড়ে।”
কমপ্লায়েন্সের জায়গা ঠিক করতে গিয়ে অনেক সময় সঠিক করদাতাদের ওপরও চাপ পড়ে বলে উল্লেখ করেন এনবিআর চেয়ারম্যান।
বাজারমূল্য যখন বেড়ে যায়, তখন কর শিথিল করে সেটা নিয়ন্ত্রণ করা দুরূহ বলেই মনে করছেন তিনি।
তিনি বলেন, “কোনো জিনিসের দাম যখন আন্তর্জাতিক বাজারে আসে (বাড়ে), তখন অনেকের কাছ থেকে এই দাবিটি আসে যে, দেশীয় বাজারে মূল্য কমিয়ে রাখার জন্য কর ছাড় দেওয়া হোক, রেভিনিউ ছাড় দেওয়া হোক।
“এটা দিয়ে কিন্তু সবসময় দেশীয় বাজার কমিয়ে রাখা যাবে না। বাজার যে রকম বাড়ে, সেই তুলনায় রেভিনিউ কিন্তু কমই থাকে। আমার মনে হয়, এটার জন্য অন্যান্য ম্যাকানিজমগুলো ব্যবহার করতে হবে। পাশাপাশি রেভিনিউজ সাপোর্ট যতটুকু দেওয়া যায় আমরা দিই, দিয়ে যাব।”
ভোক্তাদেরও মানসিক প্রস্তুতি থাকার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “ভোক্তাদের মানসিক প্রস্তুতি থাকতে হবে, মার্কেট প্রাইস বাড়ার সাথে সাথে অতিরিক্ত মূল্য দিয়ে পণ্য কিনতে হবে।”
পরামর্শসভায় ব্যবসায়ীদের বিভিন্ন দাবি তুলে ধরেন এফবিসিসিআই সভাপতি জসিম উদ্দিন। বিভিন্ন ব্যবসায়ী সংগঠনের নেতারাও নিজেদের দাবির বিষয় তুলে ধরেন।