কেন্দ্রীয় ব্যাংক প্রকাশিত আর্থিক স্থিতিশীলতা মূল্যায়ন প্রতিবেদনে ব্যাংক খাতে অস্থিরতার আশঙ্কা প্রকাশ করে তা মোকাবিলার ক্ষেত্রে পাঁচটি চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা হয়েছে। এগুলো হলো-মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি, সুদের হারে স্থিরতা, ডলার সংকট, বৈশ্বিক পরিস্থিতি এবং ঋণ আদায়ে স্থবিরতা।
ইতঃপূর্বে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংকসহ বিভিন্ন সংস্থা আগামী বছর বিশ্বব্যাপী ভয়ানক মন্দার আশঙ্কা প্রকাশ করে ব্যাংক খাতেও এর প্রভাব পড়ার ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে বলেছে, মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি রোধে সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি অনুসরণ, সুদের হার বৃদ্ধি, মুদ্রা বিনিময় হারে অস্থিরতা প্রভৃতি কারণে ব্যাংক খাতে বিপর্যয় নেমে আসতে পারে।
এটি দেশের ব্যাংক তথা আর্থিক খাতের জন্য একটি সতর্ক বার্তা। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে ব্যাংক খাতের এসব সমস্যা বা চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এখনই কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন বলে মনে করি আমরা।
বস্তুত ব্যাংক খাতে এসব সমস্যা নতুন নয়। এ প্রসঙ্গে বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহদ্দিন আহমেদের বক্তব্য প্রণিধানযোগ্য। তিনি বলেছেন, ব্যাংক খাতে সমস্যা আগে থেকেই ছিল, বৈশ্বিক মন্দায় ডলারের সংকট তা প্রকট আকারে প্রকাশ করে দিয়েছে। ঋণ আদায় কমে যাওয়াটা এখন বড় শঙ্কার। গত ৩ বছর ধরে ঋণ আদায় হচ্ছে না, বিশেষ করে বড় গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধ করছেন না। তাদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে। বাংক শুধু ঋণ দিয়েই যাচ্ছে। এটি হতে পারে না। ঋণ আদায় বাড়াতে না পারলে ভবিষ্যতে বড় ধাক্কা আসবে।
মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি জনসাধারণের মতো ব্যাংকগুলোর জন্যও বড় সমস্যা হয়ে দেখা দিয়েছে। ঋণের সুদের হারের চেয়ে মূল্যস্ফীতির হার বেশি হওয়ায় ব্যাংকের প্রকৃত আয় কমে গেছে। ফলে ব্যাংকগুলো এখন সুদবহির্ভূত আয়ের দিকে বেশি নজর দিয়েছে। এক্ষেত্রে তারা গ্রাহকদের কাছ থেকে নানা ধরনের ফি আদায়ের পরিমাণ বাড়িয়ে দিয়েছে।
এদিকে মূল্যস্ফীতির কারণে গ্রাহকদেরও আমানতের বিপরীতে প্রকৃত আয় কমে যাচ্ছে। এসব কারণে গ্রাহকরা সঞ্চয়ে নিরুৎসাহিত হচ্ছে। অন্যদিকে দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধির কারণেও গ্রাহকরা ব্যাংকে সঞ্চয় করতে পারছে না। সব মিলে আগামী দিনে ব্যাংকগুলো বড় ধরনের সংকটের সম্মুখীন হতে পারে বলে যে আশঙ্কা করা হচ্ছে, তা অমূলক নয়।
বলার অপেক্ষা রাখে না, ব্যাংক খাত বিপর্যস্ত হলে তা অর্থনীতির জন্য আরও খারাপ পরিণতি বয়ে আনবে, যার প্রভাব পড়বে মূলত দেশের শিল্প খাত ও সাধারণ মানুষের ওপর। এজন্য ব্যাংক খাতে সম্ভাব্য অস্থিরতা মোকাবিলায় সংশ্লিষ্টদের এখনই সতর্ক হওয়া প্রয়োজন। ঋণখেলাপিদের ছাড় দেওয়ার প্রবণতা পরিহার করে ব্যাকগুলোকে ঋণ আদায়ে জোর দিতে হবে। নজর দিতে হবে গ্রাহকস্বার্থের দিকে।
সরকার ব্যাংকিং কমিশন গঠনের যে উদ্যোগ নিয়েছিল, তার দ্রুত বাস্তবায়ন করতে হবে। তবে কেবল কমিশন গঠন করলেই হবে না; স্বাধীনভাবে কাজ করার ক্ষমতাও থাকতে হবে সেই কমিশনের। আসন্ন বিপর্যয় মোকাবিলায় ব্যাংক ও আর্থিক খাতে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ও আইনি সংস্কারের পাশাপাশি এ খাতে শৃঙ্খলা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন প্রতিষ্ঠাসহ আদর্শ ও নৈতিকতা প্রতিষ্ঠার ওপর সর্বোচ্চ গুরুত্ব দেওয়া হবে, এটাই কাম্য।