রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্ববাজারে জ্বালানি তেল, খাদ্য, গ্যাস ও সারের মূল্য অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। পাশাপাশি সংকট সৃষ্টি হয় মার্কিন ডলারের। যে কারণে টাকার বিপরীতে বেড়ে যায় ডলারের দাম। ডলার ও পণ্যের মূল্যবৃদ্ধি আমদানি ব্যয়কে উসকে দেয়। এতে বিদ্যুৎ উৎপাদন, সার ও খাদ্য আমদানির ক্ষেত্রে খরচ বেড়ে যায়। অপরদিকে সাশ্রয়ী মূল্যে এসব পণ্য বিক্রি করতে গিয়ে ভর্তুকিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয়। অর্থ বিভাগের হিসাবে চলতি (২০২২-২৩) অর্থবছরে শুধু কৃষি, বিদ্যুৎ ও খাদ্যে অতিরিক্ত ভর্তুকি গুনতে হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। পাশাপাশি ডলার মূল্যবৃদ্ধিসহ অতিরিক্ত অভ্যন্তীরণ ঋণের সুদ পরিশোধে বাড়তি ব্যয় হবে ৯ হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা।
সম্প্রতি অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে ‘আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল’ এবং ‘বাজেট মনিটরিং ও সম্পদ কমিটির’ বৈঠকে এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এ তথ্য। এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা যুগান্তরকে বলেন, চলতি ও আগামী উভয় বাজেটে বড় চ্যালেঞ্জ হচ্ছে ভর্তুকি ও সুদ পরিশোধের ব্যয় মোকাবিলা করা। চলমান যুদ্ধের কারণে আমদানি ব্যয় বৃদ্ধিতে বড় ধরনের চাপ সৃষ্টি হয় ভর্তুকিতে। যদিও এখন পণ্যের দাম নিম্নমুখী। কিন্তু ২০২২ সালের জুনের পর সব ধরনের পণ্যের মূল্য অস্বাভাবিক হারে বাড়ে। ফলে সরকারকে একদিকে বেশি মূল্যে আমদানি করে সাশ্রয় মূল্যে বিক্রি করতে হচ্ছে। যে কারণে লক্ষ্যমাত্রার চেয়েও বেশি ভর্তুকি ব্যয় গুনতে হচ্ছে। এছাড়া অভ্যন্তরীণ ঋণ সুদ ব্যয় বেশি হওয়ায় এ খাতেও খরচ বেড়েছে।
জানতে চাইলে সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এবিএম মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম যুগান্তরকে বলেন, বাজেটে ভর্তুকি খাতে ব্যয় অনেক বেশি যাচ্ছে। এটি ধীরে ধীরে কমাতে হবে। এতে কিছুটা মূল্যস্ফীতি বাড়তে পারে। আর মূল্যস্ফীতি হলে নিম্ন ও নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারগুলো কিছুটা সমস্যায় পড়তে পারে। অবশ্য তাদের সুরক্ষার জন্য সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতা বাড়াতে হবে। তিনি সুদ ব্যয় প্রসঙ্গে বলেন, সার্বিকভাবে চলতি বাজেটে সুদ খাতে ব্যয় বাড়ছে। আর এ ব্যয়ের বড় অংশ যাচ্ছে অভ্যন্তরীণ ঋণের সুদ পরিশোধে। বিশেষ করে বেশি সুদ পরিশোধ করতে হচ্ছে সঞ্চয়পত্রে। যদিও এ বছর সঞ্চয়পত্র থেকে ঋণ নেওয়া কমানো হচ্ছে। এতে আগামীতে এ খাতে সুদ কিছুটা কমবে। এই অতিরিক্ত সুদ ব্যয় থেকে বেরিয়ে আসার জন্য অভ্যন্তরীণ খাত থেকে কম ঋণ গ্রহণ এবং বৈদেশিক খাত থেকে বেশি ঋণ নেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন। তার মতে, বৈদেশিক ঋণ রির্জাভের জন্য ভালো। বৈদেশিক ঋণের প্রয়োজন আছে। বর্তমান জিডিপির তুলনায় বৈদেশিক ঋণের অনুপাত অন্যান্য দেশের তুলনায় ভালো অবস্থানে আছে। এটি নিয়ে চিন্তার কারণ নেই।
জানা গেছে, চলতি অর্থবছরে খাদ্য, কৃষি ও বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি বরাদ্দ দেওয়া হয় ৩৯ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা। এরমধ্যে খাদ্যে ছয় হাজার ৭৪৫ কোটি, বিদ্যুতে ১৮ হাজার কোটি এবং কৃষিতে ১৫ হাজার কোটি টাকা। কিন্তু শেষ পর্যন্ত এই তিন খাতের ভর্তুকিতে আরও ব্যয় হবে ২১ হাজার কোটি টাকা। তাহলে এসব খাতে মোট ভর্তুকি দাঁড়াবে ৬০ হাজার ৭৪৫ কোটি টাকা।
আর্থিক, মুদ্রা ও মুদ্রা বিনিময় হারসংক্রান্ত কো-অর্ডিনেশন কাউন্সিল বৈঠকে বলা হয়, বিশ্ববাজারে সারের মূল্য প্রতি কেজিতে ৮১ টাকা পর্যন্ত উঠে। সেই দামে আমদানি করে কৃষককে দেওয়া হচ্ছে কেজি ২০ টাকা দরে। ১ আগস্টের আগে প্রতি কেজি ইউরিয়া সার কৃষককে দেওয়া হয় ১৬ টাকা দরে। বেশি মূল্যে কিনে কম মূল্যে কৃষককে সার দেওয়ায় এ খাতে অস্বাভাবিক ভর্তুকি ব্যয় বেড়েছে।
এদিকে ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের মূল্য সমন্বয়ের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ ফেব্রুয়ারিতে সব ধরনের গ্রাহকের বিদ্যুতের দাম বাড়ানো হয়। এর আগে জানুয়ারিতে খুচরা ও পাইকারি পর্যায়ে দাম ৫ শতাংশ বাড়ানো হয়। নতুন ঘোষণায় ফেব্রুয়ারিতে আবাসিক এবং শিল্প-কলকারখানায় বিদ্যুতের দাম বাড়ছে অন্তত ৫ শতাংশ। আর পাইকারিতে বিতরণ কোম্পানিগুলোর জন্য দাম বাড়ছে অন্তত আট শতাংশ। সরকারের আগেই আভাস দিয়েছিল যে, এখন থেকে প্রতিমাসেই বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য সমন্বয় হতে পারে। এই সমন্বয়ের পরও কেন এ খাতে ভর্তুকি বাড়ছে সে প্রশ্নের জবাবে অর্থ বিভাগের এক কর্মকর্তা জানান, শেষ সময় এসে সমন্বয় করা হচ্ছে। কিন্তু অর্থবছরের শুরুতে সমন্বয় না হওয়ায় ভর্তুকি বেড়েছে অস্বাভাবিক ভাবে। এদিকে বিশ্ববাজারের সঙ্গে মিল রেখে জ্বালানি তেলের দামও সমন্বয়ের একটি প্রক্রিয়া চলছে।
এদিকে নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রায় ১১ লাখ ৮০ হাজার টন খাদ্য আমদানির চুক্তি করা হয়। যদিও বাজেটে আমদানির লক্ষ্য ছিল ৭ লাখ টন। এজন্য খাদ্য খাতে ভর্তুকি বাড়ছে।
এদিকে চলতি অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধে বরাদ্দ রাখা হয়েছে ৮০ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা। এ বছরই আরও নয় হাজার ৬৩৮ কোটি টাকা বেশি গুনতে হবে সুদ ব্যয়ে। সংশ্লিষ্টদের মতে, এই ব্যয়ের বড় অংশ যাবে অভ্যন্তরীণ সুদ ব্যয়ে। বিশেষ করে সঞ্চয়পত্র খাতে। বর্তমান ব্যাংকের আমানতের সুদ হার চার থেকে সাড়ে চার শতাংশ। কিন্তু সঞ্চয়পত্রে সর্বোচ্চ সুদ হার সাড়ে ১১ শতাংশ পর্যন্ত বহাল আছে। ফলে ব্যাংকের আমানতকারীরা এখন সঞ্চয়পত্র খাতে বিনিয়োগ বেশি করছেন। যে কারণে এখনে সুদ ব্যয় অনেক বেড়েছে। অর্থ বিভাগের মতে, সঞ্চয়পত্রকে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি টুলস হিসাবে দেখা হচ্ছে। যে কারণে এখানের সুদ হার অনেক বেশি রাখা হয়েছে। তবে আগামী অর্থবছরে সে সুযোগ বন্ধ করা হচ্ছে। এখাত থেকে মোট ঋণের মাত্র ২০ শতাংশ নেওয়া হবে। ফলে সুদ ব্যয়ও কমবে।