অর্থনীতি

মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণসহ একগুচ্ছ প্রস্তাব

বৈশ্বিক অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলায় আগামী বাজেটে মূল্যস্ফীতি ও মুদ্রা বিনিময় হার স্থিতিশীলতায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিতে বলেছে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ।

এছাড়া ভর্তুকিতে মাত্রারিক্ত ব্যয়ের ব্যাপারেও সতর্ক করা হয়েছে। পাশাপাশি জোর দিতে বলা হয় কর্মসংস্থান সৃষ্টি ও বিনিয়োগ বাড়াতে।

সম্প্রতি অর্থ মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে প্রাক-বাজেট বৈঠকে এসব বিষয়সহ একগুচ্ছ প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। এগুলো নিয়ে এরই মধ্যে কাজ শুরু করেছে অর্থ বিভাগ। সংশ্লিষ্ট সূত্রে পাওয়া গেছে এসব তথ্য।

সূত্রমতে, চলতি অর্থবছরের মূল বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি টাকা। ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেটের আকার বেড়ে দাঁড়াতে পারে প্রায় ৭ লাখ ৬৯ হাজার কোটি টাকা। অর্থাৎ চলতি বাজেটের তুলনায় এর আকার প্রায় ৯০ হাজার কোটি টাকা বাড়তে পারে। এর মধ্যে ভর্তুকির আকার এক লাখ কোটি টাকার বেশি।

আগামী অর্থবছরের বাজেট নিয়ে অর্থ বিভাগের এই প্রাক্কলন আজ বাজেট প্রাক্কলন পরীক্ষাসংক্রান্ত কারিগরি কমিটির সভায় উপস্থাপন করা হবে।

এ সভায় অনুমোদনের পর আগামী ৫ এপ্রিল অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় বাজেট ব্যবস্থাপনা ও সম্পদ কমিটির বৈঠকে উপস্থাপন করা হবে। ৯ মে প্রধানমন্ত্রীর সভাপতিত্বে অনুষ্ঠেয় এক সভায় তা চূড়ান্ত হবে। আর পহেলা জুন জাতীয় সংসদে ২০২৩-২৪ অর্থবছরের বাজেট ঘোষণা করা হবে।

জানতে চাইলে অর্থনীতিবিদ আহসান এইচ মনসুর যুগান্তরকে বলেন, ব্যাংক ঋণের সুদ ও মুদ্রা বিনিময় হার বাড়ানো এবং টাকা ছাপানো বন্ধ না হলে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না। বর্তমান সরকার টাকা ছাপিয়ে বাজেটের ভর্তুকি দিচ্ছে। সেখান থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। তিনি আরও বলেন, পুরো সামষ্টিক অর্থনীতি ঝুঁকির মধ্যে আছে, যা আমাদের প্রবৃদ্ধি ও বিনিয়োগকে বাধাগ্রস্ত করছে। সরকার একদিকে মূল্যস্ফীতি কমাতে পারছে না, কারণ টাকা ছাপাতে হচ্ছে।

অন্যদিকে ঋণের সুদের হারে ক্যাপ দিয়ে রেখেছে এবং ডলারের সংকট থেকে বের হয়ে আসতে পারছে না। আর ডলার সংকট যতদিন থাকবে, পণ্যের সরবরাহ পর্যাপ্ত হবে না। বিনিয়োগ ও প্রবৃদ্ধি এবং মূল্যস্ফীতি-কোনোটাই নিয়ন্ত্রণ করতে পারবে না।

প্রতিবছরই বাজেট প্রণয়নের আগে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগের সঙ্গে পৃথকভাবে ধারাবাহিক বৈঠক করে অর্থ বিভাগ। এটিকে প্রাক-বাজেট বৈঠক বলা হয়। ওই বৈঠকে মূলত মন্ত্রণালয়গুলোর সম্ভাব্য ব্যয়ের আকার চূড়ান্ত করা হয়। পাশাপাশি কোন খাতে বেশি গুরুত্ব দেওয়া দরকার, কী ধরনের পদক্ষেপ নিতে হবে-এসব বিষয়ে সুপারিশ নেওয়া হয়।

সম্প্রতি শেষ হওয়া ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রাক-বাজেট বৈঠকে উঠে আসা প্রস্তাবগুলো নিয়ে একটি প্রতিবেদন তৈরি করেছে অর্থ বিভাগ। এর মধ্যে ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের প্রভাব মোকাবিলা, অর্থনৈতিক সংকট, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধি, মূল্যস্ফীতি ও ডলার সংকট নিয়ে অনেক প্রস্তাব আসছে।

সেখানে মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণে আগামী বাজেটে আরও দিকনির্দেশনা রাখতে বলা হয়। এছাড়া অভ্যন্তরীণ খাদ্যশস্য উৎপাদন বাড়াতে বলা হয়েছে। নির্দিষ্ট সময়ে কৃষকের কাছ থেকে ধানচাল সংগ্রহ ও ক্রয় আরও জোরদার এবং কৃষিতে ভর্তুকি বাড়িয়ে ৩০ হাজার কোটি টাকা করার সুপারিশ করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলো। যদিও চলতি অর্থবছরে কৃষিতে ১৬ হাজার কোটি টাকার ভর্তুকি রয়েছে।

এছাড়া আগামী অর্থবছরে ভর্তুকি ও কর প্রণোদনার মাধ্যমে মূল্যস্ফীতি সহনীয় পর্যায়ে রাখার উদ্যোগ নিতে বলা হয়েছে। প্রস্তাবে আরও বলা হয়, মূল্যস্ফীতির কারণে প্রবৃদ্ধিতে বাধা সৃষ্টি হচ্ছে। আগামী বাজেটে গুরুত্ব কোনটি পাবে-মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণ না প্রবৃদ্ধির ধারা বজায় রাখা, উভয়ের মধ্যে যে কোনো একটি অগ্রাধিকার দিতে হবে।

এছাড়া ব্যাংক খাত নিয়েও সেখানে প্রস্তাব দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে বর্তমান ব্যাংক সুদহারের ওপর সরকার ক্যাপ বসিয়ে রাখার কারণে এটি বাড়ছে না। সেখানে বলা হয়, ব্যাংকের সুদহার মূল্যস্ফীতি থেকে কম হলে সঞ্চয় হবে না। বর্তমান মূল্যস্ফীতির চেয়ে ব্যাংক সুদহার কম। এজন্য ব্যাংকের সুদহার পুনর্গঠন করতে হবে।

মন্ত্রণালয় ও বিভাগের দেওয়া প্রস্তাবের মধ্যে আরও আছে-বিদ্যুৎ খাতে ভর্তুকি সহনীয় পর্যায়ে রাখা, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানো, কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা, সামাজিক সুরক্ষা খাতে বরাদ্দ বৃদ্ধি ও ব্যক্তি আয়করমুক্তসীমা ৪ লাখ টাকা নির্ধারণ। এছাড়া জাতীয় বাজেটে দরিদ্র জনগণকে গুরুত্ব দিয়ে মহামারি-পরবর্তী দারিদ্র ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দেওয়া এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এসএমই খাতে জোর দিতে বলা হয়েছে।

সংশ্লিষ্টদের মতে, নানা কারণে আগামী বাজেট সরকারের কাছে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছে। কারণ, বর্তমান সরকারের তৃতীয় মেয়াদে এটি হবে শেষ বাজেটে। পাশাপাশি এই বাজেটে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল আইএমএফ-এর ঋণ প্রভাব থাকবে। সংস্থার শর্তমতে, কর জিডিপির অনুপাত দশমিক ৫ শতাংশ বাড়ানোর এই উদ্যোগ নতুন বাজেটে থাকতে হবে। ফলে অর্থনৈতিক সংকটের মধ্যে আইএমএফ-এর শর্ত পালন করাও কঠিন হবে। এরই মধ্য দিয়ে সরকারকে রাজস্ব আয়ের লক্ষ্য ঠিক করতে হবে।

সংশ্লিষ্টদের আরও অভিমত, চলতি বাজেটে ২০ থেকে ২৪ হাজার কোটি টাকার ঘাটতি হবে। এ প্রেক্ষাপটে আসন্ন বাজেটে ব্যয়ের পরিমাণ বড় ধরনের বাড়ানো উচিত হবে না। এ বছর যে রাজস্ব আহরণের হার, সেটি খুব বেশি বাড়ানো যাবে না।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *