রাশিয়ার বাধানো যুদ্ধ পরিস্থিতিতে চেরনিহিভ শহরের বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে গিয়েছিলেন ইউক্রেইনের সেরা টেকনো ডিজেদের একজন ওলগা কোরোলোভা। একা নন অবশ্য; সঙ্গে ছিল কন্যা, তার কুকুরটি আর দুটো ব্যাগে চটজলদি যা যা ভরে নেওয়া যায়।
”আমি পাগলের মতো গাড়ি চালাচ্ছিলাম। একটা বোমার বিস্ফোরণ হতে দেখলাম। তারপর থেকে মাথায় শুধু একটা চিন্তাই ঘুরপাক করছিল। দূরে কোথাও চলে যেতে হবে, বাচ্চাটার জন্য।”
টানা কয়েক ঘণ্টা গাড়ি চালিয়ে পোল্যান্ড সীমান্তে ঢুকে পড়েন কোনোলোভা। ঘটনাক্রমে ওই রাতেই তার একটি ডিজে শো করার কথা।তাতে যেসব গান বাজাবেন বলে তালিকা করে রেখেছিলেন, সেসব রেখে দেশি শিল্পীদের গান লাগাতার চালাতে শুরু করেন তিনি।
যুদ্ধে দেশের মানুষের মনোবল চাঙ্গা রাখতে আর বিশ্বজুড়ে জনমত গড়ে তুলতে ইউক্রেইনের সংগীত শিল্পীদের এমন অনেক চেষ্টার কথা তুলে ধরেছে বিবিসি।
ডিজে কোরোলোভা বিবিসিকে বলেন, “আমি স্টেজে কাঁদছিলাম। আমি একের পর এক গান বাজিয়ে চলেছি আর কেঁদেই চলেছি।আমার জন্য সেটা কঠিন ছিল, কিন্তু আমি জানতাম আমার কিছু একটা করতেই হবে।”
ডিজে পরিবেশনা থেকে যে আয় করেছিলেন, তার পুরোটাই তিনি দিয়ে দেন ইউক্রেইন সেনাবাহিনী এবং জনসেবার কাজে।
পরের রাতে কোরোলোভা তহবিল সংগ্রহে নিজের ইউটিউব চ্যানেলেও একটি পরিবেশনা করেন।
তার ইনস্টাগ্রাম প্রোফাইলে এক সময় থাকত ভ্রমণ, নাইটক্লাবে ডিজে পরিবেশনার আবেদনময়ী ছবি। এখন তাতে নিয়মিত রাশিয়ার আগ্রাসী হামলার ছবি থাকে, আরও থাকে ইউক্রেইনের পরিস্থিতি নিয়ে হালনাগাদ তথ্য।
ডিজে কোরোলোভা তার রুশ ভক্তদের কাছে এই ধ্বংসযজ্ঞের কথা পৌঁছতে চান।
”রাশিয়ার মানুষ সত্য জানতে পারছে না, আর তা আমাকে পীড়া দিয়ে চলেছিল। মনে হচ্ছিল তারা যেন সবরকম তথ্য বিচ্ছিন্ন হয়ে উত্তর কোরিয়াতে রয়েছে। রাশিয়া থেকে আমার ভক্তরা বার্তা পাঠাচ্ছিল। ওরা বলছিল, এসব সত্য নয়; সবকিছু মিথ্যা। আপনার সব পোস্ট মিথ্যা। তারা এসব কিছুই দেখতে চাইছিল না।”
কোরোলোভা একা নন; মূল ধারার সংবাদমাধ্যমে যে খবর মিলছিল না, যুদ্ধের মুখোমুখি হয়ে ইউক্রেইনের অনেক সাড়া জাগানো ও উদীয়মান সংগীতশিল্পীরাও অনানুষ্ঠানিকভাবে সেসব খবর প্রচারের কেন্দ্র হয়ে উঠেছিলেন।
“সবাই এখন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিজ নিজ অনুসারীদের দৃষ্টি আকর্ষণ করছে”, বললেন লোকশিল্পী ক্রিস্টিনা সোলোভি।
“আমাদের শহরের ভেতরে যা ঘটছিল তা ছড়িয়ে দিচ্ছি। আমরা রাশিয়ার মানুষদের কাছে পৌঁছতে চাই, যেন তারা সমাবেশে যোগ দেয়; তাদেরকে বলতে চাই, এ ইউক্রেইনের বিরুদ্ধে রাশিয়ার আগ্রাসন।”
ইউটিউব ভিডিওর থাম্বনেইল ছবিতে শত শত ইউক্রেইনীয় শিল্পী দেশের পতাকা লাগিয়েছিলেন; তার সঙ্গে বড় বড় করে লেখা ছিল কিছু কথা – ‘আপনি যখন এই ভিডিওটি দেখছেন, তখন রাশিয়ার আক্রমণে ইউক্রেইনে মানুষ মরছে; এসব বন্ধ করুন’।
মার্চে যুক্তরাষ্ট্র যাওয়ার কথা ছিল রক ব্যান্ড জিনজিরের; আকস্মিক যুদ্ধে থেমে গেছে তাদের গান
ওকিয়ান এলজি একটি ইউক্রেনীয় রক ব্যান্ড। এর সদস্য এসভিয়াটোস্ল্যাভ ভাকারচুক প্রতি ঘণ্টায় যুদ্ধের সর্বশেষ পরিস্থিতির তুলে ধরছেন।
একটি ভিডিও পোস্টে তাকে দেখা যায় হাসপাতালে আহত সৈন্যদের পাশে। আরেকটি ভিডিওতে তিনি বুলেট প্রতিরোধী পোশাক পরে খারকিভের সড়কে বক্তৃতা দিচ্ছেন। গাড়ি নিয়ে খাবার ও তেল পৌঁছে দিতেও দেখা গেল তাকে একটি ভিডিওতে।
তিনি বলেন, “বিশ্বের এই অংশে আমার একটি পরিচিতি আছে।আর আমি এটাকে কাজে লাগিয়ে যা যা করা সম্ভব তা করতে চাইছি।”
এক সময়ের রাজনীতিবিদ স্লাভার কোমল কথা ইউক্রেইনের মানুষের মনে ছাপ ফেলছিল। দুর্নীতি প্রতিবাদে ২০০৮ সালে তিনি নিজের আসন ছেড়ে দিয়েছিলেন। ভিক্টর ইয়ানুকোভিচের ক্ষমতাচ্যুতি ত্বরান্বিত করা ২০১৪ সালের রেভুল্যুশন অব ডিগনিটি বা ময়দান বিপ্লবেও তার জোরালো ভূমিকা ছিল।
ওকিয়ান এলজিকে সঙ্গে করে শ্রোতাদের কাছেও তিনি বেশ জনপ্রিয়তা পেয়েছেন। একে বিবিসি তুলনা করছে পশ্চিমের ব্রুস স্প্রিংস্টিন অথবা পল ম্যাককার্টনের সঙ্গে। ২০১৪ সালে ইউক্রেইনের সবচেয়ে বড় কনসার্ট করেছিলেন এই শিল্পী। রাশিয়াতেও যথেষ্ট জনপ্রিয়তা রয়েছে তার।
রাশিয়া-ইউক্রেইন যুদ্ধ নিয়ে মানুষের মনে পরিবর্তন আনতে নিজের সবরকম সাংস্কৃতিক সম্পদকে ব্যবহার করতে চান এই শিল্পী।