জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে বিশ্বনেতাদের উদ্দেশে তিনি বলেছেন, “আসুন, সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।“
বিশ্ব যখন সঙ্কটে, পারস্পরিক সংহতি যখন সবচেয়ে বেশি জরুরি, তখন যুদ্ধ আর ক্ষমতাধরদের পাল্টাপাল্টি নিষেধাজ্ঞার চক্করে পুরো বিশ্বের মানুষের জীবন-জীবিকা যে মহাসঙ্কটে পড়ছে, জাতিসংঘে দাঁড়িয়ে সেই বাস্তবতা বিশ্ব মোড়লদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিলেন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী।
বাংলাদেশের সাড়ে ১৬ কোটি মানুষের নেতা হিসেবে শুক্রবার নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ৭৭তম অধিবেশনে দাঁড়িয়ে শেখ হাসিনা বললেন, যুদ্ধ বা অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মত বৈরীপন্থা কখনও কোনো জাতির মঙ্গল বয়ে আনতে পারে না। আলাপ-আলোচনাই সঙ্কট ও বিরোধ নিষ্পত্তির সর্বোত্তম উপায়।
“আমরা ইউক্রেন ও রাশিয়ার সংঘাতের অবসান চাই। নিষেধাজ্ঞা, পাল্টা-নিষেধাজ্ঞার মাধ্যমে একটি দেশকে শাস্তি দিতে গিয়ে নারী, শিশুসহ ও গোটা মানবজাতিকেই শাস্তি দেওয়া হয়। এর প্রভাব কেবল একটি দেশেই সীমাবদ্ধ থাকে না বরং সকল মানুষের জীবন-জীবিকা মহাসঙ্কটে পতিত হয়। মানবাধিকার লঙ্ঘিত হয়।
“খাদ্য, বাসস্থান, চিকিৎসা শিক্ষা থেকে বঞ্চিত হয়। বিশেষ করে, শিশুরাই বেশি কষ্ট ভোগ করে। তাদের ভবিষ্যৎ অন্ধকারে হারিয়ে যায়।”
বিশ্বের মানুষ ২০২০ সাল শুরু করেছিল ভয়াল এক মহামারীর দুঃস্বপ্ন নিয়ে। এরপর আড়াই বছরে চোখে না দেখা এক ভাইরাস কেড়ে নিয়েছে সাড়ে ৬৫ লাখ মানুষের প্রাণ, যারা বেঁচে গেছে, তাদের জীবন-জীবিকাকে করেছে বিপর্যস্ত, অর্থনীতিকে করেছে স্থবির।
টিকা উদ্ভাবনের কল্যাণে সেই বিপদ কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন যখন মানুষ দেখতে শুরু করল, তখনই ইউক্রেইনে যুদ্ধ বাধিয়ে বসল জাতিসংঘের ভিটো ক্ষমতাধারী দেশ রাশিয়া।
অন্য পরাশক্তিরাও বসে থাকল না, যুক্তরাষ্ট্র আর ইউরোপের তরফ থেকে একের পর এক অবরোধ আর নিষেধাজ্ঞার ঘোষণা এল, রাশিয়াও দিল পাল্টা নিষেধাজ্ঞা। তার ফল হল ভয়ঙ্কর।
গত ফেব্রুয়ারিতে ওই যুদ্ধ শুরুর পর থেকে জ্বালানি তেলের দাম আর খাদ্যের দাম বেড়ে গিয়ে বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তে মানুষের জীবনযাত্রা কঠিন করে তুলেছে। বিশ্বকে ফেলে দিয়েছে নতুন এক অর্থনৈতিক মন্দার শঙ্কায়।
সেই বিপদের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করে শেখ হাসিনা জাতিসংঘে তার ভাষণে বলেন, “বিশ্ব বিবেকের কাছে আমার আবেদন, অস্ত্র প্রতিযোগিতা, যুদ্ধ, স্যাংশন বন্ধ করুন। শিশুকে খাদ্য, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও নিরাপত্তা দিন। শান্তি প্রতিষ্ঠা করুন।”
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, মহামারীর প্রভাব সামলে ওঠার আগেই রাশিয়া-উইক্রেইন সংঘাত বিশ্বকে নতুন করে খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা, জ্বালানি ও অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তার দিকে ঠেলে দিয়েছে। টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে সহায়তা-প্রার্থী ঝঁকিপূর্ণ দেশগুলো এখন আরও প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে।
“বর্তমানে আমরা এমন একটি সঙ্কটময় সময় অতিক্রম করছি, যখন অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে অধিক পারস্পরিক সংহতি প্রদর্শন করা আবশ্যক।”
আর সেজন্য জাতিসংঘের দায়িত্ব আর সদস্য দেশগুলোর ভূমিকার কথাও সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে মনে করিয়ে দিয়েছেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, “আমাদের প্রমাণ করতে হবে যে, সঙ্কটের মুহূর্তে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার মূল ভিত্তি হল জাতিসংঘ। তাই সর্বস্তরের জনগণের বিশ্বাস ও আস্থা অর্জনের জন্য জাতিসংঘকে সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়ে সকলের প্রত্যাশা পূরণে কাজ করতে হবে।”
প্রধানমন্ত্রী স্মরণ করেন বাংলাদেশের জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রণীত পররাষ্ট্রনীতির মূল প্রতিপাদ্য– সকলের সাথে বন্ধুত্ব, কারও সাথে বৈরীতা নয়।
১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে বঙ্গবন্ধুর দেওয়া প্রথম ভাষণ থেকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন “শান্তির প্রতি যে আমাদের পূর্ণ আনুগত্য তা এই উপলব্ধি থেকে জন্মেছে যে, একমাত্র শান্তিপূর্ণ পরিবেশেই আমরা আমাদের কষ্টার্জিত জাতীয় স্বাধীনতার ফল আস্বাদন করতে পারব এবং ক্ষুধা, দারিদ্র্য, রোগ-শোক, অশিক্ষা ও বেকারত্বের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করার জন্য আমাদের সকল সম্পদ ও শক্তি নিয়োগ করতে সক্ষম হব।
“সুতরাং আমরা স্বাগত জানাই সেই সকল প্রচেষ্টাকে, যার লক্ষ্য বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাস করা, অস্ত্র প্রতিযোগিতা সীমিত করা, এশিয়া, আফ্রিকা ও লাতিন আমেরিকাসহ পৃথিবীর প্রত্যেকটি স্থানে শান্তিপূর্ণ সহ-অবস্থান নীতি জোরদার করা।”
রোহিঙ্গা সঙ্কট
২০১৭ সালে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর দমন-পীড়নের মুখে বাংলাদেশ সীমান্তে রোহিঙ্গাদের ঢল নামার পর থেকে জাতিসংঘের প্রতিটি সাধারণ অধিবেশনে দেওয়া ভাষণে সেই প্রসঙ্গ তুলে ধরে বিশ্ব নেতাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, এবারও তার ব্যতিক্রম নয়।
তিনি বলেন, গত মাসে রোহিঙ্গাদের গণহারে বাংলাদেশে প্রবেশের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়েছে। তাদের মিয়ানমারে নিরাপদে ও মর্যাদার সঙ্গে প্রত্যাবাসনের জন্য প্রয়োজনীয় পরিবেশ তৈরিতে দ্বিপক্ষীয়, ত্রিপক্ষীয় এবং জাতিসংঘসহ অন্যান্য অংশীজনদের নিয়ে আলোচনার পরও একজন রোহিঙ্গাকেও তাদের মাতৃভূমিতে ফেরত পাঠানো যায়নি।
“মিয়ানমারে চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতা ও সশস্ত্র সংঘাত বাস্তচ্যূত রোহিঙ্গাদের প্রত্যাবাসনকে আরও দুরূহ করে তুলেছে। আশা করি, এ বিষয়ে জাতিসংঘ কার্যকর ভূমিকা রাখবে।”
বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের দীর্ঘায়িত উপস্থিতি বাংলাদেশের অর্থনীতি, পরিবেশ, নিরাপত্তা এবং সামাজিক ও রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার ওপর যে মারাত্মক প্রভাব ফেলেছে, সে কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, “তাদের প্রত্যাবাসনের অনিশ্চয়তা সর্বস্তরে ব্যাপক হতাশার সৃষ্টি করেছে। মানবপাচার ও মাদক চোরাচালানসহ আন্তঃসীমান্ত অপরাধ বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমনকি এ পরিস্থিতি উগ্রবাদকেও ইন্ধন দিতে পারে।”
এ সঙ্কট প্রলম্বিত হতে থাকলে তা পুরো উপমহাদেশসহ বৈশ্বিক নিরাপত্তা ও স্থিতিশীলতার ওপর মারাত্মক হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে বলে আবারও সতর্ক করেন তিনি।
জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি
জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবকে মানবজাতির জন্য ‘সবচেয়ে বড় হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে শেখ হাসিনা বলেন, “জলবায়ু নিয়ে প্রতিশ্রুতি দেওয়া আর ভাঙার একটি দুষ্টচক্র আমরা অতীতে দেখেছি। আমাদের এখনই এই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসতে হবে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবিলায় প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নের সঙ্গে এবং টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ঠ অর্জনের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ অসংখ্য পদক্ষেপ নিয়েছে।
ক্লাইমেট ভালনারেবল ফোরামের সভাপতি থাকাকালে বাংলাদেশকে ‘ঝুঁকির পথ থেকে জলবায়ু সহনশীলতা ও জলবায়ু সমৃদ্ধির টেকসই পথে’ নিয়ে যাওয়ার লক্ষ্যে ‘মুজিব ক্লাইমেট প্রসপারিটি প্লান’ গ্রহণ করার কথাও তিনি বলেন।
শেখ হাসিনা বলেন, “ঝুঁকিতে থাকা অন্যান্য দেশগুলোকে তাদের নিজস্ব জলবায়ু সমৃদ্ধি পরিকল্পনা প্রণয়ণে সহায়তা করতে আমরা প্রস্তুত আছি। অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু কার্যক্রমের প্রসারের জন্য আমি বিশ্ব নেতৃবৃন্দকে আহ্বান জানাই।”
সঙ্কট মোকাবেলা
প্রধানমন্ত্রী বলেন, “কোভিড-১৯ মহামারী হতে আমাদের জন্য সবচেয়ে বড় শিক্ষণীয় বিষয় হল– ‘যতক্ষণ পর্যন্ত সবাই নিরাপদ নয়, ততক্ষণ পর্যন্ত কেউই নিরাপদ নয়’।”
এই অভিজ্ঞতার ওপর ভিত্তি করে জাতিসংঘসহ অন্যান্য প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর বাস্তবিক ও অত্যাবশ্যক সংস্কার করার তাগিদ দেন তিনি, যাতে ভবিষ্যতে এ ধরনের বিপর্যয় মোকাবিলার জন্য আরও কার্যকর প্রস্তুতি নেওয়া সম্ভব হয়।
মহামারীর শুরু থেকে এ সঙ্কট মোকাবেলায় বাংলাদেশ সরকার তিনটি বিষয়ের দিকে লক্ষ্য রেখে কৌশল নির্ধারণ করেছে জানিয়ে তিনি বলেন, সংক্রমণের বিস্তার রোধে জাতীয় স্বাস্থ্যসেবার আওতা প্রসারিত করা হয়েছে, প্রণোদনা দিয়ে অর্থনীতি ও জনগণের জীবিকার সুরক্ষা দেওয়া হয়েছে, আর টিকা পাওয়ার যোগ্য শতভাগ মানুষকে টিকা দেওয়া হয়েছে।
একটি টেকসই অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি,সবার জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি এবং অন্তর্ভুক্তিমূলক শান্তিপূর্ণ সমাজ এবং সামাজিক সম্প্রীতি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে বাংলাদেশ সরকার কাজ করে যাচ্ছে বলে বিশ্বসভায় জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ এখন বিশ্বের দ্রুত বর্ধনশীল পাঁচটি অর্থনীতির মধ্যে অন্যতম। জিডিপির হিসাবে ৪১তম। বিগত এক দশকে দারিদ্র্যের হার ৪১ শতাংশ থেকে ২০.৫ শতাংশে নামিয়ে আনা গেছে। মাথাপিছু আয় এক দশকে তিনগুণ বৃদ্ধি পেয়ে ২ হাজার ৮২৪ ডলারে উন্নীত হয়েছে। মহামারীর মধ্যেও জিডিপি প্রবৃদ্ধির গতি ফিরিয়ে আনতে পেরেছে।
“ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধ এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা ও পাল্টা নিষেধাজ্ঞার ফলে সরবরাহ ব্যবস্থায় ব্যাঘাত এবং জ্বালানি, খাদ্যসহ নানা ভোগ্যপণ্যের অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধি পেয়েছে। এ কারণে আমাদের মত অর্থনীতি মারাত্মক চাপের মুখে পড়েছে। মূল্যস্ফীতি বৃদ্ধি পেয়েছে। এ অবস্থা কাটিয়ে ওঠার জন্য আমরা বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করছি।”
সন্ত্রাস ও সহিংস উগ্রপন্থার বিষয়ে বাংলাদেশের ‘শূন্য সহনশীলতা’ নীতির কথা জাতিসংঘে আবারও তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী।
সাইবার-অপরাধ এবং সাইবার সহিংসতা মোকাবিলা করার লক্ষ্যে একটি আন্তর্জাতিক বাধ্যতামূলক চুক্তি প্রণয়নে একসঙ্গে কাজ করার জন্য সদস্য দেশগুলোকে আহ্বান জানান।
অভিবাসীরা যে এখনও তাদের অভিবাসন যাত্রায় অনিশ্চিত পরিস্থিতির মুখোমুখি হচ্ছে, সে কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, “তারা তাদের অধিকার থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন। এ পরিস্থিতি থেকে উত্তরণ ঘটাতে আমাদের অবশ্যই বিশ্বব্যাপী অংশীদারিত্ব এবং সংহতি বাড়াতে হবে।”
আর স্বল্পোন্নত দেশের তালিকা থেকে উন্নীত হওয়ার পথে থাকা বাংলাদেশসহ ১৬টি দেশ যে ক্রমবর্ধমান বৈশ্বিক সঙ্কটে প্রতিকূলতার মুখে পড়েছে, সেজন্য উন্নয়ন অংশীদারদের কাছে ‘বর্ধিত এবং কার্যকর’ সহযোগিতার আহ্বান রাখেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, বাংলাদেশ দারিদ্র্য বিমোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রশমন, সংঘাত প্রতিরোধ এবং আর্থিক, বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সঙ্কটের মত বৈশ্বিক প্রতিকূলতাগুলোর রূপান্তরমূলক সমাধান খুঁজতে আগ্রহী।
“তবে আমাদের উপলব্ধি করতে হবে যে, শান্তি ও স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করা ব্যতিত আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন সম্ভব নয়।”
একটি নিদারুণ ট্রাজেডি
জাতিসংঘে দেওয়া ভাষণে নিজের জীবনের এক নিদারুণ অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা শান্তিপূর্ণ একটি বিশ্ব দেখতে চাওয়ার প্রত্যাশার কথা বিশ্বনেতাদের বলেন।
তিনি বলেন, “১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট আমার পিতা, জাতির পিতা, বাংলাদেশের তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। একইসঙ্গে আমার মা ফজিলাতুন নেছা মুজিব, আমার ছোট তিন ভাই – মুক্তিযোদ্ধা ক্যাপ্টেন শেখ কামাল ও তার নবপরিণীতা স্ত্রী সুলতানা কামাল, মুক্তিযোদ্ধা লেফটেন্যান্ট শেখ জামাল, তার নবপরিণীতা স্ত্রী পারভিন রোজী, আমার দশ বছরের ছোট ভাই শেখ রাসেলকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়।
“আমার চাচা মুক্তিযোদ্ধা শেখ আবু নাসের, ফুফা আবদুর রব সেরনিয়াবাত, তাঁর কন্যা ১৩ বছরের বেবী সেরনিয়াবাত, ১০ বছরের আরিফ সেরনিয়াবাত এবং ৪ বছরের সুকান্ত, আমার ফুফাত ভাই মুক্তিযোদ্ধা শেখ ফজলুল হক মনি ও তার অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজু মনি, ব্রিগেডিয়ার জামিল, পুলিশ অফিসার সিদ্দিকুর রহমানসহ ঘাতকেরা ১৮ জন মানুষকে হত্যা করে। আমি তাদের আত্মার মাগফিরাত কামনা করি।”
ধানমণ্ডির বাড়ির এই সিঁড়িতেই গুলি করে হত্যা করা হয় জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে।
শেখ হাসিনা বলেন, সেদিন জার্মানিতে ছিলেন বলে তিনি এবং তার ছোটবোন শেখ রেহানা প্রাণে বেঁচে যান। তারপর ছয়টি বছর তাদের বিদেশে কেটেছে নির্বাসনে।
১৯৭১ সালে হানাদার পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ৩০ লাখ মানুষকে হত্যা করে। দুই লাখ মা-বোনের ওপর পাশবিক অত্যাচার চালায়। ২৫ মার্চ রাতে বঙ্গবন্ধুকে গ্রেপ্তার করে নিয়ে যায় পাকিস্তানের অজ্ঞাত স্থানে। তার স্ত্রী সন্তানদের গ্রেপ্তার করে একটি একতলা স্যাঁতস্যাঁতে বাড়িতে রাখে।
সেসব দিনের কথা স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, “আমার প্রথম সন্তান সজীব ওয়াজেদ জয় ওই বন্দিখানায় জন্মগ্রহণ করে। আমাদের ঘরে কোনো ফার্নিচার দেওয়া হয়নি। সুচিকিৎসার কোনো ব্যবস্থা ছিল না। দৈনন্দিন খাবার পাওয়াও ছিল অনিশ্চিত।
“কাজেই যুদ্ধের ভয়াবহতা, হত্যা-ক্যু-সংঘাতে মানুষের যে কষ্ট-দুঃখ-দুর্দশা হয়, ভুক্তভোগী হিসেবে আমি তা উপলদ্ধি করতে পারি। তাই যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই; মানবকল্যাণ চাই। মানুষের অর্থনৈতিক উন্নতি চাই। আগামী প্রজন্মের জন্য শান্তিময় বিশ্ব, উন্নত-সমৃদ্ধ জীবন নিশ্চিত করতে চাই।”
বিশ্ব নেতাদের সামনে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, “আমার আকুল আবেদন, যুদ্ধ, অস্ত্র প্রতিযোগিতা বন্ধ করুন। সমুন্নত হোক মানবিক মূল্যবোধ। আসুন, সবাইকে এক সঙ্গে নিয়ে হাতে হাত মিলিয়ে আমরা একটি উত্তম ভবিষ্যৎ তৈরির পথে এগিয়ে যাই।“
বিশ্বসভায় সকল দেশের প্রতিনিধিকে তিনি মনে করিয়ে দেন, “আমরা দেখতে চাই, একটি শান্তিপূর্ণ বিশ্ব– যেখানে থাকবে বর্ধিত সহযোগিতা, সংহতি, পারস্পরিক সমৃদ্ধি এবং ঐকবদ্ধ প্রচেষ্টা। আমাদের একটি মাত্র পৃথিবী এবং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে এই গ্রহকে আরও সুন্দর করে রেখে যাওয়া আমাদের দায়িত্ব।”