পহেলা বৈশাখে রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলা ২১ বছর ধরে নিষ্পত্তির অপেক্ষায়। হত্যা মামলার রায় হলেও উচ্চ আদালতে তা প্রায় ৮ বছর ধরে বিচারাধীন। আর বিস্ফোরক আইনে দায়ের হওয়া মামলাটি বিচারিক আদালতে সাক্ষ্যগ্রহণ পর্যায়ে রয়েছে।
বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ ও বিচারপতি এএসএম আব্দুল মোবিনের হাইকোর্ট বেঞ্চে ১৯ জানুয়ারি ডেথ রেফারেন্সটি শুনানির জন্য কার্যতালিকায় ছিল। ১৪ মার্চ মামলাটির শুনানির কথা ছিল, কিন্তু বিচারপতি কৃষ্ণা দেবনাথ আপিল বিভাগে নিয়োগ পেলে ওই বেঞ্চটি ভেঙে যায়। মামলার নথি চলে যায় প্রধান বিচারপতির কাছে। এখন প্রধান বিচারপতি অন্য একটি বেঞ্চে পাঠালে সেখানে মামলাটির শুনানি হতে পারে।
ওই বেঞ্চে রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল শাহিন আহমেদ খান। তিনি বুধবার যুগান্তরকে বলেন, ডেথ রেফারেন্সটি এর আগেও কয়েকটি বেঞ্চের তালিকায় শুনানির জন্য ছিল। আদালত রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে সময় দিয়েছিলেন। সর্বশেষ আমরা শুনানির জন্য প্রস্তুতি নিলেও বেঞ্চটি ভেঙে যায়।
আইনজীবীরা বলছেন, বিচারিক আদালতে কোনো আসামির মৃত্যুদণ্ড হলে তা কার্যকরে হাইকোর্টের অনুমোদন লাগে, যা ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) মামলা হিসাবে পরিচিত। নিয়ম অনুসারে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের ডেথ রেফারেন্স অনুমোদনের জন্য বিচারিক আদালতের রায় ও নথিপত্র হাইকোর্টে পাঠানো হয়। আর সাজার রায়ের বিরুদ্ধে দণ্ডিত ব্যক্তিরা কারাগারে থেকে জেল আপিল করতে পারেন। এ ছাড়া দণ্ডাদেশের বিরুদ্ধে নিয়মিত আপিল ও বিবিধ আবেদনও করতে পারেন। ডেথ রেফারেন্স শুনানির পূর্বপ্রস্তুতি হিসাবে পেপারবুক (মামলার বৃত্তান্ত) তৈরি করতে হয়। প্রক্রিয়া শেষে ডেথ রেফারেন্স, আসামিদের আপিল, জেল আপিল ও আবেদনের ওপর একসঙ্গে শুনানি হয়ে থাকে।
জানা গেছে, এই মামলাটিতে ২০১৬ সালে বিচারপতি এম. ইনায়েতুর রহিমের নেতৃত্বাধীন হাইকোর্ট বেঞ্চে ডেথ রেফারেন্স শুনানির জন্য ছিল। ওই বেঞ্চে শুনানি শুরু হলেও পরবর্তীতে এই আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন হওয়ায় মামলাটির শুনানি বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে মামলাটি হাইকোর্টের আরও কয়েকটি বেঞ্চের কার্যতালিকায় এলেও আদালতের এখতিয়ার পরিবর্তন ও বেঞ্চের বিচারকের পরিবর্তন এবং করোনাভাইরাসের সংক্রমণের প্রেক্ষাপটে শুনানি বন্ধ হয়ে যায়। তবে দীর্ঘদিন পর মামলাটি শুনানির জন্য আবারও হাইকোর্টের কার্যতালিকায় আসে।
বাঙালির ঐতিহ্যের অন্যতম একটি উৎসব পহেলা বৈশাখ। সেই অনুষ্ঠানে ২০০১ সালে চালানো হয় নারকীয় বোমা হামলা। ছায়ানটের অনুষ্ঠানে সেই হামলায় নিহত হন ১০ জন, আহত হন শতাধিক। ঘটনার পরপরই হত্যা ও বিস্ফোরক আইনে মামলা করা হয়। ঘটনার প্রায় ১৩ বছর পর হত্যা মামলার রায় দেন বিচারিক আদালত। ২০১৪ সালের ওই রায়ে মুফতি হান্নানসহ ৮ জনের মৃত্যুদণ্ড ও ৬ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়। একই বছরের ২৬ জুন ফাঁসির রায় অনুমোদনের জন্য ঢাকার আদালত থেকে হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। কারাবন্দি আসামিরাও আপিল করে। এরপর প্রধান বিচারপতির নির্দেশে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়।
জানতে চাইলে ডেথ রেফারেন্স শাখার ডেপুটি রেজিস্ট্রার আব্বাস আলী যুগান্তরকে বলেন, রমনা বটমূলে বোমা হামলা মামলার রায়ের নথি হাইকোর্টে আসার পর যথারীতি পেপারবুক প্রস্তুত করা হয়। মামলাটির ডেথ রেফারেন্স এখনো শুনানি হয়নি। এটা সম্পূর্ণ প্রধান বিচারপতির এখতিয়ার।
মামলার প্রধান আসামি মুফতি হান্নানের ফাঁসি সিলেটের একটি মামলায় (ব্রিটিশ হাইকমিশনার আনোয়ার চৌধুরীর ওপর গ্রেনেড হামলা মামলা) কার্যকর হওয়ায় এই মামলায় তার আর বিচার হচ্ছে না। ফলে এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন-মাওলানা আকবর হোসেন, আরিফ হাসান সুমন, সাবেক উপমন্ত্রী আব্দুস সালাম পিন্টুর ভাই মো. তাজউদ্দিন, হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবু বকর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার, আবদুল হাই ও শফিকুর রহমান।
এদের মধ্যে তাজউদ্দিন, জাহাঙ্গীর আলম বদর, আবু বকর, শফিকুর রহমান ও আবদুল হাই পলাতক। যাবজ্জীবন কারাদণ্ডপ্রাপ্ত আসামিরা হলেন-শাহাদাত উল্লাহ জুয়েল, সাব্বির, শেখ ফরিদ, আব্দুর রউফ, ইয়াহিয়া ও আবু তাহের। এরা সবাই নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতাকর্মী।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ঢাকা মহানগর পাবলিক প্রসিকিউটর আব্দুল্লাহ আবু জানান, বিস্ফোরক মামলাটি সাক্ষ্য গ্রহণের প্রায় শেষ পর্যায়ে। দুই বছর করোনার কারণে বিচার বিলম্বিত হয়েছে।
দীর্ঘদিনেও শুনানি না হওয়ায় সাবেক আইনমন্ত্রী ব্যারিস্টার শফিক আহমেদ যুগান্তরকে বলেন, আলোচিত এই মামলাটির ডেথ রেফারেন্স ৮ বছর ধরে হাইকোর্টে পড়ে থাকা দুঃখজনক। দ্রুত মামলাটির শুনানি হওয়া দরকার। জাতি এটা প্রত্যাশা করে।