বছরের পর বছর ক্রিকেট মাঠের বাইশ গজ কাঁপিয়ে দেশের ৩ লাখ ৫০ হাজার ৩৭৪ বর্গমাইলে এসে খেই হারিয়ে ফেললেন ইমরান খান (৭০)।
পাকিস্তানের সর্বকালের অন্যতম সেরা ক্রিকেটার। পাকিস্তানকে প্রথম বিশ্বমঞ্চে ওঠানোর কারিগর। পাকিস্তানের লাখো ভক্তের ‘মহানায়ক’। পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী। রমণীমোহন খ্যাত সুদর্শন ইমরান খানকে একনজর দেখতে একসময় জনস্রোতে ভাসত বিশ্বের তাবড় তাবড় সব স্টেডিয়াম।
খেলার মাঠের রঙিন দিনগুলোয় হাজার হাজার নারীর মনোনায়ক, ছিমছিমে গড়নের সেই চৌকশ খেলোয়াড় আজ মুখ থুবড়ে পড়ে আছেন বাউন্ডারির বাইরে। অ্যাটক জেলের অন্ধকার কুঠরিতে। জীবনভর চার-ছক্কা হাঁকানো ব্যক্তিটি অবসর নিয়েই পা রাখেন নিজের সীমানার বাইরে। রাজনীতির মাঠে। হলেন প্রধানমন্ত্রী।
জনপ্রিয়তা লাভ করেন এখানেও। কিন্তু রাজনীতির গোলকধাঁধায় হারিয়ে ফেলেন মসনদ। অনাস্থায় ক্ষমতা হারান। আর এখন অ্যাটক জেলের কয়েদি। ক্রিকেটের মাঠে মহানায়ক খ্যাতি অর্জন করলেও রাজনীতিতে হয়ে গেলেন বোল্ড আউট। বিবিসি।
দুর্নীতির বিরুদ্ধে লড়াই এবং দেশের অর্থনীতির সঠিক দিশা দেখানোর প্রতিশ্র“তি দিয়ে ২০১৮ সালে নির্বাচিত হন। কিন্তু সেই প্রতিশ্রুতি রক্ষা করতে ব্যর্থ হন। ফলে বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম মুসলিম দেশটি আর্থিক সংকটে পড়ে যায়। মুদ্রাস্ফীতি বেড়ে যায়, কমে যায় রুপির মূল্য। ঋণ সংকটে পঙ্গু হতে থাকে দেশ। অনেকের মাঝে ক্ষোভ ও সমালোচনার জন্ম হয়।
২০২২ সালের মার্চের শেষদিকে বিরোধীরা অনাস্থা প্রস্তাব উত্থাপন করেন। ১০ এপ্রিল অনাস্থা ভোট হয়। হেরে যান খান। ৩৪২ সদস্যের হাউজে তার বিরোধীরা ১৭৪ ভোট পান। ৫ আগস্ট তোশাখানার দুর্নীতির মামলায় অভিযুক্ত হলে তাকে অ্যাটক জেলে বন্দি করে রাখা হয়।
খানের জন্ম ১৯৫২ সালে। বাবা ছিলেন সিভিল ইঞ্জিনিয়ার। স্কুলজীবন কাটে লাহোরে। পরে অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যায়ন করেন। এরপর যোগ দেন ক্রিকেটে। দুই দশকব্যাপী ক্রিকেটে সুনাম অর্জন করেন। ১৯৯২ সালে তার অধিনায়কত্বে প্রথমবার বিশ্বকাপ জয় করে পাকিস্তান। যৌবনকালে তিনি প্লেবয় হিসাবেও বেশ সুখ্যাতি অর্জন করেন।
খেলা থেকে অবসর নেওয়ার পর তার মায়ের স্মৃতিতে একটি ক্যান্সার হাসপাতালে মিলিয়ন ডলার তহবিল দান করেন। পরোপকারের এ অভিযান তকে ধীরে ধীরে রাজনীতির দিকে ঠেলে দেয়। ১৯৯৫ সালে খান ২১ বছর বয়সী ব্রিটিশ উত্তরাধিকরী জেমিনা গোল্ডস্মিথকে বিয়ে করেন। তখন খানের বয়স ছিলো ৪৩ বছর। তাদের দুটি ছেলে সন্তান হয়।
২০০৪ সালে বেজে ওঠে বিচ্ছেদের সুর, ভেঙ্গে যায় সংসার। ২০১৫ সালে দ্বিতীয় বিয়েতে আবদ্ধ হন খান। সাংবাদিক রেহাম খানকে বিয়ে করেন। কিন্তু বিয়ের এক বছরেরও কম সময়ে ভেঙ্গে যায় এ বিয়েও। খান ২০১৮ সালে একটি লো-প্রোফাইল আবারও বিয়ে করেন। তৃতীয় স্ত্রীর নাম বুশরা ওয়াট্টো। পাঁচ সন্তানের জননী ছিলেন।
রাজনীতিবিদ হিসেবে ইমরান খান উদারতার পরিচয়ের সাথে ইসলামিক মূল্যবোধেরও পরিচয় দেন। তবে তিনি সমালোচিত হয়েছেন বহুবার। পাকিস্তানে যখন ইসলামী জঙ্গীবাদের উল্লেখযোগ্যহারে বৃদ্ধি পেয়েছিলো তখন তালেবানের প্রতি সহানুভূতিশীল হিসেবে সমালোচিত হন খান।
সেই সময় বিরোধীরা তাকে তালেবান খান বলে অভিহিত করেন। আবার ২০২০ সালে ওসামা বিন লাদেনকে শহীদ বলেও তোপের মুখে পড়েন তিনি।
ভয়ে চুপ থাকলেও সমর্থনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ
সম্প্রতি পাকিস্তানের সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানকে দুর্নীতির মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। গ্রেপ্তারের পরও নিশ্চুপ আছেন তার প্রতিনিধিরা। অথচ ৯ মে যখন তাকে গ্রেপ্তার করা হয় তখন সারা দেশে বিক্ষোভের সৃষ্টি হয়। সহিংসতা সংঘর্ষে রুপ নেয়। কিছু বিক্ষোভকারী সামরিক ভবনে হামলা চালায়।
এমনকি লাহোরের সবচেয়ে সিনিয়র সামরিক কমান্ডারের বাড়িতেও লুটপাট চালানো হয়। কিন্তু এবারের পনিস্থিতি পুরোটাই ভিন্ন। হচ্ছে না কোনো বিক্ষোভ। হচ্ছে না লুটপাট। নিশ্চুপেই খানকে সমর্থন করছেন তার সমর্থকরা।
নিরব সমর্থনের শক্তিতে দৃঢ়প্রতিঙ্গ হয়ে আছেন। পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) দল ও সমর্থকরা বলছেন দ্রুত ক্র্যাকডাউনের মাধ্যমে তারা নিরব হতে বাধ্য হয়েছেন।
খানকে অ্যাটক জেলে বন্দীর পর পুলিশ ও সামরিক বাহিনী সমস্ত বড় শহর জুড়ে উচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করেন। এমনকি কয়েক ডজন লোককে আগে থেকেই হেফাজতে নেওয়া হয়। মে মাস থেকে খানের হাজার হাজার সমর্থকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। বেশ কিছু পিটিআই রাজনীতি ছেড়ে দিয়েছেন। আবার অনেকেই নিশ্চুপ থেকেই খানকে সমর্থন করে যাচ্ছেন।
অনেকেই জানান, তারা জনাব খান ও পিটিআইকে সমর্থন করেন। নিরাপত্তার খাতিরে নাম পরিবর্তন করা ফাতেমাসহ অনেক পিটিআই সমর্থক প্রতিজ্ঞা করেছেন, তারা জনাব খান ও তার দলকে পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনে ভোট দিবেন। তারা বলেন, ‘জনাব খান ও তার দলের প্রতি আমাদের ভালোবাসা আরও শক্তিশালী হচ্ছে। আমরা তাদের সমর্থন অব্যাহত রাখবো।’