জাতীয় পার্টির সংসদ-সদস্য অ্যাডভোকেট কাজী ফিরোজ রশীদ বলেছেন, এখন জীবনকে রাতারাতি বদলে দেওয়ার একমাত্র পন্থা হচ্ছে রাজনীতি। এটা একটা পেশা হয়ে দাঁড়িয়েছে। আগে রাজনীতি ছিল নেশা, যারা রাজনীতি করতেন, জীবনকে বাজি রেখেই করতেন। সেই নেশা আর নেই, এখন দেশে এটাই সবচেয়ে বড় পেশা।
তিনি আরও বলেন, পাকিস্তান আমলে দেখা যেত পাত্র যদি রাজনীতি করে তাহলে বিয়ে দিত না। কারণ সে কোনো চাকরি পাবে না, তাহলে সে খাওয়াবে কী? খাওয়াতে হলে পত্রিকা অফিসে চাকরি করতে হবে, না হলে বটতলার উকিল হতে হবে, না হয় মুদি দোকানদার হতে হবে অথবা কেরানি। কিন্তু এখন যদি শোনে পাত্র সরকারি দল করে, তাহলে বলা হয় আলহামদুলিল্লাহ। এর চেয়ে ভালো পাত্র আর হয় না। কারণ সে কিছু করতে পারবে। রোববার জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর বিশেষ অধিবেশনে ধন্যবাদ প্রস্তাবের ওপর আলোচনায় অংশ নিয়ে তিনি এসব কথা বলেন। প্রধানমন্ত্রী ও সংসদ নেতা শেখ হাসিনা কার্যপ্রণালি বিধির ১৪৭ বিধির আওতায় শুক্রবার এই প্রস্তাব উত্থাপন করেন।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, জাতি এখন দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে গেছে। নিরপেক্ষ কোনো মানুষ নেই। শিক্ষক, ডাক্তার, বুদ্ধিজীবী, সাংবাদিক সবাই বিভক্ত। পুরো দেশই এখন দুই ভাগে বিভক্ত।
সংসদের অনেক অর্জনের সঙ্গে দুর্বলতাও আছে-এমন মন্তব্য করে ফিরোজ রশীদ বলেন, আজ পর্যন্ত একটা কমিশন (বঙ্গবন্ধু হত্যা) গঠন করতে পারছেন না। বঙ্গবন্ধু হত্যার নেপথ্যে কারা জড়িত ছিল এই জাতি যদি জানতে না পারে, তাহলে ইতিহাসের ভগ্নাংশ রেখে লাভ নেই। কারণ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা ছিল বিশাল ষড়যন্ত্রের কাজ। ডালিম, ফারুক, রশিদ গিয়ে হত্যা করল, বিষয়টা তা নয়। এর পেছনে গভীর ষড়যন্ত্র ছিল, তা আপনারা বের করলেন না।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু একদিনে বঙ্গবন্ধু হননি। তার জীবনের বেশি সময় কেটেছে জেলে। তিনি ঢাকায় বসে নেতৃত্ব দেননি। তিনি প্রত্যেকটি অঞ্চলে গিয়ে নেতৃত্ব দিয়েছেন। আজ কিন্তু আমরা ঘরের বাইরে যাই না। কাঁচের দেয়ালে বসে নেতৃত্ব দেই। আর যারা আসে তাদের আমাদের লোকজন কোরবানির গরুর মতো, গলায় মালা দিয়ে রুমে নিয়ে বসান। আর টাকার বস্তা দিলে মনোনয়ন দেন। এটাই হচ্ছে আওয়ামী লীগের আরেকটি দুর্বল দিক।
তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পর বঙ্গবন্ধু হত্যার প্রতিবাদ করতে কাউকে দেখিনি। এ কথা আমার নয়। আওয়ামী লীগের নেতাদেরই কথা। আর আমি তখন তরুণ। আমরা ঢাকায় ছিলাম, আমরা প্রস্তুত ছিলাম। নেতৃত্বের অভাবে আমরা সামনে এগোতে পারিনি। আমাদের কেউ ডাক দেয়নি, এটি ইতিহাস।
জাতীয় পার্টির এই সংসদ-সদস্য বলেন, আমরা আইন প্রণয়ন করি। সংসদে আইন প্রণয়নের সময় আমরা কতজন উপস্থিত থাকি? আইন পাশ করার সময় সবাইতো সংসদে থাকে না। আমলারা আইন ড্রাফট করে দেন, আমরা হ্যাঁ, না বলে পাশ করে দেই। এজন্য রাষ্ট্রপতি তার ভাষণে বলেছেন, একসময় বাইরে থেকে আইন প্রণয়ন করতে কনসালটেন্ট আনতে হবে। কারণ আমাদের মধ্যে আইন প্রণয়ন করার মতো কেউ থাকবে না।
কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্রে কোনো কাজ হয় না। যদি পেটে ভাত, শিক্ষা-চিকিৎসা-বাসস্থানের অবস্থা না থাকে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী বিশাল ক্ষমতাধর। বিশ্বের ইতিহাসে এত ক্ষমতাবান প্রধানমন্ত্রী আছে কিনা আমার জানা নেই। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আজ এক এক করে জাতির পিতার সব স্বপ্ন বাস্তবায়ন করে যাচ্ছেন। এটা তার জীবনের বড় সাফল্য। তিনি বলেন, বলা হচ্ছে প্রত্যেকটি আসনে নৌকা প্রতীক দেওয়া হবে। জাতীয় পার্টির ২৬টি আসনেও লাঙল দেবেন না, সেখানেও নৌকা দেবেন। আমাদের ভয় পান কেন? প্রয়োজনে সব আসন আপনাদের ছেড়ে দেব। সরকারকে উদ্দেশ করে কাজী ফিরোজ রশীদ বলেন, শান্তভাবে দেশ পরিচালনা করুন। নির্বাচনের বাকি আর ৯ মাস। একটি বড় রাজনৈতিক দল বলে দিয়েছে তারা নির্বাচনে অংশ নেবে না। তাই সতর্ক হন, সামনে কিন্তু বড় বিপদ আসছে।
হাসানুল হক ইনু ও রাশেদ খান মেননের বক্তব্যের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, আমাদের পাশে কেউ বলছেন সংবিধানে সংশোধনী আনতে হবে। বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম রাখা যাবে না। রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম রাখা যাবে না। কারণ এসব সাংঘর্ষিক। এখন আপনারা এগুলো বলছেন কেন? আর মাত্র ৯ মাস বাকি নির্বাচনের।
এই মুহূর্তে আরেকটি নতুন ইস্যু সৃষ্টি করতে যাচ্ছেন কেন? এর উদ্দেশ্য কী? আপনারা তো সহি সালামতে নৌকায় উঠে বসে গেছেন। নৌকার কাণ্ডারি শেখ হাসিনা, নৌকা টানছেন শেখ হাসিনা। শেখ হাসিনাকেই নৌকা বেয়ে ওপারে যেতে হবে। আপনারা তো নিশ্চিতভাবে নৌকায় উঠে বসে আছেন।
মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে কথা বললে শাস্তির আইন চান মন্ত্রী : আলোচনায় অংশ নিয়ে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, স্বাধীনতার ইতিহাস ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিরুদ্ধে যারা কথা বলে তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেওয়া উচিত। তাই স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তির জন্য এবং দেশকে একটি ‘সেফ গার্ড’ দেওয়ার জন্য ইতিহাস বিকৃতকারীদের এবং মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিপক্ষে মিথ্যাচারকারীদের রাষ্ট্রীয়ভাবে শাস্তি দিতে সংসদে একটি আইন পাশ করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, আমি শুনেছি ল’ কমিশন নাকি এ ধরনের একটি আইনের প্রস্তাবনা করেছে। এ আইনটিকে যাতে জাতিকে সেফ গার্ডে রাখার জন্য এই সংসদে পাশ করা যায় সে আহ্বান জানাব।
আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ড, চার নেতার হত্যাকাণ্ড, সংবিধানে কাটাছেঁড়া-এসব কিছুই ছিল এ দেশ থেকে মুক্তিযুদ্ধের চেতনাকে মুছে ফেলার জন্য। সে কারণে ২৩ বছরের শোষণ-বঞ্চনার পর মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ ও ধর্মনিরপেক্ষতা- এ মূল চার নীতির ওপর ভিত্তি করে দেশ পরিচালিত হচ্ছিল, তারা এ ধারণাকে মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিল। কয়েক দিন আগে বিএনপির এক নেতা বলেছেন, এর চেয়ে পাকিস্তান ভালো ছিল। তারা বলে আমাদের এই মহান মুক্তিযুদ্ধের নাকি কোনো প্রস্তুতি ছিল না। তাহলে সিক্রেট ডকুমেন্ট, প্রধানমন্ত্রী যা সংকলিত করেছেন সেসব যাবে কোথায়?
বিএনপির নাম না উল্লেখ করে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী বলেন, তারা বাংলাদেশকে একটি অকার্যকর ও ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করার চক্রান্ত করছে। শুধু তারাই চক্রান্ত করছে না, যারা এ সংসদকে বিশ্বাস করে না, দেশি-বিদেশি চক্রান্তকারীদের মুখপাত্র হিসাবে অনেকেই এ ষড়যন্ত্র করছে। প্রধানমন্ত্রী যেহেতু জেলহত্যা, বঙ্গবন্ধু হত্যার বিচার করেছেন, তিনিই দেশবিরোধী স্বাধীনতাবিরোধীদের শাস্তির জন্য এ আইনটি করতে পারেন।
জেনারেল ওসমানী যাকে ইচ্ছা তাকেই মুক্তিযুদ্ধের খেতাব দিয়েছেন : আলোচনায় অংশ নিয়ে একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের প্রধান সেনাপতি জেনারেল আতাউল গণি ওসমানীর সমালোচনা করে সরকারদলীয় প্রবীণ সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, জেনারেল ওসমানীকে বঙ্গবন্ধু ভালোবাসতেন। তার ওপর সব দায়িত্ব দিয়েছিলেন। বীর উত্তম, বীর বিক্রম সবকিছু। তিনি যাকে পেয়েছেন, তাকে খেতাব দিয়েছেন। এর কোনো হিসাব ছিল না।
তিনি বলেন, মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে কিছু কথা আছে। আজকে কিছু বললাম না। বিতর্কিত হয়ে যাবে। মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রীকে কিছু বলেছি। এই মুক্তিযোদ্ধা, মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত হয়েছে। বিকৃত করেছে কে? জেনারেল ওসমানী। এটা আমি বলতে চাই।
জেনারেল ওসমানী তার প্রতিষ্ঠিত জাতীয় জনতা পার্টিতে যোগ দিতে তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন দাবি করে ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন বলেন, তিনি (ওসমানী) আমাকে টেলিফোন করে বললেন, আমি জনতা লীগ (জাতীয় জনতা পার্টি হবে) করেছি, আপনি আমার দলে থাকবেন। আমি বললাম, কী বললেন? আমি তো দল করি। তখন আমাকে জিজ্ঞেস করেন কোনো দল করেন? আমি বললাম, আওয়ামী লীগ করি। তিনি আমাকে বলেন, আওয়ামী লীগ কি এখনো আছে?
ড. কামাল হোসেনকে আমন্ত্রণ জানালে সংসদ প্রাণবন্ত হতো : গত ৭ এপ্রিল জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীর অধিবেশনে অন্যতম সংবিধান প্রণেতা ড. কামাল হোসেনকে আমন্ত্রণ না জানানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন গণফোরামের সদস্য মোকাব্বির খান। তিনি বলেন, ড. কামাল ছিলেন বঙ্গবন্ধুর অত্যন্ত ঘনিষ্ঠ সহচর, গণপরিষদের সদস্য, তৎকালীন মন্ত্রী। যাকে বঙ্গবন্ধু সদ্য স্বাধীন বাংলাদেশের সংবিধান প্রণেতা কমিটির চেয়ারম্যান করেন। অতি অল্প সময়ে তিনি পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ সংবিধান বাংলাদেশকে উপহার দিয়েছিলেন। তাকে আমন্ত্রণ না জানানোটা সত্যিই দুঃখজনক।
মোকাব্বির খান বলেন, ড. কামাল হোসেন বঙ্গবন্ধু সরকারের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্বও পালন করেন। জাতীয় সংসদের সুবর্ণজয়ন্তীতে তাকে যদি আমন্ত্রণ জানানো হতো, তাহলে সুবর্ণজয়ন্তীর অনুষ্ঠানটি প্রাণবন্ত, সফল সুন্দর হতো।
বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে তিনি বলেন, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের হত্যাকাণ্ডের মতো হত্যাকাণ্ড পৃথিবীর ইতিহাসে আর একটা আছে কিনা সন্দেহ। কিন্তু দুর্নীতিবাজ, লুটেরা, অর্থ পাচারকারীদের জন্য এই সংসদে ইনডেমনিটির মতো কালো আইন পাশ হয়।