জাতীয়

রাজনীতি মানুষের কল্যাণে, ক্ষমতার জন্য নয়ঃ আবদুল হামিদ

মো. আবদুল হামিদ। সাফল্য আর সফলতার স্বর্ণশিখরে অধিষ্ঠিত হয়েও বললেন, এখনো কিছু বিষয় তাকে কষ্ট দেয়। তারও যন্ত্রণা আছে। যন্ত্রণা এই সংসদে রাজনীতিবিদদের অংশীদারত্ব নিয়ে। পোড় খাওয়া, তৃণমূল থেকে উঠে আসা রাজনীতিবিদদের সংখ্যা এখন হাতে গোনা যায়; বাকিরা হয় অবসরপ্রাপ্ত কিংবা সাবেক। এখন সেনাবাহিনী, প্রশাসনের কর্মকর্তা চাকরিজীবন শেষ করেই রাজনীতিতে চলে আসেন। ব্যবসায়ীরা আসেন, না হয় এসে ব্যবসায়ী বনে যান। টিকিট নেন, এমপি, মন্ত্রী হয়ে যান। এটা তাকে যন্ত্রণা দেয়। যখন সংসদের দিকে তাকান তখন হতাশার কালো মেঘে অহংকারের আকাশ আচ্ছন্ন হয়ে যায়। হৃদয়ে হয় রক্তক্ষরণ।

বঙ্গভবনে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে সাক্ষাৎ। সেই দিন ছিল ২১ এপ্রিল। তিন সাংবাদিকের সঙ্গে প্রায় এক ঘণ্টা সময় কাটে এই নন্দিত সর্বজনশ্রদ্ধেয় মানুষটির। তখন তিনি বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। ৪০ একর বিস্তৃত বিশাল বঙ্গভবনের বাসিন্দা। এই সাক্ষাৎকার যখন ছাপা হলো, তখন তিনি বঙ্গভবনে আর নেই। তিনি বসবাস করছেন নিকুঞ্জ-১ এ মাত্র সাড়ে তিন কাঠার প্লটে নিজ বাড়িতে। আর বঙ্গভবনে তখন মো. সাহাবুদ্দিন বাংলাদেশের ২২তম রাষ্ট্রপতি। ২১ এপ্রিল তিনি ছিলেন গুলশানে নিজস্ব ফ্ল্যাটে। এখন বঙ্গভবনের বাসিন্দা।

আবদুল হামিদ তার উত্তরসূরিকে বঙ্গভবনে অধিষ্ঠিত করে ফিরে গেলেন। একই সঙ্গে রেখে গেলেন তার মানুষের আকাক্সক্ষার অভিপ্রায়কে, যেন মানুষ বাঁচে-বাড়ে সম্প্রীতির অচ্ছেদ্য বন্ধনে, সর্বজনীন মানবিক আত্মীয়তায়।
বাঙালি জাতির অবিসংবাদী কবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর তার গানে আসা-যাওয়ার পথের ধারের পঙ্ক্তিতে ব্যক্ত করেছিলেন-
“আসা-যাওয়ার পথের ধারে গান গেয়ে মোর কেটেছে দিন।/ যাবার বেলায় দেব কারে বুকের কাছে বাজল যে বীন/ সুরগুলি তার নানাভাগে/ রেখে যাবো পুষ্পরাগে,/ মীড়গুলি তার মেঘের রেখায় স্বর্ণলেখায় করব বিলীন/… … … মনের কথার টুকরো আমার কুড়িয়ে পাবে কোন উদাসীন।”

এভাবেই প্রজন্ম পরম্পরায় আমাদের গড়তে হবে সৌহার্দের সেতু, সম্প্রীতির আলিঙ্গনে ধারণ করতে হবে ‘মত ও পথ’র পার্থক্যকে।

সোমবার রাষ্ট্রপতির বাসভবনে ‘প্রবীণের বিদায়’ এবং ‘নবীনের আগমন’র আনুষ্ঠানিকতায়, দেশের মানুষের অভিষেক মূর্ত থাক-রবি ঠাকুরের ভাষায়-‘সুরগুলি তার নানাভাগে, রেখে যাবো পুষ্পরাগে’/ মীড়গুলি তার মেঘের রেখায়…’/… …’ আমাদের উত্তর পুরুষেরা যেন সেই স্বর্ণ লেখার কথাগুলো খুঁজে পায় দেশের আপামর মানুষের প্রতি মমতায়, ভালোবাসায়।

এক বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুল হামিদ। ছাত্রজীবনে বঙ্গবন্ধুর আদর্শের রাজনীতি ছাত্রলীগে জড়িত হন। ছাত্রজীবনেই কয়েক দফা কারাবরণ করেন। ১৯৫৯ সালে সরাসরি রাজনীতিতে যুক্ত হন। আইন পেশায় নিয়োজিত হয়ে দুদফা বারের সভাপতি নির্বাচিত হন। ছয়বারের এমপি আবদুল হামিদ। জাতীয় সংসদে ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, সংসদের উপনেতা, বাংলাদেশের ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি, অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং রাষ্ট্রপতি পদে ১০ বছর ৪১ দিন সফলতা, দক্ষতা, বিশ্বাস, আস্থা ও মানুষের ভালোবাসায় সিক্ত আব্দুল হামিদ এক সফল মানুষের নাম হয়ে উঠেছে। তিনি বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি, যিনি অত্যন্ত সম্মান ও মর্যাদা নিয়ে সব আনুষ্ঠানিকতার মধ্য দিয়ে বঙ্গভবন থেকে রাষ্ট্রপতির পদ থেকে বিদায় নিয়েছেন। যে বিদায় অবিস্মরণীয় ইতিহাস হয়ে থাকবে।

১০ বছরে কি কোনো সংকট, সমস্যা মোকাবিলা করেছেন, বিব্রত করেছে কোনো ঘটনা-এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, রাষ্ট্রপতি সময়কালে কঠিন কোনো সংকট বা সমস্যা সামনে আসেনি এটা ঠিক নয়। জটিল পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হয়নি, তা-ও বলা যাবে না। দু-চারটা ঘটনা যে মনের বিরুদ্ধে হয়নি, এ কথাটা কি করে বলি। চিফ জাস্টিস সিনহার বিষয়টি যেভাবে কৌশলে সুরাহা করেছি তাতে জাস্টিস সিনহাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে।

আবদুল হামিদ সুস্থ রাজনীতির চর্চা হোক, এটা চান। তিনি মনে করেন, ক্ষমতায় যাওয়ার জন্য শুধু রাজনীতি নয়, রাজনীতি মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষকে ভালোবাসার জন্য, মানুষের ভালোবাসা পাওয়ার জন্য। মানুষই তার মূল শক্তি। মানুষ ধনী কি গরিব, শিক্ষিত কি অশিক্ষিত, সেটা বড় কথা নয়। মানুষকে ভালোবাসার ক্ষেত্রে কৃত্রিমতা, মেকি কিছু থাকবে না, এটাই সত্য-তিনি বিশ্বাস করেছেন মানুষকে সত্যিকার ভালোবাসলে ভালোবাসা পাবেনই। তিনি তা পেয়েছেন।

এক প্রশ্নের জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, ক্ষমতায় যাব, এটা বড় কথা নয়। ভালো মানুষদের নিয়ে রাজনীতি করব, এটাই বড় কথা। জনগণ ভোট দিলে ক্ষমতায় যাব, না দিলে যাব না-এই সত্য মেনে নিলেই বহু সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। তিনি বলেন, সারা জীবন বঙ্গবন্ধুর রাজনীতি করেছি, তার প্রশংসা করেছি। দল পরিবর্তন করে যদি জিয়াউর রহমান, এরশাদের প্রশংসা করি-তাদের রাজনীতি বা অন্য কোনো রাজনীতিতে যুক্ত হই, তাদের প্রশংসা করি তবে মানুষ হিসাবে জনগণ আমাকে কীভাবে মূল্যায়ন করবে। অবশ্য এখন নীতি পরিবর্তন করা মানুষের অভাব নেই।

বিদেশি কূটনীতিক আর বিদেশের কাছে ধরনা দেওয়ার রাজনীতির মূল্যায়ন করতে বললে আবদুল হামিদ বলেন, এটা রাজনীতির দেউলিয়াপনার সর্বোচ্চ প্রকাশ। ভাবতে অবাক লাগে এখন আমরা কোন স্তরে চলে যাচ্ছি। কই, তাদের (বিদেশি/কূটনীতিক) দেশের কোনো সংকট-সমস্যা নিরসনে তো তারা আমাদের ডাকে না। নাক গলানোর সুযোগ দেয় না। কাজেই তাদের এ ধরনের তৎপরতা দেশের মর্যাদা, সম্মানকে প্রশ্নের মুখোমুখি করে।

অবসর জীবনে কাজ কী হবে-এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, আমি কখনো রাষ্ট্রপতি হতে চাইনি। চেয়েছি মানুষের মধ্যে থাকতে। এমনকি জাতীয় রাজনীতিতেও যুক্ত হওয়ার ইচ্ছা ছিল না। কিশোরগঞ্জে মানুষের রাজনীতিই আমার কাছে মুখ্য ছিল। এখনো আছে। সেটাই আমার চারণভূমি। চেষ্টা করেছি কিশোরগঞ্জের হাওড়ের উন্নয়ন করতে। কিছু হয়েছে, কিছু হয়নি। কিশোরগঞ্জের উন্নয়নের জন্য, মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তনে আমার আরও অনেক চাওয়ার আছে, পাওয়ার আছে। অবসর জীবনে লেখালেখি করবেন; ঢাকা, কিশোরগঞ্জ ও হাওড়ে সময় কাটাবেন তিনি।

রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদকে আমরা দেখেছি তিনি বারবার তার হাওড়ের মানুষের কাছে ছুটে গেছেন। বিভিন্ন বক্তৃতায় বলেছেন, রাষ্ট্রীয় আনুষ্ঠানিকতার প্রটোকলে ‘বন্দিত্ব’র কথা। কথাগুলো তিনি অকপটে ব্যক্ত করেছেন-তাতে তার মানুষরা উপলব্ধি করেছেন তিনি তাদেরই সন্তান রয়ে গেছেন। যাকে তারা ‘ভাটির শার্দুল’ অভিধা দিয়েছেন, সেই শার্দুল কেমন আপাদমস্তক ভাটির সন্তান রয়ে গেছেন তার একটি ছোট্ট উদাহরণ আমি উল্লেখ করি-তিনি যখন স্পিকারের দায়িত্ব পালন করতেন তখন সংসদের সুদীর্ঘ অধিবেশন শেষে তাকে বহনকারী গাড়িতে উঠে চালককে বলতেন, ‘ভাসাও!’ যেন হাওড়ে নাও ভাসাবার আদেশ। তার এই ‘ভাসাও’ শব্দটি শুনে যে কেউ বিস্মিত হবেন কিন্তু তার চালক বুঝতেন এই শব্দের অর্থ। দেশের সবচেয়ে সুরম্য অট্টালিকা সংসদ ভবনের ইট-পাথরের রাজ্য থেকে চালক ‘ভাসিয়ে’ নিতেন তার বাহনটিকে। একই সঙ্গে এ মানুষটি নগরে-হাওড়ে একাকার ছিলেন তার অস্তিত্বে। এখানেই একজন প্রকৃত জননেতার সার্থকতা। তিনি গণমানুষের আর গণমানুষ তার বুকের গভীরে। এরকম মানুষের কথাই লিখেছিলেন কবি শামসুর রাহমান-“ধন্য সেই পুরুষ, নদীর সাঁতার পানি থেকে যে উঠে আসে/সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গে;/ ধন্য সেই পুরুষ, নীল পাহাড়ের চূড়া থেকে যে নেমে আসে/প্রজাপতিময় সবুজ গালিচার মত উপত্যকায়;/ ধন্য সেই পুরুষ, হৈমন্তিক বিল থেকে যে উঠে আসে/রঙ-বেরঙের পাখি ওড়াতে ওড়াতে।/ধন্য সেই পুরুষ কাহাতের পর মই-দেয়া খেত থেকে যে ছুটে আসে/ফসলের স্বপ্ন দেখতে দেখতে।”
[ধন্য সেই পুরুষ। শামসুর রাহমানের শ্রেষ্ঠ কবিতা, পৃ. ৩১৮]

কবি ‘উঠে আসা’ পুরুষের কথা লিখে তাকে ‘ধন্য’ বলেছিলেন। কিন্তু ‘ধন্য’ সেই পুরুষ, যখন তার মানুষের কাছে, প্রকৃতির কাছেই ফিরে যান তখন তা আরও বেশি তাৎপর্যময় হয়ে ওঠে।

সামনে নির্বাচন। রাজনীতিতে কোনো সংকট বা সমস্যা দেখেন কি-এমন প্রশ্নের জবাবে আবদুল হামিদ বলেন, জাতীয় সংসদে দেওয়া শেষ ভাষণে আমার কিছু কথা বলেছি। বলেছি, যে কোনো সমস্যার সমাধান আলোচনার মাধ্যমে হতে পারে। তবে সে আলোচনা হতে হবে আন্তরিক, খোলা মনে। আন্তরিক হলে সমস্যার সমাধান হবে না-এটা বিশ্বাস করি না। সরকার সত্যিকার অর্থে ফ্রি অ্যান্ড ফেয়ার নির্বাচন দিতে চায়, বিরোধী দলও নির্বাচনে অংশ নেবে-মূল লক্ষ্যই হবে এটা। তবেই আলোচনা সফল হবে।

আবদুল হামিদ বলেন, রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ পদে আসীন ছিলেন তিনি। অবসরে আর প্রত্যক্ষ রাজনীতিতে জড়াবেন না। মানুষ তাকে যে ভালোবাসা দিয়েছে, তাদের কোনোভাবেই অসম্মান করবেন না আর কোনো পদ বা পদবি গ্রহণ করে। দেশবাসীর প্রতি তার কৃতজ্ঞতার শেষ নেই। তিনি আমৃত্যু সে কৃতজ্ঞতার পাশে আবদ্ধ থাকতে চান।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *