রাজনীতি

শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন নয় : মির্জা ফখরুল

চট্টগ্রাম, ময়মনসিংহ, খুলনা ও রংপুরের পর দক্ষিণাঞ্চলের প্রাণকেন্দ্র বরিশালে বিএনপির বিভাগীয় গণসমাবেশেও মানুষের ঢল নামে। বাস, মিনিবাস, মাইক্রোবাস, থি হুইলার চলাচল বন্ধ, নৌ পরিবহনে ধর্মঘট ঘোষণার পরও থামেনি বিএনপির গণসমাবেশমুখী জনস্রোত। গত বৃহস্পতিবার থেকে বরিশালের বঙ্গবন্ধু উদ্যানমুখী খণ্ড খণ্ড মিছিল গতকাল সমাবেশের দিনে জনসমুদ্রে রূপ নেয়। গাড়ি-নৌযান বন্ধ, পথে পথে বাধা, হামলা, ভয়-ভীতি প্রদর্শন কোন কিছুতেই আটকানো যায়নি বিএনপি নেতাকর্মী ও সমর্থকদের। সারাদেশ থেকে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন দক্ষিণাঞ্চলের জনশ্রোতে নগরীর বেলপার্ক ছাপিয়ে জনস্রোত থামানো তো দূরের কথা, সমাবেশস্থল ছাড়িয়ে রাস্তায়, আসেপাশের বাড়ীর ছাদেও ছড়িয়ে পড়ে।

গণসমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে শেখ হাসিনার অধীনে, বর্তমান সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না বলে হুশিয়ারি দিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর। তিনি বলেন, বিএনপি’র পরিস্কার কথা, হাসিনাকে (প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা) সংসদ থেকে পদত্যাগ করতে হবে, সংসদ ভেঙে দিতে হবে, এবং নিরপেক্ষ, নির্দলীয় সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। সেই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে। সেই কমিশনের অধীনে নির্বাচন হবে। শেখ হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না।

জ্বালানি তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় দ্রব্যমূল্য বৃদ্ধি, ৫ নেতাকর্মী হত্যার প্রতিবাদে এবং দলের চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াসহ সকল রাজনৈতিক বন্দীদের মুক্তি ও মিথ্যা মামলার প্রত্যাহারের দাবিতে গতকাল শনিবার বরিশালে বিভাগীয় সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়।

সড়ক ও নৌ পরিবহন বন্ধ থাকা এবং অন্যান্য বিভাগীয় সমাবেশের অভিজ্ঞতায় দুইদিন আগে থেকেই বরিশালে আসতে শুরু করেন বিভিন্ন জেলার নেতাকর্মীরা। মাঠে অবস্থান নিয়ে, সেখানেই রাত কাটিয়েছেন তারা। আর শুক্রবার রাত থেকে আশপাশের এলাকাগুলো থেকে ট্রলারে, নৌকায়, পায়ে হেটে, খণ্ড খণ্ড মিছিল নিয়ে বরিশাল শহরে পৌঁছাতে থাকে মানুষ। ভোর থেকে দুপুর অবধি শত শত ট্রলারে মানুষ আসতে থাকে বঙ্গবন্ধু উদ্যান-বেলপার্ক। দুপুর ১টার আগে মহানগরী ও সন্নিহিত এলাকা থেকেও মিছিলের পর মিছিল ছুটতে শুরু করে বেল পার্কে। তবে পথে পথে বাঁধা বিপত্তিও অব্যাহত ছিল। গতকাল সকালে ঢাকা থেকে বরিশালের সমাবেশে যোগদানের পথে গৌরনদীর মাহিলাড়াতে ইঞ্জিনিয়ার ইসরাক হোসেনের গাড়ী বহরে হামলায় কয়েকটি গাড়ী ভাংচুর ও তার সফরসঙ্গী অন্তত ৫ জন আহত হয়েছেন। গৌরনদীতে অনুরূপ হামলার শিকার হয়েছেন আরো কয়েকজন বিএনপি নেতা।কিন্তু এতসব কিছুর পরেও যোগাযোগ শূণ্য দক্ষিণাঞ্চলের প্রতিটি জেলা ও উপজেলাসহ ইউনিয়ন পর্যায় থেকেও নেতা-কর্মীসহ সাধারণ মানুষ তিন দিন ধরেই বরিশালের গনসমাবেশে আসেন। দুপুর ১২টায় সমাবেশস্থলের মাঠ লোকে লোকারণ্য হয়ে উঠে। জনস্রোতে দক্ষিণাঞ্চলের সর্ববৃহৎ এ সমাবেস্থলে তিল ধারণের ঠাঁই ছিল না। ফলে মাঠ ছাপিয়ে চার পাশের রাস্তাগুলোতে দাঁড়িয়েও নেতৃবৃন্দের ভাষণ শুনতে দেখা গেছে হাজার হাজার মানুষকে।

বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল বলেন, আওয়ামী লীগের সময়ে চুরি আর ঘুষ ছাড়া আর কিছু নেই। ১০ টাকা কেজি চাল খাওয়াবে বলেছিল। কতো টাকায় চাল খাওচ্ছে। ঘরে ঘরে চাকরি দিবে বলেছিল। দিয়েছে? চাকরি দিয়েছে আওয়ামী লীগের ছেলেদের। প্রত্যেকের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা নিয়ে। বিনা পয়সায় সার দেবে বলেছিল। দিয়েছে? আমাদের সময়ের চেয়ে তিন গুণ দামে সার কিনতে হচ্ছে। আওয়ামী লীগ এখন বর্গীতে রূপ নিয়েছে। আওয়ামী লীগের চরিত্রে দুটি জিনিস আছে। একটি হল চুরি আর অন্যটি সন্ত্রাস। এই দুটি তারা করবেই।

তিনি বলেন, ভোট চুরি করে, নতুন নতুন বুদ্ধি করে ক্ষমতায় যাওয়ার চিন্তা করছে। আমরা পরিস্কার ভাষায় বলছি, হাসিনার অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন হবে না। সংসদ বিলুপ্ত করে নিরপেক্ষ সরকারের হাতে ক্ষমতা দিতে হবে। সেই সরকার নতুন নির্বাচন কমিশন গঠন করবে।

মির্জা ফখরুল দলের নেতাকর্মীদের ঐক্যবদ্ধ থাকার আহবান জানিয়ে বলেন, টেক ব্যাক বাংলাদেশ। রাজপথে ফায়সালা করে বাংলাদেশকে আমরা ফিরিয়ে আনব। কোনো দ্বিমত নয়, ঝগড়াঝাটি নয়, ঐক্যবদ্ধভাবে আমাদের ঝাপিয়ে পড়তে হবে। এই আন্দোলন সমগ্র জাতিকে রক্ষা করার জন্য। এটি বিএনপি’র কোনো আন্দোলন নয়। দেশের মানুষ এখন এই সরকারের কবল থেকে মুক্তি চায়।

দেশে দুর্ভিক্ষ হতে পারে’ প্রধানমন্ত্রীর এমন বক্তব্য প্রসঙ্গে বিএনপির এই নেতা বলেন, প্রধানমন্ত্রী এখন দুর্ভিক্ষের কথা বলছেন কেন? এমনকি কিছুদিন আগেও তারা (সরকার) সর্বত্র উন্নয়নের দাবি করেছেন। আসলে কোটি কোটি টাকা মালয়েশিয়া, কানাডাসহ অন্যান্য দেশে পাচার করে দেশকে ঝুঁকিতে ফেলা হয়েছে। মানুষ আর এ ধরনের উন্নয়ন চায় না। দেশকে বাঁচাতে সব ধরনের বিভেদকে কবর দিয়ে ঐক্যবদ্ধ হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, আমরা ক্ষমতায় গেলে জাতীয় সরকার গঠন করব। আমরা জনগণের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন নই, আমরা জনগণের সঙ্গে থাকি।

মির্জা ফখরুল বরিশালের মনুষকে বীর সম্বোধন করে করে বলেন, যে বাধা বিপত্তি উপেক্ষা করে আপনার এ মহাসমাবেশে এসেছেন, আমি আপনাদের স্যলুট করি’। তিনি অবিভক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শের এ বাংলা একে ফজলুল হক,বৃটিশবিরোধী নেতা অশ্বনী কুমার দত্ত, সেক্টর কমান্ডার মেজর জলিল, সাবেক প্রেসিডেন্ট আবদুর রহমান বিশ্বাস, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দিন, বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর (অবঃ) শাহজাহান ওমর সহ দক্ষিণাঞ্চলের মুক্তিযোদ্ধাদের কথা কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করেন। তিনি বলেন, আমরা দেশের মানুষের স্বাধিকার ও গনতন্ত্রের জন্য মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম। কিন্তু আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে তখনই জনগনের অধিকার হরন করেছে।

বিএনপি মহাসচিব প্রশ্ন করেন, এ সরকার বিদ্যুৎ নিয়ে অনেক কথা বলেছিল, কিন্তু এখন কি অবস্থা? তিনি নিজের অভিজ্ঞতা বর্ননা করে বলেন, সকাল থেকে বরিশালে ১০ বার বিদ্যুৎ বন্ধ হয়েছে। তিনি বলেন, একটি সেক্টর পাওয়া যাবেনা যেখানে এ সরকারের লোকজন চুরি করেনি।
মির্জা ফখরুল বলেন, ছোটবেলায় মা কোলের শিশুকে বর্গী এলো দেশে বলে ভয় দেখিয়ে ঘুম পাড়াতেন। এখন দেশে সেই বর্গী এসেছে। এরা (আ.লীগ) চুরি আর সন্ত্রাস ছাড়া কিছু বোঝেনা। দেশের আলেম-ওলামাদের পর্যন্ত জেলে ভরে রেখেছে। অথচ নিজেরা চুরি আর সন্ত্রাসের রাজত্ব কায়ম করেছে।

স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা অব্বাস বলেন, এ সরকারের অধীনে কোন নির্বাচন নয়, নতুন প্রজন্মকে চুরি ডাকাতি না শিখিয়ে একটি ভাল ভোট উপহার দিতে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ হবারও আহবান জানান তিনি।

স্থায়ী কমিটির আরেক সদস্য ড. আবদুল মঈন খান বলেন, দেশে আজ মানবধিকার, নারীর মর্যাদা, আদব-কায়দা, সংবাদপত্রের স্বাধিনতা আর ন্যায়বিচার বিলুপ্ত হয়েছে। এটা একটা অবৈধ ও ভুয়া সরকারের ফসল।
স্থায়ী কমিটির সদস্য আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী বলেন, বরিশালের এ মহাসমাবেশ একটি বিপ্লব এনে দিয়েছে। আজ প্রমাণিত হয়েছে, আগামী দিনের আন্দোলনে কোন পরিবহন লাগবে না। তা বরিশালের মানুষ বুঝিয়ে দিয়েছে। তিনি বলেন, আজ দেশের মানুষ দুবেলা খাবার পায়না। গ্যাসের অভাবে রান্না হয়না। সরকারকে উদ্দেশ্য করে আমীর খসরু বলেন, পদত্যাগ করে মাঠে আসুন খেলা হবে।

সাবেক মন্ত্রী মেজর (অবঃ) হাফিজ উদ্দীন আহমেদ বীর বিক্রম বলেন, সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী যেখানে বলেন, ‘ভারত সরকারকে তিনি অনুরোধ করেছেন হাসিনা সরকারকে ক্ষমতায় রাখতে সহায়তা করতে’, সেখানে এ সরকারে পায়ের তলার মাটি কোথায় তা বুঝতে বাকি থকেনা।

সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আলতফ হোসেন চৌধুরী বলেন, এ অবৈধ সরকার দেশকে ধংস করে দিয়েছে। এ সরকারের সময়ে দেশের গণতন্ত্র সহ সব প্রতিষ্ঠান ধংস হয়ে গেছে।

ভাইস চেয়ারম্যান আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ওনাদের নেতা বলেছেন, তিনি নাকি বিএনপি’র পতন ধ্বনি শুনছেন। আমার মনে হয় তিনি বলতে ভুল করেছেন। আসলে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ধ্বনি শুনছেন।

যুগ্ম মহাসচিব হাবিব-উন-নবী খান সোহেল বলেন, এ সরকারের আমলে নিত্যপণ্যের দাম সর্বকালের চূড়ায় উঠেছে। মানুষ বড়কষ্টে আছে। এরা শুধু ইউক্রেন যুদ্ধ দেখায়। তিনি প্রশ্ন করেন, দেশে ডিমের দামও সর্বকালের সর্বোচ্চ, মুরগি কি ডিম পাড়ার আগে ইউক্রেন ঘুরে আসছে, যে দাম বাড়ল?

আরেক যুগ্ম মহাসচিব সৈয়দ মোয়াজ্জেম হেসেন আলাল বলেন, আওয়ামী লীগের অনেকেরই মোহমুক্তি ঘটছে। অনকেই দুধ দিয়ে গোসল করে অওয়ামী লীগ ছাড়ছেন। এসব সত ও ন্যায়পরায়ণ পদত্যাগী আওয়ামী লীগ নেতাদের জন্য ভবিষ্যতে বিএনপি’র দরজা খোলার থাকবে।

মুজিবুর রহমান সারোয়ার বলেন, কলঙ্কিত ভোটের কারণে দেশে আজ গনতন্ত্র নির্বাসিত। এখন আবার ইভিএম দিয়ে এসব অবৈধ কর্মকান্ডের বৈধতা দেয়ার পায়তারা চলছে। সারোয়ার বলেন, আমরা আন্দোলনে আছি। এ সরকারকে বিদায় না করে ঘরে ফিরব না।

মহানগর বিএনপি আহবায়ক মুনিরুজ্জামান ফারুখের সভাপতিত্বে গণসমাবেশে অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য রাখেন- বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য বেগম সেলিমা রহমান, ভাইস চেয়ারম্যান ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন, এ্যাডভোকেট জয়নুল আবেদিন, সাবেক এমপি জহির উদ্দিন স্বপন ও বরিশাল বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক বিলকিস জাহান শিরিনসহ বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতৃবৃন্দ।

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *