বিশ্ব মন্দা ও ডলারের ঊর্ধ্বমুখী মূল্যের ঢেউয়ের প্রভাব মোকাবিলায় বাজেটে থোক বরাদ্দসহ ৯ খাতের ব্যয়ের ক্ষেত্রে কঠোর হচ্ছে অর্থ বিভাগ। বরাদ্দের বেশি বা বিধিনিষেধ এড়িয়ে ব্যয় বন্ধ করতে এসব খাতে মনিটরিং জোরদার করা হচ্ছে।
পাশাপাশি আগামী জুন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট খাতের ব্যয়ের পরিকল্পনা চাওয়া হয়েছে সব মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছে। পুরো প্রক্রিয়াটি বাস্তবায়নের জন্য বৃহস্পতিবার থেকে অর্থ বিভাগ ধারাবাহিক বৈঠক শুরু করেছে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে। এর আগে কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচির আওতায় বিদেশ ভ্রমণসহ ছয়টি খাতের ব্যয় স্থগিত এবং পাঁচ খাতের ব্যয় হ্রাস করে অর্থ মন্ত্রণালয়। সেখান থেকে বড় অঙ্কের অর্থ সাশ্রয় হবে।
সূত্র জানায়, ব্যয়ে কঠোর নজরদারির মাধ্যমে চলতি বাজেট থেকে কমপক্ষে ২০ হাজার ৯৩ কোটি টাকা ব্যয় কমানোর চিন্তা রয়েছে অর্থ বিভাগের। এ ব্যয় হ্রাসের পর সংশোধিত বাজেটের আকার ৬ লাখ ৭৮ হাজার ৬৪ কোটি থেকে কমে ৬ লাখ ৫৭ হাজার ৯৭১ কোটি টাকায় দাঁড়াবে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, ব্যয় করতে হলে আয় থাকতে হয়। এ বছর রাজস্ব আদায় লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে বেশি হচ্ছে না। অপরদিকে ডলারের মূল্যবৃদ্ধির কারণে আমদানিসহ অন্যান্য ব্যয় বেড়েছে। ফলে ব্যয় ব্যবস্থাপনা ঠিক রাখতে কয়েকটি খাতের বরাদ্দ নিয়ে পর্যালোচনা করা হবে।
এ বিষয়ে সাবেক অর্থসচিব (সিনিয়র) মাহবুব আহমেদ বলেন, অর্থনীতিতে শুধু বাংলাদেশ নয়, পুরো বিশ্ব একটি ক্রান্তিকাল অতিক্রম করছে। ব্যয় কমাতে সরকার কৃচ্ছ সাধনের উদ্যোগ নিয়েছে। কারণ, যে অনুপাতে রাজস্ব আদায় হওয়ার কথা, সেটি হচ্ছে না। এজন্য ব্যয়ে কঠোর নজরদারির পাশাপাশি রাজস্ব আয় বাড়ানোর দিকে মনোযোগ দিতে হবে।
সূত্রমতে, কঠোর নজরদারির আওতায় আনা খাতগুলো হচ্ছে-বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাঁদা পরিশোধ খাত। এছাড়া বাজেটে থোক বরাদ্দ, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতনভাতা, পিআরএল ও শ্রান্তি বিনোদনসংক্রান্ত কর্মকর্তা-কর্মচারীর পেছনে ব্যয়। পাশাপাশি সরকারের গ্যাস, বিদ্যুৎ, পানি ও টেলিফোন খাতের বিল পরিশোধ, ভূমি উন্নয়ন কর, জ্বালানি খাতে ব্যয় খাতও পর্যবেক্ষণে রাখা হয়েছে।
প্রসঙ্গত, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধের কারণে মার্কিন ডলার সংকট সৃষ্টি হয়। বৈদেশিক মুদ্রা বিনিময় হার অস্বাভাবিকভাবে বৃদ্ধি পায়। এক ডলারের মূল্য ৮৮ টাকা থেকে ১১৯ টাকা পর্যন্ত ওঠে। যদিও সরকারিভাবে এটি এখন আমদানি ব্যয়ের ক্ষেত্রে ১০৪.৬৮ টাকা ধরা আছে। অস্বাভাবিক মূল্যবৃদ্ধির কারণে এক ডলারের পেছনে টাকার মান কমেছে প্রায় ১৭ টাকা। যার প্রভাব গিয়ে পড়েছে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধের ক্ষেত্রে।
সূত্রমতে, মন্ত্রণালয়গুলোকে বৈদেশিক ঋণ ও ঋণের সুদ এবং আন্তর্জাতিক বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের চাঁদা পরিশোধের ক্ষেত্রে বরাদ্দ বাড়ানোর নির্দেশ দিয়েছে অর্থ বিভাগ। এই তিনটি খাতে চলতি বাজেটের শুরুতে বরাদ্দের চেয়ে অতিরিক্ত টাকা সংস্থান রাখতে বলা হয়েছে সব মন্ত্রণালয় ও বিভাগকে।
এ প্রক্রিয়ার সঙ্গে জড়িত অর্থ বিভাগের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা জানান, চলতি বাজেট প্রণয়নের সময় (এপ্রিল-জুন) প্রতি ডলারের মূল্য ৮৬ টাকা ধরে সব ধরনের হিসাবনিকাশ করা হয়। এখন ডলারের মূল্য ১০৪ টাকা। আর বৈদেশিক ঋণ, ঋণের সুদ ও বিভিন্ন আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানে চাঁদা পরিশোধের ক্ষেত্রে বেশি দাম দিয়ে ডলার কিনতে হবে সরকারকে। এতে ব্যয়বৃদ্ধির কারণে মন্ত্রণালয়গুলোর টাকা বেশি দরকার হবে।
সূত্র আরও জানায়, এ বছর বাজেটের থোক বরাদ্দের টাকা ব্যয় করতে নিরুৎসাহিত করছে অর্থ বিভাগ। এ খাতে ৭ হাজার ৬৮৪ কোটি টাকা সংরক্ষণ রাখা আছে। থোক বরাদ্দের টাকা ব্যয়ের জন্য সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়ে আলাদা কোড আছে। ওই কোড থেকে থোক বরাদ্দের টাকা সরিয়ে আনা হচ্ছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়। কৃচ্ছ্রসাধন কর্মসূচির আওতায় থোক বরাদ্দের অর্থ ব্যয় না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে অর্থ বিভাগ।
এদিকে নির্বাচন সামনে রেখে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বাড়ানোর কোনো পরিকল্পনা সরকারের নেই-এটি সংসদে বলেছেন অর্থমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামাল। ফলে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নগদ মজুরি ও বেতন খাতে আর বাড়ছে না। এ বছর ৩৯ হাজার ৬৬১ কোটি টাকা বেতন খাতে বরাদ্দ আছে। অর্থ বিভাগ সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোকে নির্দেশ দিয়ে বলেছে, যেহেতু বেতন খাতে বরাদ্দ বাড়বে না, তাই বিষয়টি প্রধান হিসাবরক্ষণ কর্মকর্তার সঙ্গে আলোচনা করে সমাধান করতে হবে।
এদিকে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার জ্বালানি খাতের ২০ শতাংশ ব্যয়ের ওপর নিষেধাজ্ঞা আগেই দিয়েছে অর্থ বিভাগ। আগামী জুন পর্যন্ত সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার কাছে পেট্রোল, ডিজেল ও সিএনজিচালিত যানবাহনের সংখ্যার তথ্য চাওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের যানবাহনগুলোয় একই সময়ে পেট্রোল ও লুব্রিকেন্ট খাতে ব্যয়ের যৌক্তিকতার তথ্য ও কাগজপত্র চাওয়া হয়েছে।
সূত্র আরও জানায়, সরকারের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়, বিভাগ ও সংস্থার বিদ্যুৎ, গ্যাস, পানি ও টেলিফোন খাতের ব্যয়ের ওপর নজর রাখছে অর্থ বিভাগ। এসব খাতে কত টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে এবং বিপরীতে কত টাকা ব্যয় হয়, এর বিস্তারিত প্রতিবেদন চাওয়া হয়েছে। একইভাবে ভূমি উন্নয়ন কর বাবদ বরাদ্দকৃত অর্থের মধ্যে অর্থব্যয়ের হিসাব দিতে বলা হয়েছে।