জাতীয়

সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ এখনো নয় কেন ?

বাংলাদেশ বিশ্বের প্রধানতম ভাষাভিত্তিক জাতিরাষ্ট্র। এ দেশের ৯৮.৯ শতাংশ মানুষের মাতৃভাষা বাংলা। ভাষাবিকাশের ইতিহাসে ১৩৭২ বছরের ঐতিহ্যসমৃদ্ধ পুরোনো এ ভাষা। পাল এবং সেন সাম্রাজ্যের প্রধান ভাষা ছিল বাংলা। সুলতানি আমলেও এ অঞ্চলের অন্যতম রাজভাষা ছিল বাংলা। মুসলিম সুলতানদের পৃষ্ঠপোষকতায় গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্য রচিত হয়েছিল বাংলায়। আরাংকান রাজসভার আনুকুল্যে বাংলা সাহিত্যের প্রভূত সমৃদ্ধি সাধিত হয়েছে। ব্রিটিশ উপনিবেশবিরোধী বাংলার নবজাগরণ উত্থান এবং বাংলার কৃষ্টি ও সাংস্কৃতিক বিকাশকে এক সূত্রে গ্রথিত করেছিল বাংলাভাষা ও সাহিত্য। বর্তমানে মাতৃভাষীর সংখ্যায় বাংলা ইন্দো-ইউরোপীয় ভাষা পরিবারের চতুর্থ ও বিশ্বের ষষ্ঠবৃহত্তম ভাষা।

মোট ব্যবহারকারীর সংখ্যা অনুসারে বাংলা বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ভাষা। বিভাগোত্তর কালে পাকিস্তানের মোট জনসংখ্যার ৫৬ ভাগ মানুষের ভাষা ছিল বাংলা। কিন্তু বে-আইনিভাবে ক্ষমতার দাপটে বাংলার বদলে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা ঘোষণা করেছিল জিন্নাহ-নাজিমুদ্দীন গংরা। ফলে দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে জিন্নাহর ‘সাধের পাকিস্তান’ কায়েমের পর ১৯৪৭ সাল থেকে ১৯৫৬ সাল অবধি বাংলাভাষা আন্দোলনকে মূলীভূত করে বাঙালি জাতীয়তাবাদের বিকাশ স্ফূর্ত হয়েছিল বায়ান্নোর চেতনার শক্ত পাটাতনে দাঁড়িয়ে ১৯৬২, ১৯৬৬, ১৯৬৯, ১৯৭০ এবং ১৯৭১ সালের উত্তাল আন্দোলন ও সংগ্রামের বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে অবশেষে বঙ্গবন্ধুর তর্জনীর ইশারায় ও তার উদাত্ত আহ্বানে গণতান্ত্রিক ও সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ নামক জাতিরাষ্ট্রের অভ্যুদয় ঘটেছিল। কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, বহু রক্তের বিনিময়ে মাতৃভাষা আন্দোলনকে কেন্দ্র করে যে একটি স্বাধীন স্বদেশ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যার মূল অঙ্গীকার ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রয়োগ; স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তীতেও আমরা তার পূর্ণ বাস্তবায়ন সম্ভব করতে পারিনি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে এখনো জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষার পূর্ণ প্রয়োগ নয় কেন?

আমরা জানি, ১৯৪৭ সালের ৭ সেপ্টেম্বর তরুণ তুর্কি শেখ মুজিবুর রহমান স্থির ও অচঞ্চল কণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন ‘বাংলাভাষাকে পূর্ব পাকিস্তানের শিক্ষার বাহন ও আইন-আদালতের ভাষা করা হোক’। এর ধারাবাহিকতায় ১৯৪৮ সালের ১১ মার্চ থেকে ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত নানা আন্দোলন, সংগ্রাম, মিছিল, মিটিং, সভা ও সমাবেশ শেষে এবং সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর রহমানসহ নাম না জানা শহিদদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত হয়েছে আমাদের মাতৃভাষা। বস্তুত বাংলাকে রাষ্ট্রভাষাকরণের দাবিতে ক্রমবর্ধমান গণআন্দোলনের মুখে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার শেষাবধি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয় এবং ১৯৫৪ সালের ৭ মে পাকিস্তান গণপরিষদে বাংলা অন্যতম রাষ্ট্রভাষা রূপে গৃহীত হয়। এরপর ১৯৫৬ সালে পাকিস্তানের প্রথম সংবিধান প্রণীত হলে ২১৪ নম্বর অনুচ্ছেদে বাংলা ও উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে গ্রহণ করা হয়।

দেশ স্বাধীনের আগে ১৯৭১ সালের ১৫ ফেব্রুয়ারি সত্তরের সাধারণ নির্বাচনে ভূমিধস বিজয়ের পর বিজয়ী দল আওয়ামী লীগ-এর সভাপতি হিসাবে বঙ্গবন্ধু ঘোষণা করেছিলেন ‘…আমাদের হাতে যেদিন ক্ষমতা আসবে, সেদিন থেকেই দেশের সর্বস্তরে বাংলাভাষা চালু হবে। বাংলাভাষার পণ্ডিতরা পরিভাষা চালু করবেন, তারপরে বাংলাভাষা চালু হবে তা হবে না। পরিভাষাবিদরা যত খুশি গবেষণা করুন। আমরা ক্ষমতা হাতে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাভাষা চালু করে দিব, সে বাংলা যদি ভুল হয়, তবে ভুলই চালু হবে, পরে তা সংশোধন করা হবে’।

আমরা জানি, বঙ্গবন্ধু তার দৃপ্তকণ্ঠে ঘোষিত এ প্রতিশ্রুতি সদ্য স্বাধীন দেশের রাষ্ট্রনায়ক হিসাবে বাস্তবায়নের দৃঢ় পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। তাই তো আমাদের সংবিধানে রাষ্ট্রভাষা বাংলা। পৃথিবীর ইতিহাসে বাংলাদেশ একমাত্র দেশ যার সংবিধান বাংলাভাষায় লেখা হয়েছে এবং যার সংবিধানে বর্ণিত রাষ্ট্রভাষা একটি এবং তা হলো বাংলাভাষা। সংবিধানের অনুচ্ছেদ-৩ এ বলা হয়েছে-‘প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা’। জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২ সালের ১৮ ডিসেম্বর বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্টের উদ্বোধন অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী হিসাবে তার দিকনির্দেশনামূলক বক্তব্যে সুপ্রিমকোর্টের বিচারকদের কাল-বিলম্ব না করে বাংলায় রায় লেখার আহ্বান জানিয়েছিলেন। তিনি সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের আরও নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছিলেন। বঙ্গবন্ধুর শাসনামলে ১৯৭৩ সালে তদানীন্তন সংস্থাপন মন্ত্রণালয় থেকে সরকারি দাপ্তরিক কাজে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা জারি করা হয়। এতদসত্ত্বেও স্বাধীনতার তিন বছর পর তিনি অত্যন্ত বিষাদের সঙ্গে লক্ষ করলেন যে, সরকারি-বেসরকারি অফিসে ও আদালতে এবং উচ্চশিক্ষায় অবাধে বিজাতীয় ইংরেজি ভাষার চর্চা চলছে। এতে তিনি অত্যন্ত মর্মাহত হয়ে ১৯৭৫ সালের ১২ মার্চ একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে বাংলাভাষা প্রচলন সংক্রান্ত সরকারি নির্দেশনা প্রদান করেন। সেই প্রজ্ঞাপনে উল্লেখ করা হয়-‘দীর্ঘ তিন বছর অপেক্ষা করার পরও বাংলাদেশের বাঙালি কর্মচারীরা ইংরেজি ভাষায় নথি লিখবেন সেটি অসহনীয়। এ সম্পর্কে আমার পূর্ববর্তী নির্দেশ সত্ত্বেও এ ধরনের অনিয়ম চলছে। আর এ উশৃঙ্খলতা চলতে দেওয়া যেতে পারে না’। এর আগে ১৯৫২ সালে চীন ভ্রমণকালে এবং ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে তিনি বাংলায় ভাষণ দিয়ে বাংলাভাষাকে বিশ্বে মর্যাদার আসনে অধিষ্ঠিত করেন। মাতৃভাষার পক্ষে তার এ শক্ত অবস্থানের কারণে জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলাভাষা প্রচলনে তুমুল উদ্দীপনা প্রদীপিত হয়েছিল। চাকরি, পদোন্নতি, নথিপত্রে এবং সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিচারে বাংলাভাষার গুরুত্ব ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পেয়েছিল। ফলে বাংলাভাষা শেখার একটা ব্যাপক আগ্রহ সৃষ্টি হয়েছিল। কিন্তু ১৯৭৫ সালে ১৫ আগস্ট অকালে গণ-দুশমনদের বুলেটের আঘাতে তার জীবনাবসানের পর জাতীয় জীবনে সর্বস্তরে বাংলাভাষার প্রচলন প্রচণ্ড প্রতাপে বাধাগ্রস্ত হয়। বাংলাভাষার ওপর ঔপনিবেশবাদের ভূত আবার চেপে বসে। বাংলাদেশ বেতার, চালনা বন্দর, পৌরসভা, রাষ্ট্রপতি শব্দের পরিবর্তে যথাক্রমে রেডিও, পোর্ট অব চালনা, মিউনিসিপাল করপোরেশন, প্রেসিডেন্ট ব্যবহারের বাতিক বাড়তে থাকে। এ নৈরাজ্য থেকে পরিত্রাণের উপায় হিসাবে ১৯৭৯ সালে আবার সরকারি কাজে বাংলা ব্যবহারের নির্দেশনা দেওয়া হয়। কিন্তু এর কোনো বাস্তব প্রয়োগ ঘটে না। ফলে ১৯৮৪ সালে সংস্থাপন মন্ত্রণালয় কর্তৃক ‘বাংলাভাষা বাস্তবায়ন কোষ’ নামীয় একটি প্রকল্প চালু করে। এ প্রকল্পের ১৮ নম্বর কার্যক্রমটি ছিল সব অফিসের সাইনবোর্ড ও কর্মকর্তাদের নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। নথিপত্র বাংলায় লিখে স্বাক্ষর ও অনুস্বাক্ষর বাংলায় দিতে হবে। সে অনুযায়ী আমাদের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতি প্রতিনিয়ত বাংলায় স্বাক্ষর করছেন। কিন্তু সর্বত্র এ নির্দেশনা শতভাগ ফলবতী হয়নি। ফলে কঠোর নির্দেশনা দিয়ে ১৯৮৭ সালে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন’ প্রণীত হয়। এ আইন প্রবর্তনের পর বাংলাদেশে সর্বত্র তথা অফিস-আদালত, আধা-সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান কর্তৃক বিদেশের সঙ্গে যোগাযোগ ছাড়া অন্যান্য সব ক্ষেত্রে নথি ও চিঠিপত্র, আইন-আদালতের সওয়াল-জবাব ও অন্যান্য আইনানুগ কার‌্যাবলি অবশ্যই বাংলায় লিখার নির্দেশ প্রদান করা হয়। বাংলাভাষা প্রচলন আইনের ৩(১) উপধারায় বলা হয়, উল্লিখিত কোনো কর্মস্থলে কোনো ব্যক্তি বাংলাভাষা ছাড়া অন্য কোনো ভাষায় আবেদন বা আপিল করেন তাহলে সে আবেদন বে-আইনি ও অকার্যকর বলে গণ্য হবে। ধারা ৩(৩)-এ উল্লেখ করা হয়, যদি কোনো কর্মকর্তা বা কর্মচারী এ আইন অমান্য করেন তবে তিনি সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধির অধীনে অসদাচরণ করেছেন বলে গণ্য হবেন এবং তার বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী শৃঙ্খলা ও আপিল বিধি অনুসারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। কিন্তু বরাবরের মতো এ আইনও পূণরূপে বাস্তবায়িত হয়নি। সে কারণে ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১১ তে বাংলাদেশ আইন কমিশন উচ্চ আদালতে আইনটি কার্যকর করার পাশাপাশি ন্যায়বিচারে সবার সহজ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার জন্য সুপারিশ করে। অন্যদিকে ২০১২ সালে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে একটি পরিপত্র জারি করে বাংলা একাডেমি প্রণীত প্রমিত বাংলা বানান রীতি অনুরসণের জন্য নির্দেশনা দেওয়া হয়। ২০১৫ সালে ‘সরকারি কাজে ব্যবহারিক বাংলা’ নামক পুস্তিকা প্রকাশ করা হয়। এতদসত্ত্বেও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, অফিসে, উচ্চ আদালতে বাংলাভাষার পূর্ণ প্রচলন ঘটেনি। সরকারি অফিসে এবং বাংলাদেশ ব্যাংক তার কর্মকাণ্ডে প্রধানত বাংলা ব্যবহার করলেও বাণিজ্যিক বেসরকারি ব্যাংকগুলোতে এবং করপোরেট অফিসে বাংলার উপস্থিতি খুবই কম বা কোনো ক্ষেত্রে নেই বললেই চলে। এদিকে বেসরকারি ব্যাংকগুলোর আর্থিক নথিপত্রে ইংরেজি ভাষার প্রচলন থাকায় ২০১৮ সালে বাংলাদেশ ব্যাংক সব ব্যাংকে ‘বাংলাভাষা প্রচলন আইন, ১৯৮৭’-এর লক্ষ্য বাস্তবায়ন এবং গ্রাহকদের স্বার্থ রক্ষার জন্য ঋণ অনুমোদনের চিঠিতে বাংলা ব্যবহার করার নির্দেশ দেয়। কিন্তু এ নির্দেশের বাস্তবায়ন খুব কমই লক্ষ করা যায়। প্রযুক্তি, প্রকৌশল, চিকিৎসা এবং উচ্চশিক্ষায়ও ১৯৮৭ সালের বাংলাভাষা প্রচলন আইনের প্রয়োগের তেমন বালাই নেই। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নামফলকেও বাংলার প্রয়োগ নেই। এ পরিপ্রেক্ষিতে ২০১৪ সালের ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টের আইনজীবী ড. ইউনুস আলী আকন্দের একটি রিট আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে ওই বছরের ১৭ ফেব্রুয়ারি বিচারপতি কাজী রেজাউল হক নেতৃত্বাধীন বেঞ্চ বাংলাভাষা প্রচলন আইন ১৯৮৭ অনুযায়ী অফিস-আদালত, গণমাধ্যমসহ সর্বত্র বাংলাভাষা ব্যবহারের নির্দেশ কেন দেওয়া হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেন। পাশাপাশি দূতাবাস ও বিদেশি প্রতিষ্ঠান ছাড়া দেশের সব সাইনবোর্ড, নামফলক ও গাড়ির নম্বর-প্লেট, বিলবোর্ড এবং ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন বাংলায় লেখা ও প্রচলনের নির্দেশ দেন। আদালতের আদেশের তিন মাস পর ২০১৪ সালের ১৪ মে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয় সিটি করপোরেশন, পৌরসভা ও ক্যান্টনমেন্ট বোর্ডগুলোকে এ আদেশটি কার্যকর করতে বলে। কিন্তু সে আদেশের বাস্তবায়নে লক্ষ্যযোগ্য কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। এরপর ২০১৬ সালের ২৩ ফেব্রুয়ারি স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়কে এক চিঠির মাধ্যমে সাইনবোর্ড, বিলবোর্ড, ব্যানার এবং গাড়ির নতুন প্লেটে বাংলাভাষার ব্যবহার নিশ্চিত করার অনুরোধ জানায় জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের এ অনুরোধেরও পূর্ণ বাস্তবায়ন ঘটেনি। অপার বিস্ময় জাগে এই দেখে যে, ষোলো কোটি বাঙালির এই বাংলাদেশের অধিকাংশ বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের নাম ইংরেজিতে লেখা। বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন-এর ওয়েবসাইটে সরকারি পঞ্চাশটি বিশ্ববিদ্যালয়ের যে নামের তালিকা, সেটি ইংরেজিতে বিদ্যমান রয়েছে। সেখানে ব্র্যাকেট বন্দিতেও বাংলা নামের বালাই নেই। অথচ প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয় আইন পর্যালোচনা করে দেখা গেছে যে, সেটির নামকরণ বাংলায় করার কথা রয়েছে। যেমন, শেখ হাসিনা বিশ্ববিদ্যালয়, নেত্রকোনা ইত্যাদি। এ ছাড়া বাংলাভাষা প্রচলন আইন থাকার পরও আমারা ডিপিডিসি, বিআরটিসি, টেলিটক, বিটিএমসি, বিজিবি, বিটিসিএল, বিজেএমসি ইত্যাদি নামকরণ দেখতে পাই। অথচ প্রতিবেশী দেশ নেপালে সরকার ও শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের নির্দেশে বিদেশি ভাষা পরিত্যাগ করে স্থানীয় নিজ ভাষায় মাত্র দুই মাসের মধ্যে নামকরণ করেছে।

আসলে বাংলাভাষার প্রয়োগ সাধনে আমাদের মধ্যে এক ধরনের হীনমন্যতা কাজ করে। তা না হলে প্রেরক ও প্রাপক বা আদান ও প্রদানকারী বহিরঙ্গে বাঙালি হলেও বিয়ে, জন্মদিন, বউভাত গায়ে হলুদসহ নানা আয়োজনের আমন্ত্রণপত্র ইংরেজিতে রচনা করবেন কেন? দ্বিতীয়ত যে রোমান হরফে বাংলা লেখার বিরুদ্ধে পাকিস্তান জামানায় এত আন্দোলন করেছি আমরা, সেই আমরা কেনইবা ইলেকট্রনিক ডিভাইসে রোমান হরফে বাংলা লিখছি? স্কুল, কলেজ, এমনকি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের অনেকেই শ্রেণিকক্ষে ও শ্রেণিকক্ষের বাইরে শিক্ষার্থীদের সঙ্গে পড়াশোনা ও ভাব বিনিময়কালে প্রমিত বাংলা ব্যবহার করেন না। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক ড. বিশ্বজিৎ ঘোষ এক লেখায় আফসোস করে বলেছেন, ‘বাংলা ছাড়া তাঁর বিশ্ববিদ্যালয় অন্য কোনো বিভাগে বাংলায় প্রশ্নপত্র রচিত হয় না।’

দেশের বিভিন্ন প্রচার মাধ্যমে বাংলা গান পরিবেশনের বিরতিতে কথোপকথনকালে উপস্থাপক ও শিল্পী হিন্দি, ইংরেজি ও বাংলা মিশ্রণে অদ্ভুত বাক্য বিনিময় করে থাকেন। এফএম রেডিওর উপস্থাপকদের তো মনে হয় তাদের মাতৃভাষা ইংরেজি, কখনো হিন্দি বা অন্য ভাষা। আর এখানে তারা কষ্ট করে বাংলা বলছেন। সবশ্রোতা বাঙালি হওয়ার পরও জকি নামক এসব উপস্থাপক কুল হ্যালো ভিউয়ার্স, হ্যালো লিসেনার্স বলে জগাখিচুড়িসমেত বিকৃত ভাষায় অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করছেন।

আমাদের নতুন প্রজন্ম স্মার্টনেস প্রকাশের প্রত্যয় থেকে ভিন্ন ভাষার মিশ্রণে নতুন নতুন অদ্ভূতুড়ে শব্দ ব্যবহার করছে। ট্রিট, জোশ, পিনিক, অসাম, মাগার, বিন্দাস, প্যারা, প্রাংক, মাইরালা, খ্রাপ (খারাপ), সেইরাম, ভাল্লাগছে, আম্রা (আমরা), এক্টা, আজিব, তার ছিঁড়া, Kmn,

ekdm Bay/Bai, Wlc, Bandu, Wcm, Gf, Tnxq, R8, Hbd, Gm/Gd, Nc, Knk, Srsly ইত্যাদি উচ্চারণে ও লেখায় তারা ভাব বিনিময় করছে।

বস্তুত বাংলাভাষার এ দীনদশার মূল কারণ আমাদের কোনো ভাষানীতি নেই, নেই কোনো ভাষা পরিকল্পনা। বিকৃতিকারীদের জন্য নেই কঠোর কোনো শাস্তির ব্যবস্থা। অথচ একুশের চেতনার কথা হরহামেশা আমরা বলি, ভাষা নিয়ে কত-শত গর্ব করি; কিন্তু অন্তরে ও বাইরে গভীর অনুরাগ লালন করি না। একুশের যে স্লোগান ‘মোদের গরব মোদের আশা আ মরি বাংলা ভাষা,’ ‘রাষ্ট্রভাষা বাংলা চাই’, ‘সর্ব স্তরে বাংলাভাষা চালুক কর’, ‘মাতৃভাষা হবে শিক্ষার বাহন’ তার প্রতি আনত হই না। কিন্তু চীন, কোরিয়া, জার্মানি, জাপান, তুরস্ক, ফ্রান্স, সুইজারল্যান্ড, ইরানি প্রমুখ জাতি মাতৃভাষায় জ্ঞান-বিজ্ঞান চর্চা করে নিজেদের অন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছে। তাই উন্নত বাংলাদেশ গড়তে চাইলে আমাদের আগে মাতৃভাষার দ্বারস্থ হতে হবে। রবীন্দ্রনাথ যে বলেছেন ‘আগে চাই বাংলাভাষার গাঁথুনি, তারপর ইংরেজি শিক্ষার পত্তন’-সে কথা সর্বাগ্রে মানতে হবে। ভাষার গাঁথুনি সবল করার পাশাপাশি বাংলাভাষাকে অর্থনৈতিক স্রোতধারার সঙ্গে সংযোগ সাধন করতে হবে। এরপরে পর-ভাষার প্রতি নজর দিতে হবে। কারণ শেকড় শক্ত-পোক্ত না হলে সে বৃক্ষ কোনদিন ফলবতী হয় না, তেমনি শত-সহস্র শাখায় সেটি পল্লবিতও হয় না।

সেলিম আকন্দ , লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *