রাজশাহীর কুইক রেন্টাল ‘নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন’ বিদ্যুৎকেন্দ্রকে (পাওয়ার প্ল্যান্ট) অলস বসিয়ে রেখেও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ৬৬৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে বিদ্যুৎ বিভাগ। ১০ বছরে কেন্দ্রটির ৪৩৮ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করার কথা থাকলেও উৎপাদন করেছে ১৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ইউনিট। ১০ বছরের মধ্যে ৭ বছরই (২ হাজার ৬৪৯ দিন) উৎপাদন বন্ধ ছিল। নগরীর উপকণ্ঠ কাটাখালীতে বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের জায়গায় স্থাপিত নর্দার্ন পাওয়ারের মালিক রাজশাহী-৪ (বাগমারা) আসনের সংসদ-সদস্য ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক। ডিজেলচালিত বিদ্যুৎকেন্দ্রটির উৎপাদন ক্ষমতা ৫০ মেগাওয়াট। এটি নির্মাণে ৩০০ কোটি টাকা খরচ হয়েছে।
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ডের (পিডিবি) প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ২০১১-১২ থেকে ২০২১-২২ অর্থবছর প্রায় ১০ বছর নর্দার্ন পাওয়ার সলিউশন ১৩৩ কোটি ৮৯ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে ২ হাজার ২১৬ কোটি টাকা খরচ হয়। এর মধ্যে প্রথম বছরে গড়ে প্রতি ইউনিটের উৎপাদন খরচ ১৫ দশমিক ৭০ টাকা নির্ধারণ করা হয়। এর পরের ৪ বছর প্রতি ইউনিটের খরচ কিছুটা বেশি হয়। ২০২০-২০২১ অর্থবছরে নর্দার্ন পাওয়ারের বিদ্যুতের উৎপাদন খরচ ছিল প্রতি ইউনিট ১০ দশমিক ৫০ টাকা। তবে সর্বশেষ ২০২২-২৩ অর্থবছরে প্রতি ইউনিট উৎপাদন খরচ বেড়ে ২৫ দশমিক ৪১ টাকা হয়। যা আগের ১০ বছরের চেয়ে অনেক বেশি।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, বেসরকারি পাওয়ার প্ল্যান্ট অলস বসিয়ে রাখলে চুক্তি অনুযায়ী ক্যাপাসিটি চার্জ দিয়ে থাকে সরকার। এ হিসাবে ২০২১-২২ অর্থবছরে অলস বসে থাকা ২৪৭ দিনের ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে সরকার নর্দার্ন পাওয়ারকে ৮২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পরিশোধ করেছে। ১০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। প্রতিবেদনে আরও দেখা যায়, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে নর্দার্ন পাওয়ার লিমিটেড ২৪ কোটি ৪০ লাখ ইউনিট বিদ্যুৎ উৎপাদন করে যা ১০ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চ। এতে ৩০৮ কোটি ৪৪ লাখ টাকা খরচ হয়। প্রতি ইউনিট খরচ পড়ে ১২ টাকা ৬৪ পয়সা। সরকারের সঙ্গে চুক্তি অনুযায়ী নর্দার্ন পাওয়ার বছরে ৩০৩ দিন চালু রাখার কথা। কিন্তু ২০২১-২২ অর্থবছরে চালু ছিল মাত্র ৫৫ দিন। এ ৫৫ দিনে উৎপাদন করে মাত্র ৬ কোটি ইউনিট বিদ্যুৎ। এ পরিমাণ বিদ্যুৎ উৎপাদনে জ্বালানি খরচ বাবদ সরকারের কাছ থেকে পেয়েছে ৮৪ কোটি ১১ লাখ টাকা। আর বিদ্যুৎকেন্দ্রটির রক্ষণাবেক্ষণে পেয়েছে ১ কোটি ৮৭ লাখ টাকা।
সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, নর্দার্ন পাওয়ারকে ক্যাপাসিটি চার্জের নামে ২০১১-১২ অর্থবছরে ৮ কোটি ৭ লাখ টাকা, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ৭৩ কোটি ৬৩ লাখ, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ৭২ কোটি ৬ লাখ, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ৭২ কোটি ৯২ লাখ, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ৭১ কোটি ৫৩ লাখ, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ৭৯ কোটি ১৫ লাখ, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৬৯ কোটি ৫২ লাখ, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ৬৯ কোটি ৪৮ লাখ, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৬ কোটি ৯৭ লাখ, ২০২০-২১ অর্থবছরে ১ কোটি ৬৮ লাখ এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৮২ কোটি ৫৮ লাখ টাকা পরিশোধ করা হয়েছে। অপরদিকে বিদ্যুৎকেন্দ্রটি ২০১১-১২ অর্থবছরে ৭৮ দিন, ২০১২-১৩ অর্থবছরে ২৭৫ দিন, ২০১৩-১৪ অর্থবছরে ২৪৬ দিন, ২০১৪-১৫ অর্থবছরে ২৩৬ দিন, ২০১৫-১৬ অর্থবছরে ২৪০ দিন, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে ২১০ দিন, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৬২ দিন, ২০১৮-১৯ অর্থবছরে ২৩৬ দিন, ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৩০৮ দিন, ২০২০-২১ অর্থবছরে ৩৪৮ দিন এবং ২০২১-২২ অর্থবছরে ৩১০ দিন বন্ধ ছিল। ১০ বছরে নর্দার্ন পাওয়ার ২ হাজার ৬৪৯ দিন অলস বসে ছিল। অলস বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ হিসাবে ৬৬৭ কোটি ৫৯ লাখ টাকা পেয়েছে।
পিডিবির একজন কর্মকর্তা জানান, কুইক রেন্টালগুলো বসিয়ে রাখলেই বেশি ক্ষতি। উৎপাদন বেশি হলে ইউনিট উৎপাদন খরচ কম হয়। কিন্তু এসব পাওয়ার প্ল্যান্টকে পুরোপুরি উৎপাদনে ব্যবহার করা যায়নি। এ কারণে খরচও বেশি হচ্ছে। পিডিবির এক কর্মকর্তা বলেন, কুইক রেন্টালের মূল সমস্যা হলো বসে থাকলেও ক্যাপাসিটি চার্জ দেওয়া। ফলে সরকারের বিপুল পরিমাণ অর্থ গচ্চা যাচ্ছে। এ কারণে বিদ্যুৎ খাতের ক্ষতি সামাল দেওয়া যাচ্ছে না।
নর্দার্ন পাওয়ারের মালিক ইঞ্জিনিয়ার এনামুল হক বলেন, আমরা তো বসিয়ে রাখতে চাই না। জ্বালানি ঘাটতির কারণে অর্ধেক সময় প্ল্যান্টটি বন্ধ রাখতে হয়। সরকার জ্বালানি সরবরাহ করতে পারে না। আমরা কর্তৃপক্ষকে বারবার বলেছি -জ্বালানি সরবরাহ অটুট রাখতে। কিন্তু কোনো সুরাহা হয়নি। নর্দার্ন পাওয়ার লিমিটেডের ব্যবস্থাপক জামিল আক্তার খান বলেন, বিদ্যুৎ উৎপাদনের মূল জ্বালানি ফার্নেস অয়েল। পিডিবির ন্যাশনাল লোড ডেসপ্যাচ সেন্টারের নির্দেশনা পেলেই আমরা উৎপাদনে যাই। আমাদের উৎপাদিত বিদ্যুৎ ন্যাশনাল গ্রিডে যুক্ত হয়। অনেক সময় জ্বালানি না পেলে নির্দেশনা আসার পরও উৎপাদনে যেতে পারি না।