সরকার পতনের একদফা দাবিতে মঙ্গলবার তৃতীয়বারের মতো রোডমার্চ করল বিএনপি। টানা কর্মসূচির অংশ হিসাবে এদিন ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনাল থেকে রোডমার্চ শুরু করে দলটি। মাগুরা ও যশোর হয়ে দীর্ঘ ১৬০ কিলোমিটার পথ অতিক্রম করে খুলনা গিয়ে তা শেষ হয়। এতে বিপুলসংখ্যক নেতাকর্মী অংশ নেন। রোডমার্চ শুরুর আগে এক সমাবেশে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেন, ‘দেশ স্বাধীন করেছি গণতন্ত্র, বাকস্বাধীনতা ও অর্থনৈতিক মুক্তির জন্য। কোনো রাজা-রানির রাজত্ব করার জন্য নয়। দেশে আজ কর্তৃত্ববাদী ফ্যাসিবাদী শাসন কায়েম করা হয়েছে। দেশ আজ হীরক রাজার দেশে পরিণত হয়েছে। এভাবে আর চলতে দেওয়া যায় না। এখন দড়ি ধরে টান মারার সময় এসে গেছে।’ ভাইস চেয়ারম্যান
বরকতউ ল্লা বুলু বলেন, ‘সরকারের নির্দেশে ৪০ লাখ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা দেওয়া হয়েছে। হাজার হাজার নেতাকর্মী কারাবরণ করছে, খুন-গুম করা হয়েছে, কিন্তু রাজপথ ছাড়িনি। সরকার পতন ছাড়া আমরা রাজপথ ছাড়ব না। আওয়ামী লীগ কখনো মানুষের অর্থনৈতিক মুক্তি দিতে পারেনি। তারা লুটপাটের রাজনীতি করেছে। ৩০ অক্টোবরের মধ্যে সরকারের পতন হবে। দেশের মানুষ বিজয় মিছিল করবে।’
ঝিনাইদহ প্রতিনিধি জানান, বেলা পৌনে ১২টার দিকে ঝিনাইদহ কেন্দ্রীয় বাস টার্মিনালে খুলনা অভিমুখে রোডমার্চের উদ্বোধনী সমাবেশে নেতাকর্মীদের উদ্দেশে মির্জা আব্বাস আরও বলেন, ‘আপনারা উদ্দীপ্ত হন, সম্মিলিত হন। আমরা দড়ি ধরে টান মারব। এই হীরক রাজা আর থাকবে না।’ বিএনপির চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সঙ্গে কিছুদিন আগে দেখা করেছেন জানিয়ে তিনি বলেন, ‘উনাকে জিজ্ঞাসা করেছিলাম, ম্যাডাম কিছু বলবেন? উনি মাথা নাড়লেন, কিন্তু কোনো কথা বললেন না। আমি তার চোখের দিকে তাকালাম। তার চাহনিতে অব্যক্ত ভাষা। তিনি হয়তো এটাই বলতে চেয়েছিলেন, তোমরা আমার জন্য কী করছ? আমি কি দেশের গণতন্ত্র, দেশের মানুষ ও রাষ্ট্রের জন্য কিছুই করিনি?’
ভাইস চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু বলেন, জালিম সরকারকে যতক্ষণ বিদায় না করতে পারব ততক্ষণ রাজপথ ছাড়ব না। আরেক ভাইস চেয়ারম্যান অ্যাডভোকেট নিতাই রায় চৌধুরী বলেন, দৃঢ়কণ্ঠে বলতে চাই খুব অল্প সময়ের মধ্যে এই সরকারের পতন হবে। ঝিনাইদহ জেলা বিএনপির সভাপতি অ্যাডভোকেট এমএ মজিদের সভাপতিত্বে ও সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনার সঞ্চালনায় আরও বক্তব্য দেন-বিএনপির ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দীন, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান, সহসাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু, বিএনপি নেতা আমিরুজ্জামন খান শিমুলসহ ঝিনাইদহ, কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা জেলার নেতারা।
পরে ঝিনাইদহ থেকে বাস, মাইক্রোবাস, পিকআপ, মোটরসাইকেলের বিশাল বহর নিয়ে খুলনা অভিমুখে রোডমার্চ শুরু হয়। পথিমধ্যে মাগুরা ও যশোরে কয়েকটি সমাবেশ করে। রাত ৯টার দিকে খুলনায় পৌঁছায় রোডমার্চ বহর। কর্মসূচি চলাকালে কখনো হাত নেড়ে, কখনো গাড়ি থামিয়ে রাস্তার দুপাশে নেতাকর্মী ও সাধারণ মানুষ সঙ্গে হাত মেলাতে দেখা যায় মির্জা আব্বাসকে। রোডমার্চে অংশ নেওয়া বেশিরভাগ নেতাকর্মীদের হাতে ছিল জাতীয় কিংবা দলীয় পতাকা।
মাগুরা প্রতিনিধি জানান, মির্জা আব্বাসের নেতৃত্বে ঝিনাইদহ থেকে রোডমার্চটি মাগুরায় প্রবেশ করে দুপুর সোয়া ১২টার দিকে। মাগুরার প্রবেশমুখে আলমখালি এলাকায় জেলা বিএনপি ও অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা রোডমার্চে অংশ নেওয়া নেতাদের স্বাগত জানান। পরে পথে মাগুরা সদর উপজেলার শেখপাড়া এবং শালিখা উপজেলার আড়পাড়া বাজার এলাকায় জেলা বিএনপি সভাপতি আলি আহমেদের সভাপতিত্বে পৃথক পথসভায় বক্তব্য দেন কেন্দ্রীয় নেতারা।
যশোর ব্যুরো জানায়, মাগুরা হয়ে বিকালে যশোর শহরের মুড়লী মোড়ে পথসভা হয়। এতে মির্জা আব্বাস বলেন, ‘বারবার শান্তিপূর্ণভাবে দাবিগুলো তুলে ধরেছি। ২০১৪ ও ২০১৮ সালের নির্বাচনে দেশের মানুষ ভোট দিতে পারেনি। আওয়ামী লীগ জনগণের সঙ্গে প্রতারণা করেছে। শুধু বিএনপি নয়, দেশের সব রাজনৈতিক দল বলেছে, এই সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচন নয়।’
শামসুজ্জামান দুদু বলেন, ‘সরকারের সময় শেষ। পালানোর সময় পাবে না। ভালোয় ভালোয় দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে মুক্তি দিন। তা না হলে জেলখানা ভেঙে বাংলার মানুষ বাংলার নেত্রীকে মুক্ত করবে।’
পথসভায় বক্তব্য দেন-বিএনপি চেয়ারম্যানের উপদেষ্টা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, জেলা বিএনপির সৈয়দ সাবেরুল হক সাবু, মিজানুর রহমান খানসহ কেন্দ্রীয় নেতারা।
যশোর মুড়লী মোড়ে সমাবেশ শুরুর পর উপস্থিত নেতাকর্মীদের নজর কাড়ে খালেদা জিয়ার প্রতীকী কারাগার। এর ভেতর থেকে একটি শিশু খালেদা জিয়া সেজে সবাইকে হাত নেড়ে শুভেচ্ছা জানাচ্ছিল। একটি পিকআপের উপরে প্রতীকী কারাগারের বাইরে নেতাকর্মীরা খালেদা জিয়ার মুক্তির দাবিতে স্লোগান দেন। এ সময় উৎসুক নেতাকর্মীদের তার সঙ্গে সেলফি ও ছবি তুলতে দেখা যায়।
খুলনা ব্যুরো জানায়, মঙ্গলবার খুলনায় রোডমার্চের পর সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তব্যে মির্জা আব্বাস বলেছেন, আগামী সংসদ নির্বাচনে তত্ত্বাবধায়ক সরকার প্রশ্নে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। নির্বাচন করতে হলে সঠিক নিরাপদ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে হবে। জনগণ ভোটাধিকার ফেরত চায়। স্যাংশনের পর আওয়ামী লীগের মাথা খারাপ হয়ে গেছে। আমেরিকা থেকে ৫ অক্টোবর ফেরত আসার কথা। এত তাড়াতাড়ি কেন ফেরত এলেন। এখনো সময় আছে জনগণের কাছে হাতজোড় করে ক্ষমা চান, দেশের মানুষ ক্ষমা করে দেবে। ৪৮ ঘণ্টার সময় দিয়েছেন আমাদের মহাসচিব। এ সময়ের মধ্যে খালেদা জিয়াকে চিকিৎসার জন্য বিদেশ না পাঠালে ভয়াবহ অবস্থা হবে।
মির্জা আব্বাস বলেন, সজীব ওয়াজেদ জয়ের যে সম্পদ বাজেয়াপ্ত হয়েছে তা তার নয়, ওই সম্পত্তি আমাদের। সে এমন কিছু করে না যে এত সম্পদ তৈরি করতে পারবে। এ সরকারের পতন হয়ে গেছে। আওয়ামী লীগ সরকার পারে শুধু মানুষ হত্যা করতে, কিছু লোককে গ্রেফতার করতে। আদালতে শুধু বিএনপি নেতাকর্মীদের নামে মামলা। অন্য কোনো মামলা নেই। সারা বছর বিএনপি নেতাকর্মীদের আদালতে হাজিরা দিতে হয়। তিনি বলেন, এ সরকারের আমলে ১ লাখ ৯ হাজার বিলিয়ন ডলার পাচার হয়েছে। ৮ হাজার কোটি টাকা বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে হারিয়ে গেছে। ব্যাংকে সোনা রাখলে সেটা তামা হয়ে যায়। সরকারের পদত্যাগ ও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে রোডমার্চ শেষে খুলনায় বিএনপির সমাবেশ শুরু হয় সন্ধ্যা ৭টা ৪২ মিনিটে। নগরীর শিববাড়ী মোড়ে অনুষ্ঠিত এ সমাবেশে কেন্দ্রীয় নেতারা যোগদান করেন রাত ৯টায়। এদিন দুপুর থেকে সমাবেশস্থলে জড়ো হতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। বিকাল ৩টার দিকে শুরু হয় জাসাসের সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। সন্ধ্যা সাড়ে ৭টা পর্যন্ত চলে সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। এরপর স্থানীয় নেতারা বক্তব্য দেওয়া শুরু করেন। কেন্দ্রীয় নেতারা মঞ্চে উঠলে শুরু হয় সমাবেশের মূল পর্ব। অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন খুলনা মহানগর বিএনপির আহ্বায়ক অ্যাডভোকেট শফিকুল আলম মনা।
সমাবেশে বিশেষ অতিথির বক্তৃতা করেন দলের স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উ ল্লাহ বুলু, শামসুজ্জামান দুদু, নিতাই রায় চৌধুরী, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা সৈয়দ মেহেদী আহমেদ রুমী, ভারপ্রাপ্ত সাংগঠনিক সম্পাদক (খুলনা বিভাগ) অনিন্দ্য ইসলাম অমিত, তথ্যবিষয়ক সম্পাদক আজিজুল বারী হেলাল, ছাত্রবিষয়ক সম্পাদক রকিবুল ইসলাম বকুল, স্থানীয় সরকারবিষয়ক সম্পাদক অধ্যক্ষ সোহরাব উদ্দিন, মানবাধিকারবিষয়ক সম্পাদক অ্যাডভোকেট আসাদুজ্জামান আসাদ, শিক্ষাবিষয়ক সম্পাদক ড. ওবায়দুল ইসলাম, সহ-সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুন্ডু, সহ-প্রচার সম্পাদক কৃষিবিদ শামীমুর রহমান শামীম, উপকোষাধ্যক্ষ মাহমুদ আলম খান বাবু, সহ-ধর্মবিষয়ক সম্পাদক অমলেন্দু দাস অপু, সহ-তথ্য ও গবেষণাবিষয়ক সম্পাদক আমিরুজ্জামান খান শিমুল, সহ-ত্রাণ ও পুনর্বাসন সম্পাদক নেওয়াজ হালিমা আরলী, সহ-পরিবার ও কল্যাণ সম্পাদক জাহানারা বেগম।
সমাবেশ পরিচালনা করেন মহানগর বিএনপির সদস্য সচিব শফিকুল আলম তুহিন ও জেলা সদস্য সচিব মনিরুল হাসান বাপ্পি। এর আগে রোডমার্চ ও সমাবেশকে ঘিরে খুলনায় ব্যাপক প্রস্তুতি নেয় খুলনা বিএনপি।