সহিংসতার শঙ্কার মধ্যেও অনেকটাই শান্তিপূর্ণভাবে শেষ হয়েছে গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন নির্বাচন। এই নির্বাচন নানা কারণে ৪০ লাখ মানুষের এই নগরীর বাসিন্দা এবং দেশবাসী বহুদিন মনে রাখবে। এর অন্যতম কারণ হচ্ছে-নির্বাচনে একটি ভিন্ন মডেল দেখেছে দেশবাসী। নৌকার ব্যাজ পরে ভোটাররা ভোট দিয়েছেন টেবিল ঘড়ি মার্কায়।
গাজীপুরের নির্বাচনে নিশ্চিত সহিংসতার আশঙ্কা করেছিল নগরবাসী। কিন্তু ভোটের দিন পরিবেশ ছিল অনেকটাই শান্তিপূর্ণ। অন্যান্য নির্বাচনের মতো কেন্দ্র দখল, মারামারি, রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ, ভোটকেন্দ্র নিয়ন্ত্রণে নিয়ে কারচুরি, আগের রাতে ভোটে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের আশঙ্কা ছিল ভোটারদের মধ্যে। কিন্তু তেমনটি চোখে পড়েনি। তবে কেন্দ্রে কেন্দ্রে ক্ষমতাসীন দলের প্রার্থীর কর্মী-সমর্থকদের প্রভাব বিস্তারের নিরন্তর চেষ্টা ছিল। ভোট শেষে রাতে ভোটের ফলাফলে ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের ফাঁকফোকর খোঁজার প্রচেষ্টা ছিল, কিন্তু নেৌকার প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী জায়েদা খাতুনের ছেলে জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক দূরদর্শিতা, দৃঢ়তা, উপস্থিত বুদ্ধি ও জনগণের সজাগ দৃষ্টির কাছে সেই প্রচেষ্টা ব্যর্থ হয়।
ভোটের পরদিন নগরজুড়ে আলোচনা একটাই। কোথাও টেবিল ঘড়ি মার্কার পোস্টার নেই, ব্যানার নেই, কর্মীরা প্রকাশ্যে নেই, কেন্দ্রে এজেন্ট পর্যন্তও নেই, কিন্তু ভোটের অভাব নেই। সঠিক ভোট গণনা হলে জায়েদা খাতুন আরও অনেক ভোটের ব্যবধানে জিততেন বলে মনে করছেন জাহাঙ্গীর আলম সমর্থকরা।
নগরবাসী বলছেন, জাহাঙ্গীর আলম উন্নয়নের সঙ্গে ভোটাররা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। তারা বুঝিয়ে দিয়েছেন, উপর থেকে চাপিয়ে দিয়ে কোনো কিছু হয় না। জনগণের পালস বুঝে প্রার্থী মনোনয়ন না দিলে ফল এমনই হয়।
অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, গাজীপুর সিটির ভোটাররা দলীয় রাজনীতির চেয়ে উন্নয়নকেই বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। গত নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হওয়ার পর আড়াই বছরে জাহাঙ্গীর আলম রাস্তাঘাট ও অবকাঠামোর যে উন্নয়ন করেছেন, পরিকল্পিত নগরী গড়ার যে স্বপ্ন ভোটারদের সামনে তুলে ধরেছিলেন সেটি ছিল এই অঞ্চলের মানুষের কাছে অভাবনীয়। পরবর্তীতে জাহাঙ্গীরকে বরখাস্ত করার পর সেই উন্নয়ন একেবারেই থেমে যায়। ভারপ্রাপ্ত মেয়র কাজের যথেষ্ট সুযোগ থাকা সত্ত্বেও নগরবাসীর কাঙ্ক্ষিত উন্নয়ন দিতে পারেননি। যে কারণে জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক ভুল সিদ্ধান্ত ও বক্তব্যের বিষয়টি নগরবাসীর কাছে গেৌন হয়ে যায়। দীর্ঘদিন ধরে উন্নয়নবঞ্চিত মানুষগুলো ক্ষোভের বহি:প্রকাশ ঘটানোর জন্য ভোটের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু ক্ষমতাসীন দল তাকে মনোনয়ন দেয়নি, স্বতন্ত্র প্রার্থী জাহাঙ্গীরের মনোনয়নপত্রও বাতিল হয়ে যায়। এটি নগরবাসীর ভালোভাবে নেয়নি। পরবর্তীতে মায়ের প্রচারে গিয়ে বারবার হামলার শিকার হয়েছেন জাহাঙ্গীর। যেটি ভোটারদের সহানুভূতি আদায়ে আরও নিয়ামক ভূমিকা রাখে।
জায়েদা খাতুন ভোটের ফল ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার গভীর রাতে সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, তার ছেলের প্রতি যে অন্যায়, অবিচার ও নির্যাতন হয়েছে ভোটাররা ব্যালটে তার জবাব দিয়েছেন। এই অঞ্চলের ভোটাররা বর্ষীয়ান ও আপাদমস্তক এই গৃহিনীকে ভোট দেয়নি, ভোট দিয়েছে তার ছায়াসঙ্গী ছেলে জাহাঙ্গীরকেই।
গাজীপুরের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ও বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে যেটি বোঝা গেছে সেটি হচ্ছে—মোটাদাগে ৭টি কারণে জায়েদা খাতুনের কাছে নৌকার প্রার্থী আজমত উল্লা খানের পরাজয় হয়েছে।
প্রথমত: জাহাঙ্গীরকে গাজীপুরের রাজনীতি থেকে নির্মূল করার চেষ্টা। প্রতীক পাওয়ার আগে ও পরে যেখানেই গেছেন সেখানেই বাধার মুখে পড়েছেন জাহাঙ্গীর আলম। ক্ষমতাসীন দলের অতি উৎসাহী নেতাকর্মীরা বিভিন্ন সময়ে তার গাড়িবহরে হামলা চালিয়েছে। যেটি ভোটের রাজনীতিতে জাহাঙ্গীরের পক্ষে গেছে।
জাহাঙ্গীর আলমের বহু কর্মী-সমর্থকও অন্যায়ের শিকার হয়েছেন। অনেককে দল থেকে বহিষ্কার করা হয়েছে। অনেকে নিজ দলের কর্মীদের হামলার শিকার হয়েছেন। প্রশাসনের লোকজন অনেকের বাড়িতে বাড়িতেও অভিযান চালিয়ে হয়রানি করেছে। জাহাঙ্গীর ও তার কর্মী সমর্থকদের রাজনীতি থেকে নির্মূল করার চেষ্টা ব্যালটে জবাব দিয়েছেন ভোটাররা।
দ্বিতীয়ত: রাজনীতির চেয়ে উন্নয়নে আস্থা। নগরবাসী গত কয়েক বছর ধরে দেখেছে জাহাঙ্গীরের প্রতিপক্ষরা উন্নয়নের চেয়ে রাজনীতিকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছেন। রাজনীতির মূল উদ্দেশ্য যে, সেবা ও উন্নয়ন সেটি তারা ভুলে গেছেন। জাহাঙ্গীর মেয়র হওয়ার পর রাত বিরাত ঝড় বৃষ্টি উপেক্ষা করে উন্নয়ন প্রকল্পে ছুটে গেছেন; যেগুলো ভোটাররা ভুলতে পারেননি। এ কারণে নগরবাসী উন্নয়নের ব্যক্তিকে আবারও বেছে নিয়েছেন। বাহ্যত জায়েদা খাতুন নির্বাচিত হলেও গাজীপুর সিটি কর্পোরেশন যে আগামী দিনে চলবে তার ছেলের পরিকল্পনায় সেটি নগরবাসী বুঝেছে।
তৃতীয়ত: ভুল প্রার্থী বাছাই। ভোটাররা মনে করে, আওয়ামী লীগ প্রার্থী বাছাইয়ে ভুল করেছে। জাহাঙ্গীর আলমের রাজনৈতিক পরিপক্কতার ঘাটতি থাকলেও উন্নয়নের জন্য তার বিকল্প নেই। এ কারণে দলীয় নেতাকর্মীরা মনে করে, আওয়ামী লীগের উচিত ছিল এবারও জাহাঙ্গীর আলমকে মনোনয়ন দেওয়া।
অপরদিকে নেৌকার মনোনয়ন পাওয়া আজমত উল্লাহ খান রাজনৈতিকভাবে পরীক্ষিত ও পোড় খাওয়া হলেও ভোটের রাজনীতিতে তিনি অনেকটাই বেমানান। বিশেষ করে বর্তমানে সাধারণ মানুষের সঙ্গে তার যোগাযোগ ও মিথস্ক্রিয়া কম। নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি হিসেবে প্রতিটি ওয়ার্ডে আজমতের যে বিচরণ ও যোগাযোগ থাকার কথা সেটি ছিল না। এ কারণে ভোটারদের সঙ্গে তার একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে ছিল আগে থেকেই। আজমতের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার চেয়ে উন্নয়নকর্মী জাহাঙ্গীরকেই ভোটাররা বেছে নিয়েছে।
চতুর্থত: আওয়ামী লীগে বিভক্তি। গাজীপুরে আওয়ামী লীগে বিভক্তি এখন চরমে। এখানে বিভিন্ন উপদলে বিভক্ত নেতাকর্মীরা। মহানগর ও জেলায় দলের চেয়ে মন্ত্রী ও এমপি কেন্দ্রিক ব্যক্তির রাজনীতিই বেশি গুরুত্ব পাচ্ছে। এ কারণে রাজনৈতিক দলাদলি বাড়ছে। নিজ দলেই কোনঠাসা হয়ে পড়েছেন বহু পোড় খাওয়া নেতা। প্রতিপক্ষের দাপটে আওয়ামী লীগ করেও দলীয় স্বীকৃতি পাচ্ছেন না বহু নেতা।
এখানকার মন্ত্রী-এমপিরা নিজেদের রাজনীতি নিয়ে ব্যস্ত; উন্নয়ন তাদের কাছে গেৌন হয়ে পড়েছে। অনেক নেতা বহু বছর ধরে এমপি কিন্তু এলাকায় কাজ করেননি। এর বিপরীতে জাহাঙ্গীর আলম উন্নয়নকে গুরুত্ব দিয়ে চলছিলেন। জাহাঙ্গীরের উন্নয়ন ওই সব নেতাদের ভূমিকাকে প্রশ্নের মুখে ফেলে দিচ্ছিল। যে কারণে জাহাঙ্গীরের সঙ্গে বিরোধ সৃষ্টি হয় তাদের।
এবারের নির্বাচনে প্রায় সব সংসদীয় আসনের নেতা জাহাঙ্গীর আলমের বিরোধীতা করেও তাকে জনবিচ্ছিন্ন করতে পারেননি। তাকে ভোটের মাঠে আটকে রাখতে পারেননি।
পঞ্চমত: বিএনপি ও তাদের রাজনৈতিক সঙ্গীরা সিটি নির্বাচন বর্জন করেছে। বিএনপি পরিবারের সদস্য সরকার শাহনূর ইসলাম স্বতন্ত্র প্রার্থী হলেও জনগণের আস্থা অতটা অর্জন করতে পারেননি। এ কারণে বিএনপি ও তাদের শরিকদের ভোটও জায়েদা খাতুনের পক্ষে গেছে। এছাড়া জাহাঙ্গীর আলম মেয়র থাকা অবস্থায় বিএনপিসহ সব দল-মতের মানুষের সঙ্গে যোগাযোগ রেখেছেন। বিরোধী দলের কেউ সামাজিক অনুষ্ঠানে দাওয়াত করলে অংশ নিতেন, কেউ মারা গেলে জানাজায় ছুটে যেতেন—তার এসব কর্মকাণ্ড ভোটের মাঠে জায়েদা খাতুনকে এগিয়ে রেখেছে।
ষষ্ঠত: আজমত বনাম জাহাঙ্গীর। এটি সবার কাছে স্পষ্ট যে, গাজীপুরে দলীয় নেতা কিংবা ব্যক্তি হিসেবেও আজমত উল্লা খানের চেয়ে জাহাঙ্গীর আলমের ভোট বেশি। নানা ঘটনায় এটি বোঝা যায় যে তার জনসম্পৃক্ততাও বেশি। বিশেষ করে গাজীপুর শিল্পাঞ্চল হওয়ায় এবং জাহাঙ্গীর আলম নিজেও একজন গার্মেন্ট রিলেটেড ব্যবসায়ী বলে পোশাক শ্রমিকদের অধিকাংশই তাকে ভোট দেন। এটি গাজীপুরের একটি বিরাট ভোট ব্যাংক। ২০১৩ সালের গাজীপুর সিটি নির্বাচনেও যখন আওয়ামী লীগের প্রার্থী আজমত উল্লা খান বিএনপির প্রার্থী এম এ মান্নানের কাছে হেরে গিয়েছিলেন, সেখানেও জাহাঙ্গীর আলম ফ্যাক্টর হিসেবে কাজ করেছেন। ওই নির্বাচনে জাহাঙ্গীর আলম স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে অংশ নেন এবং ভোটগ্রহণের বেশ কয়েকদিন আগে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ানোর পরেও প্রায় ৩০ হাজার ভোট পান। তার মানে ভোঠের মাঠে থাকলে হয়তো তিনি ওই নির্বাচনেও জয়ী হতেন। এরপর ২০১৮ সালের সিটি নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন পেয়ে বিপুল ভোটে গাজীপুরের মেয়র নির্বাচিত হন জাহাঙ্গীর।
সপ্তমত: জাহাঙ্গীরের ব্যক্তিগত ক্যারিশমাই ভোটের মাঠে জায়েদাকে বিজয়ী করেছে। দুদফা বহিষ্কার থেকে মনোনয়ন বঞ্চনা সবগুলো ঘটনা বিশ্লেষণ করে ভোটাররা মনে করেছেন, জাহাঙ্গীরের প্রতি অবিচার হয়েছে। তিনি যতটা না ভুল করেছেন তার চেয়ে বেশি স্থানীয় প্রভাবশালীদের আক্রোশের শিকার হয়েছেন। তাকে দমিয়ে রাখতে স্থানীয় আওয়ামী লীগের এমপি-মন্ত্রীরা একজোট ছিলেন। এসবই তার প্রতি ভোটারদের সহানুভূতি এনে দেয়।
এছাড়া জাহাঙ্গীর নির্বাচনে রাজনৈতিক দূরদর্শিতার পরিচয় দিয়েছেন সবক্ষেত্রে। মনোনয়নপত্র বাতিল হয়ে যেতে পারে এমন আশঙ্কা করে মা জায়েদা খাতুনকে প্রথমে ডামি প্রার্থী করেন। জাহাঙ্গীর ভোটারদের পালস ঠিকই ধরতে পেরেছিলেন। তার উন্নয়ন যে ভোটাররা মনে রাখবে সেটি উপলব্ধি করেছিলেন বলেই মাকে ছায়াপ্রার্থী করেন। যে পরিকল্পনা তাকে সফলতা এনে দেয়।