ব্যাংকিং খাতে শৃঙ্খলা রক্ষায় আইএমএফ ও বিশ্বব্যাংক খেলাপি ঋণের ক্ষেত্রে বিশেষ ছাড় দেওয়ার নীতি থেকে সরে আসার সুপারিশ করেছে। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধের ক্ষেত্রে শিথিলতা থেকেও সরে আসার প্রস্তাব দিয়েছে। এসব খাতে অব্যাহত ছাড় দিলে একটি পর্যায়ে ঋণ পরিশোধের সক্ষমতা হারাবে উদ্যোক্তারা।
আর ব্যাংকে তারল্য কমে যাবে। এতে ব্যাংকগুলো ক্রমেই দুর্বল হয়ে পড়বে। আর্থিক সংকটে পড়ে কোনো কোনো দুর্বল ব্যাংক আমানতকারীদের টাকা পরিশোধেও ব্যর্থ হতে পারে।
সম্প্রতি আন্তর্জাতিক অর্থ তহবিল (ইন্টারন্যাশনাল মনিটারি ফান্ড বা আইএমএফ) ও বিশ্বব্যাংক পৃথক প্রতিবেদনে এসব কথা বলেছে। বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত দক্ষিণ এশিয়া বিষয়ক প্রতিবেদন এবং গত জুলাইয়ে বাংলাদেশে সফরে আসা আইএমএফের প্রতিনিধি দল দেশের অর্থনৈতিক পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে যে প্রতিবেদন পাঠিয়েছে তা থেকে এসব তথ্য পাওয়া গেছে।
এদিকে আইএমএফ মিশনের একটি অংশ আগামী ২৭ অক্টোবর রাতে ঢাকায় আসছে। মিশনের বাকি সদস্যরা ২৯ অক্টোবরের মধ্যে আসবেন। তারা ৩০ অক্টোবর থেকে বৈশ্বিক মন্দা মোকাবিলায় সরকারকে ঋণ দেওয়ার ব্যাপারে আনুষ্ঠানিক আলোচনা শুরু করবে। এ আলোচনা চলবে আগামী ৮ নভেম্বর পর্যন্ত। ৯ নভেম্বর মিশনের ঢাকা ত্যাগের কথা রয়েছে। ওই সময়ে মিশনটি অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পদ বিভাগ, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ ব্যাংক ও জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) সঙ্গে আলোচনা করবে। এবারে তাদের আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে-ভর্তুকি কমানো, রাজস্ব খাত সংস্কার, ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠা, খেলাপি ঋণের নীতিতে পরিবর্তন, মুদ্রার বিনিময় হার বাজারের ওপর ছেড়ে দেওয়া।
ইতোমধ্যে সরকার আইএমএফের ঋণ পেতে বড় একটি শর্ত পালন করেছে। সেটি হচ্ছে জ্বালানি তেল ও সারের দাম বাড়িয়ে ভর্তুকি কিছুটা কমিয়েছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংক বৈদেশিক মুদ্রার বিনিময় হার আংশিকভাবে হলেও বাজারের ওপর ছেড়ে দিয়েছে। বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ নিয়ে দুই ধরনের হিসাব তৈরি করছে। সাধারণ বা গ্রস ও প্রকৃত বা নিট হিসাব।
এর মধ্যে গ্রস রিজার্ভের হিসাব প্রকাশ করছে। কিন্তু নিট হিসাব প্রকাশ করছে না। তবে খেলাপি ঋণ নীতিতে পরিবর্তন ও ঋণ পরিশোধে ছাড়ের বিষয়ে নতুন কোনো সিন্ধান্ত নেয়নি কেন্দ্রীয় ব্যাংক। কেন্দ্রীয় ব্যাংক নীতি সুদের হার চলতি বছরে তিন দফা বাড়ালেও বাজারে ঋণের সুদের হার বাড়ায়নি। আইএমএফ ঋণের সুদের হারের সীমা তুলে নেওয়ার সুপারিশ করেছিল। কেন্দ্রীয় ব্যাংক ঋণের সর্বোচ্চ সীমা ৯ শতাংশ ও আমানতের সীমা ৬ শতাংশ বেঁধে দিয়েছে। ব্যাংকগুলোও এ সীমা তুলে দেওয়ার দাবি করেছে।
বৈশ্বিক পরিস্থিতি মোকাবিলায় আইএমএফের কাছে ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়েছে। এ বিষয়ে প্রাথমিক আলেঅচনা করতে গত ১২ জুলাই আইএমএফের একটি মিশন ঢাকায় আসে। তারা ২২ জুলাই ঢাকা ত্যাগ করে। ওই সময়ে তারা অর্থ মন্ত্রণালয়, অর্থনৈতিক সম্পর্ক বিভাগ, বাংলাদেশ ব্যাংক ও এনবিআরের সঙ্গে বৈঠক করে। ওই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে আইএমএফ একটি প্রতিবেদন পাঠিয়েছে ঢাকায়। ওই প্রতিবেদনে ব্যাংকিং খাতে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় খেলাপি ঋণের নীতিতে পরিবর্তন আনার কথা বলা হয়েছে। আন্তর্জাতিক মান অনুয়ায়ী কোনো ঋণের কিস্তি পরিশোধের শেষ দিন থেকে তিন মাস অতিক্রম হলেই তাকে খেলাপি হিসাবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটি ছয় মাস করা হয়েছে। এতে খেলাপি ঋণ কম হচ্ছে। খেলাপিদের ছাড় দেওয়া হচ্ছে, যা ব্যাংকিং খাতের জন্য স্বস্তিদায়ক নয়। একই সঙ্গে ঋণ পরিশোধেও ছাড়ও দেওয়া হচ্ছে। এতে ব্যাংকগুলোতে তারল্য সংকট দেখা দিতে পারে। যা ব্যাংকগুলোকে দুর্বল করে দিতে পারে বলে তারা আশঙ্কা প্রকাশ করেছে।
এদিকে বিশ্বব্যাংকের সম্প্রতি প্রকাশিত এশিয়া বিষয়ক প্রতিবেদনে বাংলাদেশের ব্যাংকিং খাতে নিয়েও একই ধরনের মন্তব্য করা হয়েছে। এতে তারা বলেছে, ব্যাংকের ঋণ পরিশোধে গ্রাহকের অব্যাহতভাবে ছাড় দেওয়া হলে ব্যাংকর সম্পদের বা ঋণের মান কমে যাবে। গ্রাহকরা ঋণ পরিশোধের অনাগ্রহী হয়ে উঠবেন। এতে কোন কোন ব্যাংকের আর্থিক অবস্থা অতিমাত্রায় দুর্বল হয়ে যেতে পারে। আর্থিক খাতে সম্পদের মানে বড় ধরনের সমস্যা দেখা দিতে পারে, যা আর্থিক খাতকে বড় দুর্বলতার দিকে নিয়ে যাবে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, বৈশ্বিক ও অভ্যন্তরীণ পরিস্থিতিতে বাংলাদেশ, ভারত, পাকিস্তানে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। এ কারণে বাংলাদেশে আর্থিক খাতে ঝুঁকিপূর্ণ সম্পদের পরিমাণ বেড়ে গেছে, যা আর্থিক খাতকে ঝুঁকিতে ফেলেছে। এছাড়া ঋণ আদায় কিছু খাতে স্থগিত থাকায়ও খেলাপি ঋণ বাড়ছে। খেলাপি ঋণের প্রকৃত তথ্য প্রকাশ পাচ্ছে না। অনেক তথ্য আড়ালে থেকে যাচ্ছে। বিশেষ বিবেচনায় পুনর্গঠন করা ঋণও এখন খেলাপি হয়ে পড়েছে, যা উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
সূত্র জানায়, করোনার পর ২০২০ সাল থেকে ঋণ পরিশোধে ছাড় দেওয়া হচ্ছে। ২০২১ সাল পর্যন্ত ছাড় দেওয়া হয়। ২০২১ সালের ফেব্রুয়ারি থেকে রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধ শুরু হলে বৈশ্বিক মন্দা আরও প্রকট হয়। ফলে উদ্যোক্তাদের দাবির মুখে ঋণ পরিশোধে বিভিন্ন খাতে ছাড় দেওয়া হয়, যা আগামী ৩১ ডিসেম্বর পর্যন্ত বহাল থাকবে। ফলে তিন বছর ব্যাংকগুলো গ্রাহকদের কাছ থেকে ঋণ আদায় করতে পারছে না। গ্রাহকদের মধ্যে ঋণ পরিশোধে চাপ না থাকার কারণে গ্রাহকও অনেকটা শিথিলতা দেখা পারেন, যা পরবর্তী ঋণ পরিশোধে গ্রাহকদের সক্ষমতা কমিয়ে দিতে পারে।
এদিকে ব্যাংক ও নন-ব্যাংকিং আর্থিক খাতে খেলাপি ঋণ বেড়েছে। গত জুন পর্যন্ত ব্যাংকে খেলাপি ঋণ ১ লাখ ২৫ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে গেছে। এর মধ্যে আদায় অযোগ্য ঋণ ৮৯ শতাংশ। নন-ব্যাংকিং আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে খেলাপি ঋণ ১৬ হাজার কোটি টাকা।