আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) হিসাব পদ্ধতি অনুসরণ করে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের হিসাব করতে যাচ্ছে বাংলাদেশ ব্যাংক। এ বিষয়ে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আইএমএফের প্রতিনিধি দল নীতিগতভাবে একমত হয়েছে। ঋণ পেতে হলে আইএমএফের পরামর্শ অনুযায়ী রিজার্ভের হিসাব করতে হচ্ছে বলে বাংলাদেশ ব্যাংক সূত্র জানিয়েছে। বিভিন্ন খাতে ব্যবহার করা রিজার্ভের অর্থ বাদ দিলে (রিজার্ভ) প্রায় সাড়ে ৮ বিলিয়ন ডলার কমে যাবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি সূত্র জানিয়েছে, ডলার সংকটের কারণে এই মুহূর্তে আইএমএফের ঋণ বাংলাদেশের জন্য খুবই প্রয়োজন। আইএমএফ যে হিসাব পদ্ধতি বলছে সেটিও ঠিক আছে। ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের হিসেব মতোই রিজার্ভের হিসাব করা হবে। তবে বর্তমান প্রেক্ষাপটে রিজার্ভের বিষয়টি খুবই স্পর্শকাতর বলে আইএমএফের পদ্ধতিতে রিজার্ভ গণনা শুরু হতে একটু সময় লাগবে। তবে বিষয়টি স্পর্শকাতর হওয়ায় সরকারের উচ্চপর্যায়ে আলোচনা করে কবে নাগাদ শুরু করা হবে, তা সিদ্ধান্ত হবে। আইএমএফের পদ্ধতি অনুসরণের পাশাপাশি শুরুতে বিদ্যমান পদ্ধতির হিসাবও প্রকাশ করা হবে।
আইএমএফ দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছে, রিজার্ভ থেকে অর্থ নিয়ে আলাদাভাবে বিভিন্ন তহবিল গঠন ও সেখান থেকে ঋণ দেওয়া হচ্ছে। আবার ঐ সব অর্থ রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। এতে রিজার্ভ বেশি দেখানো হচ্ছে। যা আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এক ধরনের বিভ্রান্তি তৈরি করছে। এভাবে রিজার্ভের হিসাব দেখানো ঠিক হচ্ছে না। আইএমএফ মনে করে এতে দেশের প্রকৃত রিজার্ভের চিত্র ফুটে উঠছে না। রিজার্ভের প্রকৃত চিত্র আড়াল করায় বাংলাদেশেরই বরং ঝুঁকি বাড়ছে। আইএমএফের দৃষ্টিতে এই গরমিলে বিদেশি বিনিয়োগকারীদের মধ্যে আস্থার সংকট দেখা দিতে পারে। বাংলাদেশের স্বার্থেই এ হিসাব আন্তর্জাতিকমান অনুযায়ী করা উচিত। তারা আরো বলেছেন, ভারত, পাকিস্তান, শ্রীলঙ্কাসহ আইএমএফের সদস্য সব দেশই আইএমএফের প্রচলিত আন্তর্জাতিকমান মেনে রিজার্ভের হিসাব করে এবং তা প্রকাশ করে। কিন্তু বাংলাদেশ রিজার্ভের হিসাবের ক্ষেত্রে আইএমএফের মানদণ্ড মানছে না। নিজেদের মতো করে হিসাব করে বেশি রিজার্ভ দেখাচ্ছে।
এ বিষয়ে মন্তব্য জানতে চাইলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের সাবেক কর্মকর্তা ও বেসরকারি গবেষণা সংস্থা পিআরআই-এর নির্বাহী পরিচালক ড. আহসান এইচ মনসুর ইত্তেফাককে বলেন, আইএমএফ যে হিসাব পদ্ধতির কথা বলছে তা হচ্ছে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের কথা। আমরা চাইলে আমাদের রিজার্ভের হিসাব যে কোনোভাবে করতে পারি না। রিজার্ভকে আন্তর্জাতিক মাপকাঠিতে আমাদেরকে মাপতে হবে। আমরা এতোদিন সেটি করিনি। এখন আইএমএফ যেভাবে চাচ্ছে সেভাবে করা উটিত। যে জিনিসটি আমার কাছে নেই সেটা ধরে রেখে তো লাভ নেই। তবে সেটি আমার মালিকানায় আছে ঠিকই। কিন্তু এটি প্রকৃত রিজার্ভ নয়। সব সম্পদ রিজার্ভের সম্পদ নয়। এ সংশোধনটি দরকার ছিল। আইএমএফের যেভাবে রিজার্ভের হিসাব চাচ্ছে যেভাবে করে নেওয়া উচিত বলে মনে করেন এই অর্থনীতিবিদ।
তবে এ বিষয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের একজন সাবেক গভর্নর ইত্তেফাককে বলেন, কেন্দ্রীয় ব্যাংক যে পদ্ধতিতে বর্তমানে হিসাব রাখছেন তা ঠিকই আছে। বাংলাদেশ ব্যাংক দুটো হিসাব রাখছে। একটি বাংলাদেশের হিসাব। আরেকটি আইএমএফের হিসাব। একটি গ্রস হিসাব। আরেকটি নিট হিসাব। আইএমএফের হিসাব হচ্ছে নিট হিসাব, মানে নগদ। তিনি উদাহরণ দিয়ে বলেন, ধরা যাক আমার কাছে ২৭ টাকা নগদ আমার পকেটে আছে। কিন্তু আরো ৫ টাকা আমার একটি সঞ্চয়ী হিসেবে আছে। এই সঞ্চয়ী হিসেবের টাকাটা আমি যখন খুশি তখন তুলতে পারব। সেটাও এক ধরনের নগদ টাকা। তিনি বলেন, আমার তো ২৭ বিলিয়ন ডলার কালকেই লাগছে না। বিশেষ করে ইডিএফের যে অংশটি যা ডলারে দেওয়া হয় টাকাটাও ডলারেই নেওয়া হয়। সুতরাং এর মধ্যে কোনো ঝুঁকি নেই।
তবে এ নিয়ে তর্ক করার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করেন তিনি। সারা পৃথিবী একভাবে যাবে আর আমরা আরেকভাবে যাব সেটা ঠিক নয়। সাময়িকভাবে আইএমএফের সিদ্ধান্ত বাংলাদেশ ব্যাংক মেনে নিচ্ছে। আমাদের অবস্থান এবং আইএমএফের অবস্থান সমানভাবে রাখা যায়। তবে চূড়ান্তভাবে আইএমএফের হিসাব পদ্ধতিই মানতে হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নির্বাহী পরিচালক ও মুখপাত্র জি এম আবুল কালাম আজাদ বলেন, আইএমএফের সঙ্গে বৈঠকে রিজার্ভ নিয়ে বেশি আলোচনা হয়েছে। এ নিয়ে যার যার অবস্থান থেকে যুক্তি উপস্থাপন করা হয়েছে। বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষ থেকে তাদের বলা হয়েছে, রিজার্ভের হিসাব বাংলাদেশ দুই ভাবে করছে। গ্রস ও নিট হিসাব। গ্রস হিসাবে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের নিয়ন্ত্রণে থাকা সব বৈদেশিক মুদ্রা রিজার্ভে দেখানো হচ্ছে। নিট হিসাবে বিভিন্ন তহবিলের অর্থ বাদ দেওয়া হচ্ছে।
বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ ব্যাংকের সঙ্গে আইএমএফের সফররত মিশনের বৈঠক হয়। জানা গেছে, রপ্তানি উন্নয়ন তহবিলের (ইডিএফ) সরবরাহ করা ৭ বিলিয়ন ও শ্রীলঙ্কাকে দেওয়া ২০ কোটি ডলার রিজার্ভে দেখাচ্ছে। এছাড়া গ্রিন ট্রান্সফরমেশন ফান্ড (জিটিএফ) ২০ কোটি, লং টার্ম ফিন্যান্সিং ফ্যাসিলিটি (এলটিএফএফ) তহবিলে ৩ কোটি ৮৫ লাখ, সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ বিমানকে ৪ কোটি ৮০ লাখ এবং ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক ট্রেড ফাইন্যান্স করপোরেশনের (আইটিএফসি) আমানত রিজার্ভে দেখাচ্ছে। সবমিলিয়ে বর্তমানে রিজার্ভে যে অর্থ দেখানো হচ্ছে, সেখান থেকে ৮ দশমিক ৪০ বিলিয়ন ডলার বাদ যাবে বলে মনে করে আইএমএফ। আইএমএফের প্রতিনিধি দল বলেছে, এগুলো রিজার্ভে দেখানো যাবে না। গত বুধবার রিজার্ভ ছিল ৩৫ দশমিক ৮৫ বিলিয়ন ডলার বা ৩ হাজার ৫৮৫ কোটি ডলার। আইএমএফের হিসাবে রিজার্ভ কমে হবে ২৭ বিলিয়ন ডলার বা ২ হাজার ৭০০ কোটি ডলারের কিছু বেশি।
উল্লেখ্য, ৪৫০ কোটি ডলার ঋণ চেয়ে গত জুলাইয়ে আইএমএফের কাছে যে চিঠি পাঠিয়েছিল বাংলাদেশ, সে ব্যাপারে আলোচনা করতেই দলটি এখন ঢাকায়। আইএমএফের ১০ সদস্যের প্রতিনিধিদলের নেতৃত্ব দিচ্ছেন সংস্থাটির এশীয় ও প্যাসিফিক বিভাগের প্রধান রাহুল আনন্দ। ৩০ ও ৩১ অক্টোবর এবং আগামী ২ ও ৮ নভেম্বর আবারও কেন্দ্রীয় ব্যাংকের সঙ্গে সভার সূচি রয়েছে।