বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাসের কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সেই বর্বর ঘটনাগুলো যেন দেশবাসী ভুলে না যায় এবং সেই দিন যেন আর ফিরে না আসে। সেজন্য সবাইকে সতর্ক থাকতে হবে।
রোববার জাতীয় জাদুঘর মিলনায়তনে আওয়ামী লীগ আয়োজিত ‘বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘনের খণ্ডচিত্র’ শীর্ষক অনুষ্ঠানে দেওয়া বক্তব্যে তিনি এ কথা বলেন। ২০১৩-১৪-১৫ সালে আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাসে ৫শ মানুষ নিহত হন। আহত হন প্রায় সাড়ে ৩ হাজার জন। আগুন-সন্ত্রাসের শিকার হয়ে স্বামীহারা স্ত্রী, সন্তানহারা পিতা, পিতৃহারা পুত্র-কন্যা, আগুনে ঝলসানো শরীর নিয়ে ভুক্তভোগী, পঙ্গুত্ববরণকারীরা এসেছিলেন এই অনুষ্ঠানে।
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য ও কৃষিমন্ত্রী ড. আব্দুর রাজ্জাক, তথ্য ও সম্প্রচারমন্ত্রী ড. হাছান মাহমুদ, সংস্কৃতি প্রতিমন্ত্রী কেএম খালিদসহ মন্ত্রিপরিষদ সদস্য, আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী, ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন, শাহজাহান খানসহ দলটির সিনিয়র নেতা, সংসদ-সদস্য, এফবিসিসিআই সভাপতিসহ একটি প্রতিনিধিদল এবং বিভিন্ন কূটনৈতিক মিশনের প্রতিনিধি অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন। অনুষ্ঠান সঞ্চালনা করেন সংসদ-সদস্য আসাদুজ্জামান নূর।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘একটা গাড়িতে মানুষ যাচ্ছে। সেখানে আগুন ধরিয়ে মানুষকে হত্যা করা হলো। কীভাবে মানুষ পারে মানুষের এমন ক্ষতি করতে? এটাই নাকি আন্দোলন! এই আন্দোলন তো আমরা কখনো দেখিনি।’ তিনি বলেন, ‘এটা সহ্য করা যায় না। এটা কোনো মানুষ সহ্য করতে পারবে না। কাজেই আমি দেশবাসীকেও বলব এ ব্যাপারে সবাইকে সজাগ থাকতে। ওই দুঃসময়ের কথা যেন কেউ ভুলে না যান।’
তিনি বলেন, ‘আমার শুধু একটাই আহ্বান থাকবে দেশবাসীর কাছে-তারা রাজনীতি করতে চাইলে সুষ্ঠু রাজনীতি করুক, আমার আপত্তি নেই। কিন্তু সাধারণ মানুষের গায়ে কেউ হাত দিলে তাদের রক্ষা নেই।’
আগুন-সন্ত্রাসীদের বিচার প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দায়ীদের বিচার হচ্ছে, হবে এবং মহান আল্লাহর তরফ থেকেই হবে। হয়তো প্রত্যেক কেসের (মামলা) বিচার চলছে না। কিন্তু যারা এ ধরনের অগ্নি-সন্ত্রাসে জড়িত, তাদের বিরুদ্ধে মামলা আছে, অনেকের বিচারের কাজ চলছে, অনেকে শাস্তিও পাচ্ছে এবং ভবিষ্যতেও পাবে।’
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যারা হুকুমদাত্রী বা হুকুমদাতা, তাদের কথাও আপনারা ভেবে দেখেন। যারা এ ধরনের ধ্বংসাত্মক কাজ করতে পারে আর মানুষকে কষ্ট দিতে পারে, আমি জানি না মানুষ কীভাবে আবার এদের পাশে দাঁড়ায়, এদের সমর্থন করে।’
আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, ‘বিএনপি-জামায়াত ২০১৩-১৪-১৫ সালে আওয়ামী লীগ সরকারকে ক্ষমতাচ্যুত করতে আন্দোলনের নামে অগ্নি-সন্ত্রাস করে। বাসে আগুন দিয়ে কীভাবে মানুষ হত্যা করে। এটা কি আন্দোলন? আমরা এটি আগে কখনো দেখিনি। শৈশব থেকেই আন্দোলনের সঙ্গে সম্পৃক্ত। আইয়ুব খান, ইয়াহিয়া খান, জিয়াউর রহমানের মতো সামরিক স্বৈরশাসকের বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছি। কিন্তু আমরা স্বপ্নেও ভাবিনি পেট্রোলবোমা মেরে মানুষ হত্যা করে আন্দোলন করার। কারণ মানুষ দিয়েই তো আন্দোলন।’
কাঁদলেন-কাঁদালেন চাইলেন বিচার : সাধারণত প্রতিটি অনুষ্ঠানে মূল মঞ্চে রাখা হয় প্রধান অতিথি ও অতিথিদের। কিন্তু এ অনুষ্ঠানটি ছিল সম্পূর্ণ ব্যতিক্রম। আন্দোলনের নামে বিএনপি-জামায়াতের পেট্রোলবোমা ও অগ্নিসন্ত্রাসের কারণে ক্ষতিগ্রস্তরাই ছিলেন মূল মঞ্চে। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্য, কূটনীতিক, আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতারা ছিলেন দর্শকসারিতে।
অনুষ্ঠানে বিএনপি-জামায়াতের অগ্নি-সন্ত্রাস, নৈরাজ্য ও মানবাধিকার লঙ্ঘন নিয়ে একটি ডকুমেন্টারি প্রদর্শিত হয়। পরে ভুক্তভোগী ও তাদের পরিবারের সদস্যরা নিজেদের দুঃখ-দুর্দশার কথা বলেন। সেসব ঘটনার বর্ণনা শুনে এবং তাদের কান্না দেখে প্রধানমন্ত্রীসহ অনুষ্ঠানে আগতরা আবেগাপ্লুত হয়ে পড়েন। প্রধানমন্ত্রী অনেককে কাছে টেনে নিয়ে সব রকম সহযোগিতা অব্যাহত রাখার আশ্বাস দেন।
অগ্নি-সন্ত্রাসের শিকার সালাউদ্দিন ভূইয়া সেদিনের স্মৃতি স্মরণ করে বলেন, ‘আমি খুব সুন্দর ছিলাম, যেখানে চাকরির জন্য যেতাম, চাকরি হতো। এখন আমাকে দেখে কেউ কাজ দেয় না। আমার কাজ করার শক্তি আছে; কিন্তু কেউ কাজ দেয় না। আমার পাশে কেউ বসে না। সবাই ভাবে আমি পাগল। আমার মনে অনেক কষ্ট।’ বলতে বলতে কান্নায় ভেঙে পড়েন তিনি।
২০১৩ সালে পেশায় গাড়িচালক রমজান আলীর ছেলে মুনিরকে তার চোখের সামনে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। সন্তানহারা রমজান কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, ‘আমি তো রাজনীতি করি না। আমি তো খেটে খাওয়া মানুষ। আমার চোখের সামনে আমার ছেলেকে আগুনে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে ছারখার করে দিল। সন্তানকে বাঁচাতে পারলাম না। এর চেয়ে এত কষ্ট পৃথিবীতে আর নেই।’ এ সময় দর্শক আসনে বসে থাকা প্রধানমন্ত্রীকেও কাঁদতে দেখা যায়।
২০১৩ সালে মাদারীপুর থেকে ঢাকা আসার পথে আগুনে পুড়ে মারা যায় ১৭ বছরের কিশোর নাহিদ। তার মা রুনি বেগমও যোগ দিয়েছিলেন অনুষ্ঠানে। তিনি বলেন, ‘আমার সন্তানকে দেখতে পারিনি, দেখার সুযোগ পাইনি বিএনপি-জামায়াতের কারণে।’ সন্তানহারা এই মা আর্তনাদ করে বলেন, ‘সন্তান হত্যার বিচার পাইনি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী। আমার সন্তান হত্যার বিচার আপনি করবেন।’
রাজনৈতিক সহিংসতা মোকাবিলায় কাঁচপুরে দায়িত্ব পালন করছিলেন বিজিবির সুবেদার নায়ক শাহ আলম। তার স্ত্রী নাসরিন আক্তার আলেয়া বলেন, যতদিন বেঁচে থাকব, এই যন্ত্রণা কখনো ভুলতে পারব না। প্রধানমন্ত্রীর উদ্দেশে স্বামীহারা এই নারী বলেন, ‘আমার স্বামী তো রাজনীতি করেনি। তার তো কোনো অপরাধ ছিল না। সে তো দেশের কাজে নিয়োজিত। তাকে কেন এভাবে হত্যা করা হলো?’
ট্রাক ড্রাইভার রফিকুল ইসলাম ঢাকা থেকে মালামাল নিয়ে ঠাকুরগাঁও যাওয়ার পথে দিনাজপুরের কাহারুল থানার ভাদগাঁওয়ে পেট্রোলবোমার শিকার হন। পুড়ে যায় তার শরীর। মৃত্যুগহ্বর থেকে বেঁচে ফিরলেও সারা শরীরে বয়ে বেড়াচ্ছেন সেই ক্ষত। সেদিনের ঘটনার বর্ণনা দিতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রফিকুল। তিনি বলেন, ‘মাননীয় প্রধানমন্ত্রী, আমি এর কঠিন থেকে কঠিনতর বিচার চাই।’
২০১৩ সালের ৩১ মার্চ রাজশাহীর বোয়ালিয়ার সাহেববাজারে পেশাগত দায়িত্ব পালনের সময় বোমায় সাব-ইনস্পেকটর মকবুল হোসেনের দুটি হাত উড়ে যায়। সারা শরীর ক্ষতবিক্ষত হয়। মকুবল বলেন, পুলিশের সদস্য হিসাবে গর্বিত। মানুষের সেবায় নিজের জীবন বিলিয়ে দিতেও কার্পণ্য করি না। আমি আহত হয়েছি, পঙ্গুত্ববরণ করেছি; কিন্তু মনোবল হারাইনি। ওই সময় পুলিশ কনস্টেবল জাকারিয়াকে পিটিয়ে হত্যা করা হয়। তার স্ত্রী মায়া বেগম বলেন, ‘আমার দুটি ছেলে আছে, তাদের একটা ব্যবস্থা করবেন। আমার সুস্থতার ব্যবস্থা করবেন।’
ফটোসাংবাদিক আবু সাঈদ তামান্না স্মৃতিচারণা করে বলেন, ‘সেদিন আমি মৃত্যুর মুখে পড়ে যাই। আমার কাছে একটা ফোন আসে যে তারা পেট্রোল বোমা বিতরণ করছে। তারা আমার উপস্থিতি টের পেয়ে তাড়া করে ছুরিকাঘাত করে। আমরা কাজের সুন্দর পরিবেশ চাই। বিএনপি-জামায়াত এখন আবার শুরু করেছে। আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি।’ স্বামীহারা বিনা সুলতানা বলেন, ‘যারা এই বোমা হামলার সঙ্গে জড়িত, তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই।’ সংরক্ষিত আসনের সংসদ-সদস্য খোদেজা নাসরিন আক্তার বলেন, ‘২০১৩ সালের ২৮ নভেম্বর সন্ধ্যা ছিল আমার জীবনের সবচেয়ে ভয়ংকর মুহূর্ত। আমি এখনো সেই যন্ত্রণা নিয়ে চলছি। আমাদের সবার আকুতি, জামায়াত-বিএনপির নৈরাজ্যের বিচার চাই। প্রয়োজনে আমি সাক্ষ্য দেব।’
অনুষ্ঠানে ক্ষতিপুরণ ও বিচার চান পঁচাত্তর-পরবর্তী জিয়াউর রহমানের সময়ে সামরিক আদালতে বিচারের মাধ্যমে দণ্ডিত সেনা, নৌ ও বিমানবাহিনী পরিবারের সদস্যরা।