“রিপোর্টে এসেছে যে, গণতন্ত্রের লেশমাত্র এখানে নেই, মানবাধিকারের লেশমাত্র এখানে নেই। এটা পড়লে এত লজ্জিত হই যে, কী দেশ হল আমার!”
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বাংলাদেশের সম্পর্কে যে মূল্যায়ন প্রকাশ করা হয়েছে, তা দেখে ‘লজ্জা’ পাওয়ার কথা জানিয়েছেন বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর।
তার অভিযোগ, ‘দেশে একদলীয় শাসন কায়েমের চেষ্টা চলছে’, মানুষের ‘অধিকার কেড়ে নেয়া হচ্ছে’, সাংবাদিকদের ‘সত্য কথা লেখার অধিকার নেই’।
বিএনপির সাবেক মহাসচিব কেএম ওবায়দুর রহমান স্মরণে বুধবার রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন ফখরুল।
২০০৭ সালের ২১ মার্চ মারা যান কেএম ওবায়দুর রহমান, যিনি এক সময় ছিলেন ছাত্রলীগের ডাকসাইটে নেতা, ছিলেন বঙ্গবন্ধুর স্নেহধন্য। জিয়াউর রহমানের সামরিক শাসনামলে তিনি যোগ দেন বিএনপিতে।
মির্জা ফখরুল তার দীর্ঘ বক্তব্যে কথা বলেন যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদন নিয়ে। তিনি বলেন, “এটা পড়লে এত লজ্জিত হই যে, কী দেশ হল আমার! রিপোর্টে এসেছে যে, গণতন্ত্রের লেশমাত্র এখানে নেই, মানবাধিকারের লেশমাত্র এখানে নেই।
“এখানে ক্রসফায়ারে মানুষকে মেরে ফেলা হচ্ছে, এখানে বিনাবিচারে মানুষকে হত্যা করা হচ্ছে, মানুষ গুম হয়ে যাচ্ছে, এখানে মানুষের অধিকার কেড়ে নেওয়া হচ্ছে, সাংবাদিকদের সত্য কথা লেখার কোনো অধিকার নেই।
“এখানে একজনকে গ্রেপ্তার করতে না পেলে তার আত্মীয়-স্বজনকে অত্যাচার করা হচ্ছে, নির্যাতন করা হচ্ছে। বিদেশে কেউ এই সরকারের বিরুদ্ধে কথা বললে তার আত্মীয়-স্বজনকে এখানে নির্যাতন করা হচ্ছে, এই একটা ভয়াবহ চিত্র এই রিপোর্টের মধ্যে এসেছে।”
যুক্তরাষ্ট্রের মানবাধিকার প্রতিবেদনে বলা হয়, “বাংলাদেশের সংবিধান অনুসারে সংসদীয় গণতন্ত্রের সরকার গঠন হয়, যেখানে বেশিরভাগ ক্ষমতা ন্যস্ত প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের কাছে।”
একাদশ সংসদ নির্বাচন নিয়ে প্রতিবেদনে বলা হয়, “ব্যালটে নিয়ম বহির্ভূত সিলমারা এবং বিরোধী এজেন্ট ও ভোটারদের ভয়ভীতি প্রদর্শনসহ অনিয়ম এমন সব অভিযোগের কারণে ওই নির্বাচন পর্যবেক্ষকদের কাছে অবাধ ও স্বচ্ছ হিসাবে বিবেচিত হয়নি।”
২০২২ সালে বাংলাদেশে ‘বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, গুম, মতপ্রকাশ ও গণমাধ্যমের বাধা, সভা-সমাবেশে বলপ্রয়োগ, জাতীয় ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে বাধা’ প্রভৃতি অন্যান্য সময়ের মত অব্যাহত ছিল বলেও যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদনে লেখা হয়েছে।
তবে প্রতিবেদনে যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে, তা ‘খুবই দুঃখজনক’ বলে মন্তব্য করেছেন পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম। তিনি বলেছেন, “একজন প্রধানমন্ত্রীর যেটুকু ক্ষমতা থাকা প্রয়োজন, ঠিক ততটুকুই আছে। এটার ডিগ্রি অব অ্যাপ্লিকেশন বা অন্য কিছু নিয়ে একটা বন্ধু রাষ্ট্রের উদ্বেগ প্রকাশ করার বা সংশয় প্রকাশ করার বা প্রশ্ন উত্থাপন করার কোনো নৈতিক অধিকারই নেই।”
ফখরুল বলেন, “এই রিপোর্ট বের হওয়ার পরে আওয়ামী লীগের নেতারা তারা এখন তাদের মতো করে বলতে শুরু করেছেন… যুক্তরাষ্ট্র তার নিজের দিকে তাকায় না।
“তবে যুক্তরাষ্ট্র নিজের দিকে তাকায় বলেই তো এই রিপোর্ট তৈরি হয়েছে। তারা গণতন্ত্রকে তাদের রাষ্ট্রে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছে এবং এ কারণেই গণতন্ত্রের নেতা হিসেবে তারা কাজ করছে। আর আওয়ামী লীগ অত্যন্ত সচেতনভাবে একনায়কতন্ত্র, কর্তৃত্ববাদ, ফ্যাসিবাদ প্রতিষ্ঠা করেছে।”
আওয়ামী লীগ ‘সচেতনভাবে একদলীয় শাসন’ কায়েম করতে চায় অভিযোগ করে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তারা গণতন্ত্রের প্রতিষ্ঠানগুলোকে ভেঙে দিয়েছে এবং মানুষের যে ন্যূনতম অধিকার, সেগুলো সব কেড়ে নিয়েছে।
“এরা কথায় কথায় গণতন্ত্রের কথা বলে, এরা কথায় কথায় সংবিধানের কথা বলে। এমনভাবে বলে যে, তারাই একমাত্র এদেশের মালিক।”
‘দেশে সংসদীয় একনায়কতন্ত্র চলছে’
আলোচনায় বক্তব্য দেন বিএনপির সঙ্গে ‘যুগপৎ আন্দালনে’ যাওয়ার ঘোষণা দেওয়া জেএসডির সভাপতি আ স ম আবদুর রবও। তিনি বলেন, “আওয়ামী লীগ ভোটে বিশ্বাস করে না, নির্বাচনে বিশ্বাস করে না, গণতন্ত্রের বিশ্বাস করে না, ভোটাধিকারে বিশ্বাস করে না।
“তারা ভোট চুরি করে ব্যালট ডাকাতি করে নির্বাচিত হয়। নিজেরা ব্যালট বাক্সে ব্যালট ঢুকিয়ে দিয়ে বলে যে, জনগণ আমাদেরকে ভোট দিয়েছে।”
তিনি বলেন, “এটা পার্লামেন্টারি ডেমোক্রেসি নয়, এখন চলছে পার্লামেন্টারি ডিক্টেটরশিপ… এক নায়কতন্ত্র চলছে। সংবিধানের সর্বময় ক্ষমতা একজন। দেশের মালিকানায় জনগণ নেই। এই সরকার হটাতে হবে, গণঅভ্যুত্থান ঘটাতে হবে।”
কেএম ওবায়দুর রহমান স্মৃতি সংসদের সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান মিয়া সম্রাটের পরিচালনায় আলোচনা সভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী, ভাইস চেয়ারম্যান বরকত উল্লাহ বুলু, চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা কাউন্সিলের সদস্য আবদুস সালাম, শাহজাদা মিয়াও স্মরণ সভায় অংশ নেন।
বিএনপি কেন্দ্রীয় নেতা খায়রুল কবির খোকন, শহিদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, নাজিম উদ্দিন আলম, কামাল উদ্দিন চৌধুরী, সেলিমুজ্জামান সেলিম, আনিসুর রহমান তালুকদার খোকন, জাগপার আসাদুর রহমান খান, স্বেচ্ছাসেবক দলের এসএম জিলানী, যুব দলের শফিকুল ইসলাম মিল্টন, উলামা দলের মাওলানা শাহ মুহাম্মদ নেছারুল হক, মতস্যজীবী দলের আবদুর রহিম, ছাত্র দলের সাইফ মাহমুদ জুয়েল, জাতীয়তাবাদী মুক্তিযুদ্ধের প্রজন্মের সাইফুল ইসলাম, মাদারীপুর জেলা বিএনপির জাহান্দার আলী জাহান এবং প্রয়াত কেএম ওবায়দুর রহমানের মেয়ে শ্যামা ওবায়েদও এতে বক্তব্য দেন।